সমস্যাটা কি নারীর বিনোদনেই?

নাহিদ শামস্ ইমু: প্রত্যেকটা মানুষের বিনোদনের কিছু না কিছু মাধ্যম থাকে, থাকে এমন কিছু উপকরণ যা অবসর সময়ে তার জন্য আনন্দের খোরাক যোগায়। হোক সেটা বই, টিভি, কম্পিউটার, ফেসবুক, গান, প্রিয় কোন শখ বা অন্য কিছু। কে কোন ধরণের বিনোদন গ্রহন করবে তা নির্ভর করে তার সোশিও-ইকোনমিক ব্যাকগ্রাউন্ড, জীবন-অভিজ্ঞতা, বিনোদনের প্রাপ্যতা, ব্যক্তিত্ব, রুচি, শিক্ষা প্রভৃতির ওপর।

আমি গৃহিণীদের কথা বলছি। বাংলার একজন সাধারণ নারীর কথা বলছি। বাংলার গৃহিণীদের পৃথিবীটা সেই আবহমান কাল থেকেই চার দেয়ালের ভেতরে বন্দি। গৃহবধুদের জীবনের গল্পটি আবৃত থাকে রন্ধনে, ক্রন্দনে, আর পারিবারিক বন্ধনে। তাদেরও অধিকার আছে বিনোদনের। সমাজ তাদের ব্যক্তিত্বটি যেভাবে গড়ে দিয়েছে তার সঙ্গে মানানসই বিনোদনই তারা অধিক পছন্দ করবে।

বউ-শাশুড়ির চিরায়ত যুদ্ধ, সম্পর্কের টানা-পোড়েন, পারিবারিক জটিলতা-কুটিলতাকে ঘিরে নির্মিত ভারতীয় টিভি সিরিয়ালগুলো তাই বাংলার নারী সমাজের কাছে ভীষণ জনপ্রিয়। জি বাংলা, স্টার জলসা তাই নারীদের বিনোদনের মাধ্যম।

এই তো কিছুদিন আগেই রব উঠেছিলো জি বাংলা, স্টার জলসা চ্যানেলগুলো বন্ধ করে দেয়ার জন্য। সেসব শুনে সোশ্যাল মিডিয়া পাড়া মোটামুটি উল্লসিত ছিলো। এখনও অবশ্য সুযোগ পেলে অনেকেই এই দাবি তুলে ফেলেন। ক’দিন আগে বহুল আলোচিত ভারতীয়-বাংলা সিরিয়াল ‘কিরণমালা’ শেষ হয়েছে। কিরণমালা শেষ হবার খবরে পুরুষের আড্ডায় এক অন্যরকম উৎসবের আমেজ। পারলে কাচ্চি বিরিয়ানি খাইয়ে এ আনন্দ ভাগাভাগি করে নেয়- এই দশা। পেজে পেজে ট্রল-তামাশা, ঠাট্টা, রসিকতা।

এই যে আমরা তরুণ। আমার মতো তরুণদেরও অবসরে বিনোদন লাগে। সেজন্য আমরা মুভি দেখি, দেখি ইংলিশ কিংবা কোরিয়ান সিরিয়ালও। আমাদের বিনোদন মানেই অ্যাভেঞ্জারস, অ্যাভাটার, ম্যান অফ স্টিল, এক্স-মেন, ক্যাপ্টেইন অ্যামেরিকা, সুইসাড স্কোয়াড ইত্যাদি। সিরিয়ালের তালিকায় আছে ব্রেকিং ব্যাড, শার্লক, গেম অফ থ্রোনস, ওয়াকিং ডেড প্রভৃতি। তো আমাদের বিনোদন মাধ্যম যাই হোক, যত লম্বাই হোক; তবু দেশের লক্ষাধিক কিশোরী-তরুণী-মা-শাশুড়িদেরকে আমরা ‘বোঝেনা সে বোঝেনা’, ‘রাগে অনুরাগে’, ‘কিরণমালা- নামক সিরিয়ালগুলো দেখতে দেবো না! এক কাজ করা যেতে পারে। এখন থেকে মা-শাশুড়ি-দাদি-নানিদেরকে নিয়ে ‘সুইসাইড স্কোয়াড’ দেখা যেতে পারে! কী বলেন? মা-দাদীরা বরং ‘হারলে কুইন’ সেজে বসে থাকুন। বখাট্য যুক্তি নয় কী?

