প্রীতি ওযারেছা: ‘মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ জিয়ানগর কমান্ড কাউন্সিলের সকল বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সংবর্ধনা ও পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান। পুরস্কার নিচ্ছেন মুক্তিযোদ্ধা সংসদের বর্তমান উপজেলা কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা বেলায়েত হোসেন, বর্তমান উপজেলা ডেপুটি কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা স্বপন কুমার রায়, সাবেক কমান্ডার মাহবুবুল আলম হাওলাদার (আমার আব্বার মামলার বাদী ও প্রথম সাক্ষী), মুক্তিযোদ্ধা খলিলুর রহমান, মুক্তিযোদ্ধা দেলোয়ার ফকির।’
এটি একটি ফেসবুক স্ট্যাটাস। স্ট্যাটাসটি ফেসবুকে পোস্ট করেছেন কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী দেলওয়ার হোসেন সাঈদী ওরফে দেল্যা রাজাকারের ছেলে মাসুদ সাঈদী। ক্রেস্ট গ্রহণকালীন বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ছবি মাসুদ সাঈদীর টাইমলাইনে ভৌতিক পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। ভূত দেখার মতো আমরা চমকে উঠছি।
দিনটা ছিল আমাদের মহান বিজয় দিবস, আহারে আহারে। মাসুদ সাঈদী কী অশ্লীল রকমের আনন্দই না পেয়েছেন মুক্তিযোদ্ধাদের উপহার দেয়ার সময়, স্ট্যাটাসটি লেখার সময় এবং ছবিসহ সেটি পোস্ট করার সময়ে। আমিসহ বাংলাদেশের সমস্ত মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সন্তানরা মাসুদ সাঈদীর সেদিনকার প্রতিটা মুহূর্তের গোপন অনুভূতিকে অনুভব করতে পারছি। পৈশাচিক উল্লাস তার মধ্যে খেলে গেছে।
কয়েকদিন ধরে আমি ছবির সেই মুক্তিযোদ্ধাদের দেখছি। দীর্ঘক্ষণ ধরে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছি। তাদের বডি ল্যাঙ্গুয়েজ বোঝার চেষ্টা করছি। মায়া লাগছে, ঘৃণা লাগছে আবার তীব্র লজ্জায় চোখ ফিরিয়ে নিচ্ছি। এটা কি আদৌ সম্ভব! অনুভূতিতে গেঁড়ে বসেছে পিনপতন নিরবতা, যেন এইমাত্র কেউ ঘোষণা দিয়েছেন- বীর শহীদদের উদ্দেশ্যে এক মিনিট নিরবতা পালন করুন, যাদের ভাগ্য ভালো যে তারা মরে বেঁচে গেছেন, এই দৃশ্য তাদের দেখতে হয়নি।
পিরোজপুর জেলার জিয়ানগর উপজেলা চেয়ারম্যান মাসুদ সাঈদীকে রাষ্ট্র মহান বিজয় দিবসের কুচকাওয়াজে পুলিশের সালাম গ্রহণ করিয়েছে, আবার তাকে দিয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের উপহারও প্রদান করিয়েছে। কুচকাওয়াজে মাসুদ সাঈদীর পাশে দাঁড়ানো ছিলেন ওসি মো. মিজানুল, ইউএনও জাকির হোসেন বাচ্চু, উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার বেলায়েত হোসেন এবং উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মতিউর রহমান।
ভাবতে পারেন কী অভাবনীয় দৃশ্য! মুক্তিযুদ্ধের সময় পাক সেনাদের সাহায্যকারী রাজাকার, আলবদর আর আল শামস্ মহান স্বাধীনতা লাভের পর থেমে থাকেনি। রাষ্ট্রের অস্তিত্বে পচন ধরানোর জন্য যা যা করণীয় করেছেন। এক দেলাওয়ার হোসেন সাঈদীই ওয়াজের নামে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে সাম্প্রদায়িকতার বিষবৃক্ষ রোপণ করে গেছেন নিখুঁতভাবে। ফলাফল কিন্তু আমরা পাচ্ছি।
বিলুপ্তপ্রায় জামায়াতে ইসলামের সেবক হয়ে মাসুদ সাঈদী তার জাতগোষ্ঠীর রুটি-রুজির সংস্থানকে বাঁচানোর প্রাণান্ত চেষ্টা করবে, আস্থাভাজন হয়ে ধীরে ধীরে প্রশাসনের পেটের মধ্যে ঢুকবে, অতঃপর একসময় বাপের দণ্ড মওকুফ করার সিদ্ধান্ত বাগিয়ে আনা তার কাছে ‘সময়ের ব্যাপার মাত্র’ হয়ে দাঁড়াবে- এসব মাসুদ সাঈদীর দূরদর্শিতা। সে দীর্ঘ পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে।
ধরেই নিলাম মাসুদ সাঈদী জিয়ানগরের জনপ্রতিনিধি এবং সেই সুবাদে প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের যোগসাজশে কর্মটি ঘটাতে সক্ষম হয়েছে, কিন্তু আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধা যাদের নিয়ে আমরা গর্ব করি, যারা দেল্যা রাজাকার ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে লড়ে দেশকে স্বাধীন করেছেন, তারা এই অপকর্মটি কীভাবে করতে পারলেন!
