‘কেরোসিন আর দিয়াশলাই ছিল আমার সঙ্গী’

শ্রাবণী এন্দ চৌধুরী:

৭ই মার্চের বঙ্গবন্ধুর সেই ঐতিহাসিক বক্তৃতা শুনে রোকেয়া হলে এসে শুনি ঢাকার সাথে সব যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যাবে দু’একদিনের মধ্যে। আমার বাবা তখন পটুয়াখালিতে পোস্টেড। আমরা যারা বরিশাল, পটুয়াখালির, সবাই একসাথে লঞ্চ ধরেছিলাম।

এপ্রিল মাসের কোন এক সময় পাকিস্তান আর্মি পটুয়াখালি এ্যাটাক করে। প্রথম শুরু হয় এয়ার এ্যাটাক। শেলিং ও বোমা। যে বোমা থেকে আগুন ধরে যাচ্ছিল। আমরা কজন তখন আমাদের বাড়িতে ক্যারাম খেলছিলাম। যুদ্ধ কাকে বলে তখনও জানতাম না। রেডিওতে ভালমতো সিগনাল পাওয়া যেতো না। যেটুকু বুঝেছিলাম ঢাকায় ম্যাসাকার হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর হয়ে মেজর জিয়া স্বাধীনতার যে ঘোষণা দিয়েছিলেন, সেটা শুনেছিলাম।

এই বোমা, শেলিং এর মধ্যে আমার বন্ধু ডেইজীর ভাই, আমার ক্লাসমেট পংকজ এসে আমাদের খবর দিলো যে আর্মি নেমেছে, এখনই আমাদের পালাতে হবে। আমাদের চারপাশে নদী, সমুদ্র … জানি না কোথায় যাবো। তবুও আমার মা আমাদের ঠেলে বের করে দিলেন পেছনের দরজা দিয়ে। আমরা ছয়জন ছিলাম। বয়স ১২ থেকে ১৮ র মধ্যে। যাবার আগে মায়ের সিঁদুর মুছে দিয়ে গিয়েছিলাম।

আমাদের পাড়াটা ছিলো সব সরকারি অফিসারদের নিয়ে। স্থানীয় কেউ ছিলো না। পেছনেই ছিলো একটি শ্মশান, যেখানে কোন সৎকার হতো না, আর তারপরই ছিলো নদী। আমরা কোনমতে নদীর পাড়ে পৌঁছে দেখি বৈঠা ছাড়া একটা খালি নৌকা পড়ে আছে। আমরা সেই নৌকায় উঠেছিলাম ওপারে যাবার আশায়। চারিদিকে তখন প্রচন্ড শেলিং হচ্ছিল। রক্ত, লাশ আর আর্তনাদ। তার মধ্যে আমরা হাত দিয়ে জল কাটছি। এক সময় ওপারে পৌঁছাই, কিন্তু জানি না কোনদিকে যাবো। কাঁদতে কাঁদতে আমরা নদীর পাড় ধরে হাঁটতে শুরু করি। পথে আমাদের দেখে পংকজের বাবার কোর্টের মুহুরি আমাদের উনার নৌকায় তুলে নেন।

ভদ্রলোককে আমরা চিনি না। উনার কথায় বিশ্বাস করে উঠেছি নৌকায়। আমাদের আর কোন পথও ছিলো না। সারাদিন এই নদী, সেই নদী ঘুরে সন্ধ্যের আগে নদীর পাড়ে এক জঙ্গলের ভেতর নৌকা রেখে বললেন, রাতে এসে আমাদের নিয়ে যাবেন। কারণ উনি চান না, গ্রামের লোকজন জানুক আমরা ওনার বাড়িতে আছি। রাতে নৌকা গিয়ে লাগলো ওনার বাড়ির ঘাটে। আমাদের নিয়ে তুললেন একটা অন্ধকার ঘরে। পরে বুঝেছি ওটা ছিলো ঘরের ভেতর ঘর। ওখানে আমি আর ডেইজী দশ-বারো দিন ছিলাম।

ছেলেদের চলে যেতে হয়েছিলো, কারণ ওঁরা ছেলেদের রাখতে সাহস পাচ্ছিলেন না। প্রথম তিন-চার দিন তো জানিনি বাবা-মা বেঁচে আছেন কিনা। পঙ্কজই জীবন হাতে নিয়ে বাড়ি গিয়ে খবর দিয়েছিলো যে আমরা বেঁচে আছি। ও ফিরে আসার পর শুনেছিলাম,  সব হিন্দু অফিসারদের মুসলিম নাম নিতে হয়েছে। আর আমাদের উপর তলার ফ্লাটে এক অফিসারের বৌ আর শালী অত্যাচারিত হয়েছেন।