ধরুন এখন যদি বলা হয় বাংলাদেশে আর কোন বিদেশী চলচ্চিত্র প্রবেশ করবে না, স্টার সিনেপ্লেক্সে মুক্তি পাবে না কোনো ইংরেজী ছবি, সকল ইংরেজী ছবির ডিভিডি বাজেয়াপ্ত করা হবে, সমস্ত টোরেন্ট সাইট বন্ধ করে দেয়া হবে- তাহলে কেমন লাগবে? এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে লাঠি-সোটা নিয়ে তরুণ প্রজন্ম যে আন্দোলনে নামবে, তা বলাই বাহুল্য।

যদি তাই হয়ে থাকে, তাহলে জি বাংলা, স্টার জলসা বন্ধ করা লজিক্যাল হতো/হবে কোন যুক্তিতে? এসব কথা বললেই সামনে চলে আসে আরেকটি জনপ্রিয় যুক্তি। সেটি হলো ‘ভারতীয় আগ্রাসন’। মানে জি বাংলা, স্টার জলসা হচ্ছে এ দেশের সংস্কৃতির ওপর একটি ভারতীয় আগ্রাসন। তো যারা এই থিওরি দিচ্ছেন, খোঁজ নিলে দেখা যাবে এরাই আবার কেউ কেউ শাহরুখ খানের ফ্যান, কেউ সালমান খানের ফ্যান, আবার কেউ আমির খানের! এরাই আবার বন্ধুদের নিয়ে ‘ধুম-৩’, ‘আশিকি-২’, ‘হেট স্টোরি-২’, ধোনি: আনটোল্ড স্টোরি’ ইত্যাদি দেখতে বসেন। ডিভিডি’র দোকানে ঢুঁ মেরে জিজ্ঞেস করেন- ‘ভাই, সালমান খানের ‘কিক’ মুভ্যিটা কি আসছে?’ ফেসবুকে বসে হিন্দি সংস্কৃতির সমালোচনা করেন, কিন্তু মুখে ‘তু হি ইয়ে মুঝকো বাতা দে, চাহু ম্যায় ইয়া না…’ কিংবা ‘ধিনকা চিকা ধিনকা চিকা’ গাইতে গাইতে গলা বসিয়ে ফেলেন।

রাত বিরেতে উচ্চশব্দে হিন্দি গান বাজানোটা সাংস্কৃতিক আগ্রাসন নয়, কেবল জি বাংলা-স্টার জলসাই সাংস্কৃতিক আগ্রাসন। তাই তো?

ঈদের বাজারে ললনাদের আকৃষ্ট করবার জন্য প্রায়ই ভারতীয় বিভিন্ন সিরিয়ালের চরিত্রগুলোর নামানুসারে বিভিন্ন পোশাক বিক্রি হয়। এই যেমন- ‘পাখি’, ‘কিরণমালা’ ইত্যাদি। ললনারাও সে সব পোশাক কিনতে আগ্রহী। এসব নিয়ে অবশ্য ছেলেদের ঠাট্টা-বিদ্রুপ, ট্রল-তামাশার অন্ত নেই। মেয়েরা ‘কিরণমালা’, ‘পাখি’ ড্রেস কিনছে বলে সমাজটা উচ্ছন্নে গেছে, তাই না। ২০০৮ সালের একটা ঘটনা মনে পড়ছে।

রাস্তায় দেখলাম একটা ছেলের মাথা ‘প্রায়’ ন্যাড়া করে কাটা, এবং কপালের বাম পাশ থেকে মাথার পেছন পর্যন্ত লম্বা একটা কাটা দাগ। ভাবলাম, আহারে! নিশ্চই কোনো অ্যাক্সিডেন্টে মাথাটা ফেটে গেছিলো! কিন্তু এরপর আরো অনেক ছেলের মাথারই দেখলাম একই দশা। তখন বুঝতে পারলাম, এদের কারোরই মাথা ফাটে নি। এটা স্রেফ একটা স্টাইল! কিন্তু কেন? এই প্রশ্নের উত্তরটা জানতে পারলাম আমির খানের ‘গজনি’ মুভ্যিটা দেখার পরে। ছবিতে আমির খানকে ভারী অস্ত্র দিয়ে সজোরে আঘাত করা হয়, সেই আঘাতের দাগটাই মাথায় ওভাবে চিরস্থায়ীভাবে থেকে গিয়েছিলো। এরপর থেকে আমির খান প্রতি পনেরো মিনিট পরপর সবকিছু ভুলে যেতেন, যাকে বলে ‘শর্ট টার্ম মেমোরি লস।’ তো আমির খানের সেই চুলের কাটটাই এ দেশের তরুণরা কপি করেছিলো। তাই এরপর থেকে রাস্তায় এই ধরনের চুলের ছাঁট দেয়া কোন ছেলেকে দেখলেই আমার মনে হতো- ‘আহারে বেচারা! শর্ট টার্ম মেমোরি লস!’ :p

