নাজমুল আহমেদ:
দিনকয়েক আগে শুদ্ধস্বর অনলাইন ম্যাগাজিনে অ্যাক্টিভিস্ট দিলশানা পারুলের ‘হিজাবের সংস্কৃতি’ শীর্ষক একটি লেখা আমি পড়েছিলাম। চিন্তা উদ্রেককারী লেখা, কিন্তু পুরো লেখাটি আমি ভালো বুঝতে পারিনি, বিশেষ করে পারুল উপসংহারে কী বলতে চাইছেন।
এক জায়গায় তিনি বলেছেন, “৯/১১ এর পর পুরো বিশ্বেই মুসলিম নারীরা হিজাবকে একটি পলিটিক্যাল স্টেটমেন্ট হিসেবে দাঁড় করাতে পেরেছে”। হ্যাঁ, তা পেরেছেন, কিন্তু এইরকম পারাতে মুসলিম নারী বা মুসলমান সমাজের অবস্থাটা কী হয়েছে সেটা বলেননি, আমিও বুঝিনি।
পোশাকের ব্যবসার সাথে বাজার অর্থনীতির কথা চমৎকার করে বলেছেন। বাজার অর্থনীতি যে চাতুরতার সাথে ম্যানুফ্যাকচারড চাহিদা ও অভাববোধ তৈরি করে, সেটা দেখিয়েছেন। এক্ষেত্রে উদাহরণ হিসেবে চুলে রঙ করার প্রোডাক্টের কথা বলেছেন। বোরখা/হিজাবের ক্ষেত্রেও পুঁজি ধর্মকে ব্যবহার করে এরকম ম্যানুফ্যাকচারড চাহিদা ঘটিয়েছে, সেটাও বেশ ভালভাবে বলেছেন।
কিন্তু লেখার শেষের দিকে এসে কিছু সার্ভের বরাত দিয়ে উপরে বলা কথাগুলোই যেন নাকচ করেছেন, আমার কাছে সেরকমই মনে হলো। এতোক্ষণ যেটাকে বানিয়ে তোলা বলছিলেন, সেটা নিয়ে কি সন্দেহ প্রকাশ করলেন? হিজাব/বোরখা ‘বানিয়ে তোলা চাহিদা’র চেয়েও ‘যুগের চাহিদা’ – এই কথাই কী বললেন, আমি ঠিক বুঝি নাই।
পারুলের লেখার প্রেক্ষিতে আমার কিছু কথা বলছি।
লেখাতে সার্ভেগুলোর যে তথ্যগুলো উল্লেখ করেছেন, সেটা হয়তো ঠিকই আছে। কিন্তু আমার মনে হয় তথ্যের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে কিছু ঘাটতি আছে। কাদের কাছ থেকে তথ্য নিয়েছেন, কী কী তথ্য নিয়েছেন, ওনাদের সামাজিক অবস্থান, লেখাপড়া, ধর্ম – এসব কিছুই আমার জানা নেই। ফলে আমি যে কথাগুলো বলবো, সেগুলো মূলত পারুলের লেখাকে ভিত্তি করে, সার্ভে না। সেইসাথে আমাদের সমাজে বোরখা সম্পর্কিত ভাবনাগুলোকেও বিবেচনায় রেখেছি।
লেখাটিতে সার্ভের তথ্যে উল্লেখ আছে কত শতাংশ ‘নারী’ ফ্যাশন বা চলাফেরার স্বাধীনতার জন্য হিজাব/বোরখা পরে।
আপাতভাবে গড়মিল চোখে না পড়লেও ব্যাপারটা তো সমাজের সকল ক্যাটাগরির নারীদের জন্য সত্য না। বোরখা/হিজাব যেহেতু মুসলিম আইডেন্টিটির সিম্বল হিসেবে সমাজে আছে, ফলে মুসলিম আইডেন্টিটি ধারণ করা নারীদের বিশাল একটা অংশই বোরখা পরে, এবং সেই সমস্ত ‘মুসলিম নারী’ যারা বোরখা পরেন, তাদের ৮১ বা অত শতাংশের মতামত বললে ঠিক হতো।
আর প্রতিটা সার্ভেতে যারা বোরখা/হিজাব পরে তারা কীভাবে ধর্ম পালন করেন, প্র্যাক্টিসিং কিনা, সেটা কি লিপিবদ্ধ করা হয়েছিল?
ফলে আমার মনে হয়, সার্ভেতে যেখানে শুধুমাত্র ‘নারী’ উল্লেখ করা হয়েছে সেখানে ‘মুসলিম নারী’ উল্লেখ করা অধিকতর সঙ্গত।
আর যদিও সার্ভেতে উল্লেখ নাই বা হয়তো করাও হয় নাই যে, অন্য কম্যুনিটির নারীরা হিজাব/বোরখাকে কেন ফ্যাশনের অংশ হিসেবে ব্যবহার করে না, এর কারণ কী? একই দেশে একই সামাজিক পরিস্থিতিতে থেকেও কেন এই পার্থক্য? বোরখা যদি সকল নারীদের কমন “চয়েস” বা “বিকল্প” হতো, তাহলে মুসলিম ছাড়াও অন্য নারীরাও সাধারণভাবে হিজাব/বোরখা ব্যবহার করতেন; শাড়ি, সালোয়ার-কামিজ বা ওয়েস্টার্ন ধাঁচের ড্রেসের বেলায় কিন্তু এরকমটা ঘটতে দেখবেন না।
সে কারণে সার্ভেতে যারা বলছেন, এটা আমার ইচ্ছা বা চয়েস, সেটাকে দেশের সব ক্যাটাগরির নারীদের সাধারণ ইচ্ছা/চয়েস হিসেবে বিশ্লেষণ করে দেখানোটা ঠিক মনে হয় না, কেননা এই নারীদের ‘ইচ্ছা’টা শেইপ নিয়েছে তাদের মুসলিম ধর্মীয় আইডেন্টিটির অধীনেই, মুসলমান হওয়ার কারণেই। ভারতের সামাজিক-সাংস্কৃতিক-অর্থনৈতিক অবস্থাটাও অনেকটা আমাদের মতো, আমাদের মতই ওদেশের নারীরাও রাস্তাঘাটে হেনস্থার শিকার হন। তাহলে বোরখাটা সেখানের অল্প কিছু মুসলমান নারী ব্যতীত সকল নারীদের ‘চয়েস’ হয়ে উঠলো না কেন? শাড়ি, সালোয়ার-কামিজ কেন সাধারণভাবে দু’দেশের নারীদেরই ‘কমন চয়েস’? ফলে বোরখা চয়েস হওয়ার ব্যাপারে ধর্ম একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
আবার হিজাব (মানে মাথায় যেটা বাঁধে), নেকাব (মুখ আচ্ছাদনি) বা বোরখা এর মধ্যেও ফারাক আছে, ব্যবহারকারীর মধ্যেও ফারাক আছে।
আমার দেখা মতে যারা বোরখা পরেন, মূলতঃ নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত, এবং এনাদের বেশিরভাগ কাজ/চাকরি বা প্রফেশনের সাথে যুক্ত। কাজের কারণে এঁদেরকে ঘরের বাইরে যেতে হয় এবং হাঁটা/রিক্সা/গণপরিবহন ব্যবহার করতে হয়। রাস্তা-ঘাটে ইভটিজিং বা এইসব হেনস্থা থেকে রক্ষা পেতে বোরখা এক ধরনের সুরক্ষা এঁদেরকে দেয়।
অন্যদিকে উচ্চবিত্তের নারী বা মধ্যবিত্তেরও অনেকেই যারা বাইরের কাজের সাথে তেমন যুক্ত না, ‘হাউজ ওয়াইফ’ বা কলেজ-ইউনিতে লেখাপড়া করছে এমন তরুণী; মূলতঃ এঁরাই নানান ধরনের ও রঙের হিজাব ব্যবহার করেন, সাথে নানান অলংকারও। এঁরাই আসলে ফ্যাশন হিসেবে হিজাব ব্যবহার করেন, সামাজিক মাধ্যম বা অন্যত্র সেটার সত্যতা হাতেনাতে প্রমাণও দেন, ধর্মে নিষিদ্ধ ফটোগ্রাফির মাধ্যমে।
নেকাব বা মুখ ঢাকা বোরখা যারা পরেন, এরা ধর্মীয় নির্দেশিত কারণে পরেন, পর্দা প্রথার অংশ হিসেবে, ফ্যাশন-ট্যাশন হিসেবে অতটা না, তারা ব্যক্তিগত এবং পারিবারিকভাবে রক্ষণশীল, মোটামুটি প্র্যাক্টিসিং মুসলমান।
অনেকেরই সৌদির ঢিলেঢালা, মুখঢাকা নেকাব সহকারে বোরখা পরতে ভালো লাগে না, কিন্তু দুবাইয়ের বোরখা ভালো লাগে। কেননা তার মেইকিং বা পরার ধরন যত না বোরখা, তার চেয়েও বেশি স্টাইল। দুবাইয়ের বোরখায় চুলের কিছু অংশসহ মুখ খোলা রাখা যায়, আঁটোসাঁটো, সামনের নিচের দিকটা আটকানো ছাড়া খোলাও রাখা যায় এবং বোরখার বাহার দেখানোর পাশাপাশি নিচের বাহারি পোশাকও ইচ্ছে করলে দেখানো যায়। আসলে এই বোরখা, বোরখার চেয়েও অনেকটা ভেতরের ড্রেসের আভরণ। এছাড়াও নানান দেশের মুসলিম নারীরা নানা ভ্যারিয়েশনের বোরখা/হিজাব পরিধান করেন। এভাবে ইসলাম ধর্মীয় আইডেন্টিটির অধীনেই বোরখা ব্যবহারের কনসেপ্ট ও বোরখার ধরনেরও নানান তারতম্য আছে।
আমার মনে হয় না, আমি উপরে যেরকম বলেছি, নিবন্ধে উল্লিখিত সার্ভেগুলোতে এরকম ক্যাটাগরিক্যালি নানা তথ্য সংগ্রহ ও সেইসব তথ্যের বিশ্লেষণ করা হয়েছে। ফলে ধারাবাহিক ক্রিটিক্যাল প্রশ্ন না করে শুধুমাত্র ভাসা ভাসা প্রশ্ন করে সবটুকু বোঝা যাবে না, আসল সত্যটুকুও বেরিয়ে আসবে না।
অন্যদিকে বোরখার ব্যবহার কেন বাড়লো, সেটা নিয়ে পারুল যদিও অনেকটুকুই লিখেছেন, তবুও আমার মনে হচ্ছে এতে আরও কিছু বিষয় উল্লেখ করলে ভালো হতো।
মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে বোরখা/হিজাবের ব্যবহারটা কমবেশি আগে থেকেই ছিল। কিন্তু গত ৫০ বছরে বোরখার ব্যবহার তাৎপর্যপূর্ণভাবে বেড়েছে প্রধানত চারটা দেশে। ইরান, আফগানিস্তান, পাকিস্তান, বাংলাদেশে। এর মধ্যে ইরান, আফগানিস্তানে তো সরাসরি ইসলামি শাসনের কারণে। পাকিস্তান রাষ্ট্র দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে মুসলিম আইডেন্টিটি নিয়েই জন্ম নিয়েছিল, পরবর্তীতে দেশটি সমাজে-রাজনীতিতে এই ধর্মীয় আইডেন্টিটি বাড়িয়েই গেছে, এটা আরও বেড়েছে মার্কিন মদদে আফগান যুদ্ধকে নিজেদের ঘরের ভেতর টেনে আনাতে।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বোরখার প্রচলনটা ব্যাপক হওয়ার কথা ছিল না, যদি মুক্তিযুদ্ধের পর পর যাত্রাটা ঠিকভাবে হতো। বোরকার ক্রমবাড়তি ব্যবহার প্রধানত শুরু হয়েছিল নব্বইয়ের দশকে, আমার মতে, প্রবাসী পরিবারদের হাত ধরে, আর পরবর্তীতে বুস্ট আপ হয় দেশীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে।