১০ দিন পর যখন গ্রামের মেয়েদের ধরে ধরে আনা হচ্ছে, তখন ঠিক হলো আমাদের শহরে পাঠিয়ে দেয়া হবে। এই মুহুরী ভদ্রলোকের পরিবারের কাছে আমাদের ঋণের সীমা নেই। বৌরা আমাদের শাড়ী দিয়েছিলো পরতে। এই বৌয়েরাই আমাদের ছাই মাখিয়ে বোরখা পরিয়ে নৌকায় উঠিয়ে দিলো। মাঝি আমাদের বাড়ির কাছাকাছি নামিয়ে দিয়েছিলো।

আমরা দুই ভিক্ষুক। বোরখার ভেতর দিয়ে কিছুই দেখতে পারছিলাম না। অন্ধের মতো বাড়ির কাছে এসে পৌঁছাই। ডেইজির বাড়ি একটু আড়ালে ছিলো, ও চলে গেলো। আমি আটকে গেলাম। আমার বাড়ির সামনেই মাঠ, আর মাঠের ওপারে সার্কিট হাউস, যেখানে আর্মিরা মেশিনগান, বায়নোকুলার ফিট করে তাকিয়ে আছে। আমাকে ওদের চোখের সামনে দিয়ে যেতে হবে। গুলি করে দিতে পারে, বা ধরে নিয়ে যেতে পারে। আমি জানি না আমি কীভাবে ওই পথটুকু পাড়ি দিয়েছিলাম!

বাড়ি আসার পর আমার মা আমাকে আরেক ছোট অন্ধকার ঘরে ঢোকালেন। ছোট একটা বাতি টিম টিম করে জ্বলতো দিন রাত। আমার জামা-কাপড় বাইরে শুকোতে দেয়া হতো না। যেন কেউ না জানতে পারে এখানে একটা মেয়ে আছে। বিছানার পাশে এক বোতল কেরোসিন তেল আর হাতে এক বাক্স দেশলাই নিয়ে আমি বসা। কোন সময় যদি আমাকে ধরে নিতে আসে, তবে আমার বাবা-মাকে না মেরে কেউ আমার গায়ে হাত দিতে পারবে না। তখন যেন আমি আমার গায়ে আগুন লাগিয়ে দিতে পারি।

আমি অনেক মাস সূর্যের আলো দেখিনি। প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুকে দেখেছি। দাঁতে দাঁত চেপে দিন পার করেছি আর ভেবেছি স্বাধীনতা কী দেখতে পারবো নাকি তার আগেই পাগল হয়ে যাবো!

প্রতি রাতে পাকিস্তানি আর্মি মেজর (খুব সম্ভব নাম ছিলো মেজর নাদের ) আমাদের ওপর তলার এক নারীর সাথে রাত কাটাতে আসতো এবং গাড়িটা রাখতো আমার সেই ছোট অন্ধকার ঘরের পাশে। যতক্ষণ না ভারী মাতাল পায়ের আওয়াজ মিলিয়ে যেতো, আমি আমার ঘরে কেরোসিনের বোতল ও দেশলাইয়ের বাক্স হাতে নিয়ে ঠক ঠক করে কাঁপতে থাকতাম।

আমি আজও সেই আতংক কাটিয়ে উঠতে পারিনি। এখনও স্বপ্নে দেখি চারিদিক আগুন আর আমি বের হতে পারছি না।
অসম্ভব অত্যাচারী ছিলো এই মেজর। আটঘর কুড়িয়ানা জ্বলিয়েছে এই মেজর। প্রতিদিন বিকেল হলেই গুলির আওয়াজ শুনতে পেতাম। নিরীহ মানুষদের লাইন করে গুলি করতো। প্রায় সময় জেলে গিয়ে কয়েদিদের গুলি করতো। মৃতদেহগুলো নিয়ে নদীতে ফেলে দিতো।

স্বাধীনতার পর সার্কিট হাউস থেকে একশ র উপর মেয়েকে মুক্তি দেয়া হয়েছিলো। গায়ে একটা সুতোও নেই। কেউ প্রগনেন্ট, কেউ তখন বদ্ধ পাগল। ওরা বুঝতেই পারেনি ওরা মুক্ত। সামনের দরজা দিয়ে না গিয়ে এরা দেয়াল টপকে পালাতে চেষ্টা করছিলো। আমি দেখেছি কতো মেয়ে সোজা দৌড়ে গিয়ে নদীতে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করতে। অনেককে তাদের পরিবার গ্রহণ করেনি। ওরা পরে ভিক্ষা করতো।

আজ যারা মুক্তিযুদ্ধের ওই নয় মাসে নির্যাতিত নারীর সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন তোলে, তাদেরকে একটা কথাই বলতে চাই, এই ত্যাগ, এই রক্তের উপর তোমরা দাঁড়িয়ে স্বাধীনতা উপভোগ করছো। যে সংখ্যা তোমাদের কাছে আছে, তার থেকে অনেক অনেক বেশি মেয়ে অত্যাচারিত হয়েছিল সেইসময়ে।

শেয়ার করুন: