শোভা যেন আর হেরে না যায় কখনও!

সুপ্রীতি ধর:

শোভা এক সংগ্রামের নাম! তার মায়ের লড়াইয়ের আরেক নাম শোভা, কথাটা এভাবেও বলা যায়। কারণ তার মায়ের নিজের অস্তিত্ব যখন বিলীন, তখন এই মেয়েই তাঁকে বাঁচার প্রেরণা জুগিয়েছে। কীভাবে জুগিয়েছে? তার অদম্য মেধা দিয়ে, ইচ্ছাশক্তি দিয়ে। ফলে তার মা ডুবে যেতে যেতেও ভেসে উঠেছে, পথ পেয়েছে সামনে পথ হাঁটবার। যুগল সংগ্রামের এক অনবদ্য ছবি আজকের এই শোভা। মেয়ে, তোমাকে স্যালুট!

কালের কণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত নিবন্ধটি কতবার যে পড়েছি, বলতে পারবো না। বারবারই বুকের ভেতরটা খামচে ধরেছে এক চিরচেনা কষ্ট। প্রথমবার পড়ার পরই মনে হয়েছে শোভার মা প্রতিমা রানী দাশ কেন বাড়িছাড়া? কেন তাকে বার বার ধর্না দিতে হয়েছে নিজের বাবারই ঔরসজাত পুত্র সন্তানের কাছে? কেন তাকে বার বার নিজ বাড়ি থেকে বের করে দেয়া হয়েছে? যখন পড়ি যে “একটা পোঁটলা আর আমাকে নিয়ে মা বাড়ি ছাড়লেন। বাইরে তখন তুমুল বৃষ্টি। মায়ের চোখে জল। কোথাও যাওয়ার মতো জায়গা যে আমাদের নেই!”, স্পষ্ট চোখে দেখতে পাই দৃশ্যটা। কিন্তু এ মোটেও সিনেমার প্লট নয়, বাস্তব দৃশ্য, বড় কঠিন সেই সময়, ক্ষণ। আমি তো নিশ্চিত যে এই প্রতিমা রানী জন্মের পর থেকেই জেনে এসেছে ‘মেয়েদের বাবার বাড়িতে ঠাঁই নেই, স্বামীর বাড়িই আসল ঠিকানা’, আর এই জানার কারণে সেই ছোটবেলা থেকেই তার উড়ার আকাশ সংকুচিত হয়ে গেছে, প্রতিবাদ বা অধিকার আদায়ের মতোন মনোবলও তার তৈরি হয়নি কখনও। কখনও জানতেও চায়নি যে মা-বাবা তাকে জন্ম দিয়েছে, সেই মা-বাবার কাছে সে ফিরতে পারবে না কেন? কেন সেই বাড়ি তারও হবে না?

ফেসবুকে একজন লিখেছেন, চারিদিকে শোভাকে নিয়ে সমব্যথী আর গর্বকারী হিন্দুর ছড়াছড়ি!! কিন্তু শোভাকে কেন এতো কষ্ট পেতে হয়েছে, তার কারণ নিয়ে হিন্দুদের যেন কোন বিকার নাই। ফেসবুকে শোভার স্ট্রাগল আর মেধাই তাদের লেখনীর অংশ। ব্যাপারটা ইন্টারেস্টিং, ঠিম যেন সেই উক্তিটির মতো, “সুসময়ের বন্ধু অনেকেই হয়, দুঃসময়ে হায় হায় কেউ কারো নয়”। এতো বঞ্চনার পরও কেউ কেন তাদের আইনি আশ্র‍য় নেবার কথা বলছে না ভাবুন তো!!

প্রশ্নটা আমারও এখানেই। আজ প্রতিমা রানী হিন্দু পরিবারের বলেই তাকে এমন নি:স্ব হয়ে, হাজারও অকথ্য-নির্যাতন সয়ে মেয়েকে নিয়ে বাঁচতে হয়েছে। মুসলিম পরিবারেও যে এমনটা হয় না, তা নয়। হয় সেখানেও। কিন্তু সম্পত্তিতে মুসলিম মেয়েদের ন্যুনতম হলেও অধিকার থাকে বলে মনোবল থাকে, মেরুদণ্ডটা সোজা করে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার মতোন শক্তিটুকু থাকে। বাকিটা যে যার মতোন করে চালিয়ে যায়। আইন তাদের পক্ষে থাকে। যেখানে আইনের বৈষম্যই একজন হিন্দু মেয়েকে ‘ভাগাড়ে’ ফেলে দেয়।

আমি নিশ্চিত যে এই শোভা বেঁচে থাকলে অনেক বড়কিছু হবে। ততদিন তার অপুষ্টিতে ভোগা, মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনের শিকার মা জীবিত থাকবেন কিনা জানি না, কিন্তু সেই মামার বাড়ির, বাবার বাড়ির অনেকেই ‘দাবি’ নিয়ে দাঁড়িয়ে যেতে পারে, গর্ববোধ করার দাবি। অথচ এর পিছনে তাদের বিন্দুমাত্র অবদান তো নেই-ই, বরং আছে উপহার, অবহেলা আর নির্যাতনের ইতিহাস।

হিন্দু বড় বড় নেতাদের বলি কী, শোভাকে নিয়ে অকারণ গর্ব করার কোন অধিকার আপনাদের নেই। এই আপনাদের কারণেই ওকে আর ওর মাকে এতো কষ্ট সইতে হয়েছে। শুধুমাত্র হিন্দু বলে গর্ব করেন তো? ধিক আপনাদের। খোঁজ নিয়ে দেখেন, ওকে আর ওর মাকে যাঁরা সাহায্য করেছেন, তাঁদের সবাই মেয়েটার অদম্য মেধা দেখে আর মায়ের লড়াইটাকে সম্মান জানাতেই পাশে দাঁড়িয়েছে, ধর্মটাকে দেখেনি, বিবেচনা করেনি। নিবন্ধ থেকেই জেনেছি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অনেক সহৃদয়বান মানুষ তাঁদের পাশে ছিলেন, এখনও আছেন, তাঁদেরকেও আমার স্যালুট যে আপনার কৃতী চিনেছেন, মানুষ হিসেবে মনুষ্যত্বের পরিচয় দিয়েছেন!

শেষে এটুকু বলবো যে শোভার মা তাঁর নিজের জীবন দিয়ে মেয়েকে এতোদূর ঠেলে এনেছে,  বাকিটুকু পথ শোভার দৃঢ়তাই এগিয়ে নেবে, আমার বিশ্বাস। এই মেয়েরা হেরে যায় না কখনও। এই মায়েরাও হারে না। স্যালুট আবারও।

(ফিচারের ছবিটি দৈনিক কালের কণ্ঠ থেকে নেয়া)

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.