৯০’র দশকে যে প্রবাসীরা মধ্যপ্রাচ্যে গিয়েছিল, তারা শুধু টাকা-পয়সাই নিয়ে আসেনি, সেইসব দেশের, মানে মধ্যপ্রাচ্যের, প্রধানত সৌদি কালচার, আদব-লেহাজ নিয়েও ফিরেছে। প্রতিটি প্রবাসী পুরুষ প্রতিবার ছুটিতে দেশে আসার সময় বাড়ির মেয়েদের জন্য বোরখা, অন্যদের জন্য জায়নামাজ, তসবিহ নিয়ে ফিরেছে। এই প্রবাসীদের সংখ্যা কিন্তু কম না, শুরু থেকে হিসেব করলে আজ পর্যন্ত কয়েক কোটি মানুষ মধ্যপ্রাচ্যের দেশে গিয়েছেন। আর পরিবারের শক্তিশালী অর্থের যোগানদাতাও যেহেতু এই প্রবাসী নারী-পুরুষ, ফলে ইচ্ছে থাকুক বা নাই থাকুক, গুষ্টিসহ মা-খালা- ফুপু-বউ-বোন- ভাবী-মেয়ে-শালী-শ্বাশুড়ি বোরখা/হিজাব পরেছে।
এর পাশাপাশি যোগ করুন, পেট্রোডলারে মসজিদ-মাদ্রাসা-ইসলামিক এনজিও গড়ে ওঠা, ওয়াহাবিজমের প্রচার প্রসার, আর জামাতী ইসলামের ক্রমেই নতুনভাবে সংগঠিত হওয়া।
ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও দুটো ঘটনা ঘটে যায়, সেগুলোর প্রভাবও পড়ে – ইরানে ইসলামী বিপ্লব এবং আফগানিস্তানে সোভিয়েত আগ্রাসন ও এর প্রতিরোধে ক্রমেই তালিবানের সৃজন। আর এর পর থেকে তো মধ্যপ্রাচ্যে একের পর এক দুন্ধুমার কান্ড। সেসবের আছর বাংলাদেশেও যেমন পড়েছে, দুনিয়ার দেশেদেশেও পড়েছে। এগুলোর সম্মিলিত ফলাফলই বোরখা/হিজাব।
এখন বোরখা বা হিজাব প্রগতিশীল, না প্রতিক্রিয়াশীল এটা তো এককথায় বলা চলে না। কন্টেক্সটের বিবেচনায় প্রাসঙ্গিকতা না থাকলে এক সময়ের প্রগতিশীলতা অন্য সময়ে প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে যেতে পারে, বা আজ যিনি প্রগতিশীল আছেন, নিজের ক্রম অগ্রগতি করতে না পারলে তিনিই অন্যসময় প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে দাঁড়াবেন।
একসময় ঠাকুর বাড়ির মেয়েরা ঘরের বাইরে বের হওয়ার প্রয়োজন থেকে ব্লাউজ-পেটিকোটসহ শাড়ি পরবার সাবেকি ধরন পাল্টে নতুন স্টাইল/ফ্যাশন বের করেছিলেন। সময়ের প্রয়োজনে সেটা লাগসই বা কাজের ছিল, ওটা এগুনোই ছিল।
এখন যারা শুধুমাত্র ধর্ম নির্দেশিত পর্দাপ্রথার জন্য নয়, বরং হেনস্থা এড়াতে, গণ পরিবহনে চড়তে, কাজের নানা প্রয়োজনে, স্কুল-কলেজে যাওয়ার জন্য বোরখাকে নতুনভাবে বা সৃজনশীল ব্যবহার করছেন, সেটা তো অবশ্যই অভিনন্দন যোগ্য।