মুক্তিযোদ্ধার গৌরব যাদের মাথায় তারা এতো সহজে বিকোয় কীভাবে! সেই গর্বিত হুঙ্কার, সেই বজ্রমুষ্ঠির অহংকার তারা বিক্রি করে দিলেন এক নিমেষে! বিবেক যেখানে কাজ করে না সেখানে প্রচ্ছন্ন স্বার্থ লুকিয়ে থাকে। উপজেলা চেয়ারম্যান তাদের ভাতা বন্ধ করে দেবে, প্রদেয় নানাবিধ সুবিধাদি থেকে তাদের বঞ্চিত করবে, এই আশঙ্কায়ই কী তারা রাজাকার পুত্রকে প্রতিরোধ করেননি?
কিন্তু এসবতো উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের এখতিয়ারের বাইরে, মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা ও প্রাপ্ত সুবিধাদিতে হস্তক্ষেপ করার ক্ষমতা কোনভাবেই তার নেই। তাহলে মুক্তিযোদ্ধারা কেন রাজাকার সন্তানকে বর্জন করে স্থানীয় সর্বোচ্চ প্রশাসনিক কর্মকর্তার হাত থেকে উপহারটি নেয়ার দাবি তুলতে পারলেন না? উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সেখানেই উপস্থিত ছিলেন। বিষয়টিতে বিস্ময় থেকে যাবে আজীবন।
মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিক তালিকা নিয়ে নানা ধরনের বিব্রতকর খবর কাগজে প্রকাশিত হয়েছে, এখনো হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় ও মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কয়েক দফায় মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা তৈরি করেছে এবং সেটা তুমুল বিতর্কিত ও প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে একের পর এক ভূয়া মুক্তিযোদ্ধার নাম প্রকাশিত ও প্রমাণিত হতে থাকার কারণে সরকার যখন রীতিমত নাস্তানাবুদ ঠিক তখন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় ও জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল যৌথভাবে তালিকা যাচাই-বাছাই করে সঠিক তালিকা প্রণয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করে।
২০১৭ সালের জানুয়ারি মাসের প্রথম শনিবার থেকে দেশব্যাপি মুক্তিযোদ্ধা তালিকার যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়া শুরু হবে। যথার্থই খুবই কার্যকরি একটি পদক্ষেপ। কারণ বর্তমান সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানজনক ভাতা প্রদান করছে সেইসঙ্গে তাদের সন্তান-সন্ততি আর নাতি-পুতিদের স্কুল-কলেজ- ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি ও চাকরির সুযোগ তৈরি করে দেয়ায় রাতারাতি বনে বাদাড়ে সার্টিফিকেটধারী মুক্তিযোদ্ধা বনে গেছেন হাজার হাজার অগা-মগা-জগা।
আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের অর্জন, নৈতিকতা অথবা চেতনার মূল্য তাদের কাছে টাকার বিনিময়ে মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট হাতানোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ। নিজের বিবেকের কাছে তাদের কোন দায়বদ্ধতা নেই, উত্তর প্রজন্মের কাছে তো নেই-ই। স্খলন কি তাহলে সেখান থেকেই শুরু! যখন গণহারে জামায়াতে ইসলামী রাজাকারদের সরকারি দলে যোগদান করতে দেখেন, স্থানীয় জনপ্রতিনিধির সাথে ফুলের মালা পরিহিত অবস্থায় টিভিতে কিংবা পত্রিকায় তাদের হাস্যোজ্জল ছবি দেখেন- কেমন লাগে? বুকের ভেতরটা নিশ্চয়ই বিষাদে এবং অজানা আশঙ্কায় মোচড় দিয়ে ওঠে।
বঙ্গবন্ধু তার হৃদয়ের উদারতা দিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের প্রতি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছিলেন। সেই উদারতার সুযোগ ঠিকই নিয়েছে অপরাধীরা। চূড়ান্ত মূল্য দিয়েছে বাংলাদেশ। তবে এখন দলে ভেড়ানোর নামে যেটা হচ্ছে সেটাকে কী বলে? এর শেষ কোথায় গিয়ে থামবে!

আমার বাবা, আব্দুল ওদুদ, যিনি বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদের নাটোর জেলার সিংড়া উপজেলা কমান্ডের নির্বাচিত বর্তমান মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার। হঠাৎই জানতে ইচ্ছে হলো জিয়ানগরের ঘটনাটি তার কাছে কেমন লেগেছে। তিনি বলেন, প্রথমে বিশ্বাস হয়নি তারপর সত্যিটা জানার পর লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে হয়েছে, মনে হয়েছে যেন কাজটি আমিই করেছি!
জিয়ানগরের মুক্তিযোদ্ধারা প্রচণ্ড রকমের ঘৃণিত একটি কাজ করেছেন। বিজয় দিবসে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর তরফ থেকে নানারকম উপহার সামগ্রী স্থানীয় প্রশাসনের সর্বোচ্চ কর্মকর্তার মাধ্যমে মুক্তিয়োদ্ধারা গ্রহণ করে থাকেন। জনপ্রতিনিধির মাধ্যমেও গ্রহণ করতে পারেন, কিন্তু কখনোই সেটা রাজাকার পরিবারের সদস্য কিংবা কোন বিতর্কিত ব্যক্তির কাছ থেকে নয়। কোনকিছুর বিনিময়েই নয়, কখনোই নয়।