কিন্তু যারা মাথায় বাহারি বোঝা চাপিয়ে সমাজের ও নিজের মনন-মগজেও আরও বোঝা বাড়াচ্ছেন, তাদেরকে আমার পক্ষ থেকে অতটা অভিনন্দন জানাতে পারছি না।
##
আরেকটা বিষয় পারুল বা অন্যরা প্রায়ই বলে থাকেন, সেটা হলো, নারীবাদীরা বা প্রগতিশীলরা বিকিনি পরাটা মানতে পারলেও বোরখা পরাটা মানতে পারেন না।
নারীবাদী বা প্রগতিশীলরা এরকম যুক্তি করেন কিনা আমি জানি না বা দেখিনি। এটা পারুল বা অন্যান্য ধর্মবাদীদের ইচ্ছা বা অনিচ্ছাকৃত ভুল উপস্থাপন অথবা লজিক্যাল ফ্যালাসির কৌশলী ব্যবহার।
বোরখা বা বিকিনি তো এক জিনিস না। বোরখা সারা দুনিয়ার মুসলিম নারীদের জন্য ধর্মীয়ভাবে বাধ্যতামূলক পোশাক আর কোনো কোনো ইসলামিক ও মুসলমান প্রধান দেশে ধর্মীয় ও সামাজিক বাধ্যতার পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় আইনের বাধ্যতাও আছে। বিকিনি পরা বা না পরা নিয়ে সামজিক-সাংস্কৃতিক এক ধরনের অবস্থান পশ্চিমা সমাজে থাকলেও রাষ্ট্রীয় আইনের বাধ্যকতা আছে কি? আমাদের দেশে বোরখা না পরলে রাস্তাঘাটে, অফিস-আদালতে, ওয়াজ মাহফিলে নারীরা যে ধরনের কটুক্তি ও হেনস্থার সম্মুখীন হন, বিকিনি না পরলে পশ্চিমের সেসব দেশে কি নারী সামাজিকভাবে অপদস্থ হবেন? খুবই সম্ভব যে, আপনি কী পোশাক পরেছেন – বিকিনি, না বোরখা, সেটা নিয়ে কেউই মাথা ঘামাবে না, অযাচিত দৃষ্টিও দেবে না।
বোরখা হলো মুসলিম নারীর জন্য সার্বক্ষণিক পোশাক, দুয়ারের বাইরে বের হলেই নারীর জন্য সেটা বাধ্যতামূলক। বিকিনি কি সেরকম? সমুদ্র-নদী সৈকত বাদে পশ্চিমা দেশে সাধারণভাবে যত্র-তত্র বিকিনি পরা কাউকে দেখা যায় কি? ফলে বোরখা আর বিকিনির তুলনাটা কেন আসে, কেন আনা হয়? আনা হয়, আমার মতে, লজিক্যাল ফ্যালাসি করতে, পুরুষতান্ত্রিক ধর্মীয় ইগোকে সন্তুষ্ট করতে। আর বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিকিনির কথাইবা হুট করে আসে কোত্থেকে? আজ পর্যন্ত দেশের ভেতরে আমাদের কোন মেয়ে কি বিকিনি পরেছে? তুলনা করতে চাইলে আপনি শাড়ি, সালোয়ার-কামিজের কথা বলতে পারেন। বিকিনির কথা বলা অনেকটা যেনতেনভাবে দেশের পুরুষকূলকে যৌন সুড়সুড়ি দেয়া।
আবার অন্যদিক থেকে ভাবুন, আমাদের দেশে বা যে কোনো দেশে চাইলে আপনি বিকিনি না পরার জন্য কথা বলতে পারবেন, প্রচারনা করতে পারবেন। আপনি বাধার সম্মুখীন হবেন না, বড় জোর টিটকারির মুখে পড়তে পারেন। বোরখার ব্যাপারে একবার ভাবুন তো। বোরখা পরার জন্য যেসব জায়গায় নসিহত করা হয়, খোদ পাঠ্যপুস্তক, মিডিয়াসহ যেখান থেকে নসিহত আসে, সেসব জায়গায় আপনি বোরখা “না পরা”র কথা বলতে পারবেন, দেশ জুড়ে, ওয়াজে-সভায়, মিডিয়ায় প্রচার করতে পারবেন? জানটা-প্রাণটা থাকবে তো? একপক্ষীয় বিখ্যাত অনুভূতি আহত-নিহত হয়ে, চৌদ্দ শিকের ভেতর জীবনটা অতিবাহিত হবে কিনা, সেটাও একটু ভেবে দেখবেন।
ফলে বোরখা বা বিকিনি পরা ও তারপক্ষে কথা বলে যদি ‘নারীর এজেন্সি’ হয়, বোরখা ও বিকিনি না পরাটাও ‘নারীর এজেন্সি’, না পরার পক্ষে বাধাহীন কথা বলা, প্রচারণা করতে পারা, সমাজে সেই পরিবেশ থাকাটাও ‘নারীর এজেন্সি’।
###
বোরখা পরে যিনি বাইরে বেরিয়েছেন, কাজে যাচ্ছেন, চলার পথে যদি উনারা বাস্তবে বুঝতে পারেন সামনে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে বাধাটা কী বা কোথায়। যদি তাদেরই কেউ কেউ নিজের জন্য, সন্তানের জন্য, পরিবারের জন্য বাধা সরাতে উঠে দাঁড়ান, বোরকা/হিজাব নিয়েই দাঁড়াক, তবুও লড়ালড়ির সাথে, নিজ অধিকারের সংগ্রামে যুক্ত হোক। আর লড়তে যেয়ে হয়তো বুঝতেও পারবেন, একটি যৌনসন্ত্রাসহীন মর্যাদাপূর্ণ জীবন অথবা নিজের অধিকার, নারীর অধিকার, সন্তান ও সম্পত্তিতে উত্তরাধিকার পাওয়ার জন্য, নিদেনপক্ষে হেনস্থাহীন রাস্তায় চলা ও কাজের পরিবেশ পেতেও সামনের বাধাগুলো কী। এই বোধগুলো যদি না আসে, তাহলে বোরখার আবরণ দিয়ে হয়তো কিছুদিন পথের হেনস্থাকে ঠেকিয়ে রাখবেন, কিন্তু পুরো জীবনকে পাঁকে ডুবিয়ে রাখবেন।
জীবনের বাধা সরাতে শুরুতে কেউ কেউ বোরখা/হিজাব নিয়েই, মানে ধর্মীয় আইডেন্টি নিয়েই হয়তো নামবেন, এক্ষেত্রে আঁকড়ে ধরতে চাইবেন ধর্মের লিবারেল ব্যাখ্যাকে এবং একটা পর্যায় পর্যন্ত এটা সহায়কও হয়তো হবে।
কিন্তু খেয়াল করলে এদের অনেকেই দেখবেন, ধর্মের উদার বা লিবারেল অবস্থাও আজকের সমাজে, নারীর জীবনের প্রয়োজন ও দাবি মেটাতে পারছে না, একসময়ের আইডেন্টিটিই আজ পায়ের বেড়ি, মাথার বোঝা হয়ে যাচ্ছে। সেটা যারা বুঝবেন না, এই বোধটা যাদের আসবে না, সেই ক্ষেত্রে আজকের বোরখা হবে তাঁদের জন্য একেকটা ব্যক্তিগত কারগার; মাথার হিজাব, তাঁদের মাথার বোঝা হয়েই থাকবে। এক সময়ের সুবিধা, অন্য সময় গলার কাঁটা হয়ে বিষম বিঁধবে।
আশা করি, একসময় নতুন উপলব্ধির এই নারীরা প্রয়োজনে এগুলোকেও ছিন্ন করবেন, ঝেড়ে ফেলবেন। চিন্তা-চেতনায়, মানবিক মর্যাদায় মাথা উঁচু করে দাঁড়াবেন।