তরুণ প্রজন্মের একটা বড় অংশ জিমে গিয়ে শরীর বানায়। এবং এদের অধিকাংশেরই গুরু হচ্ছেন সালমান খান! আজকে রাস্তায় বেরুলে শত শত ছেলে দেখতে পাওয়া যায়, যাদের গায়ে শোভা পাচ্ছে সুপারম্যান, ব্যাটম্যান, ক্যাপ্টেইন আমেরিকা, স্পাইডারম্যান, এক্সম্যান, গ্রীন ল্যান্টার্ন-এর লোগো সম্বলিত টিশার্ট! আমির খানের মত চুলের ছাঁট দিলে কিংবা সালমান খানের মত বডি বানাতে জিমে গিয়ে টাকা-পয়সা ঢাললে, বিভিন্ন সিনেমা দেখে তালি দেয়া-ছেঁড়া-ফাঁটা জিন্স পরলে, সুপারম্যান-ব্যাটম্যান-স্পাইডারম্যানের টিশার্ট পরলে কোনো অসুবিধে নেই!

শুধু মেয়েরা ‘বোঝে না সে বোঝে না’ দেখে পাখি ড্রেস কিংবা ‘কিরণমালা’ সিরিয়াল দেখে কিরণমালা ড্রেস কিনতে চাইলে আমাদের একটু চুলকানি ওঠে। এই ডাবল স্ট্যান্ডার্ড কিসের জন্য?

ফালতু যুক্তির সাপ্লাই যেহেতু আনলিমিটেড, সেহেতু এরপরই তারা যুক্তি দেখাবেন- “সিরিয়াল দেখতে হলে বাংলাদেশের নাটক দেখুক’। প্রথমতঃ বাংলাদেশের নাটকের বর্তমান অবস্থা যে আপনি জানেন না, তা নয়। আপনি জানেন তা খুব ভালো করেই। বাংলাদেশী নাটকে কোন ট্র্যাজেডি নেই, কোন গতিময়তা নেই। বাংলাদেশের নাটক মানেই এখন ভাঁড়ামি, সুড়সুড়ি দিয়ে হাসাবার প্রাণান্তকর চেষ্টা। এ দেশের নাটকের কাহিনী থেকে গতিময়তা হারিয়ে গছে, ঘটনার ঘনঘটা হারিয়ে গেছে, ক্লাইমেক্স বিলুপ্ত হয়ে গেছে। সংলাপগুলো যাচ্ছেতাই। সবচেয়ে ভয়ানক অবস্থাটি অভিনয়শৈলীর।

দু’একটি বিজ্ঞাপনচিত্রে রং-ঢং করে, বিশখানা বিলবোর্ডে চেহারা-ছবি দেখিয়ে একেকজন পাতি-খাতি মডেল অভিনয়ে নাম লিখিয়ে ফেলেছে। স্বল্পসংখ্যক অভিনয়শিল্পীকে বাদ দিলে বেশিরভাগের অবস্থাই করুণ। এরা টিভি ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে যেটি করে চলেছে- সেটি আসলে অভিনয় নয়,ন্যাকামি; এই সহজ কথাটি এদেরকে কে বোঝাবে? এদের অভিনয় দেখলে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে না, কাহিনীতে আকৃষ্ট করবার মত কিছু নেই, স্ক্রিপ্ট শুনলে হামি আসে! লেবু বেশি চিপলে যেমন তেতো লাগে, ঠিক তেমনি মোশাররফ করিমের মত ভালো অভিনেতাকে দিয়ে গড়পড়তা মানের শত শত নাটক করিয়ে তেতো বানিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়েছে।

আমাদের গৃহিণীরা, মায়েরা, মেয়েরা কেন ভারতীয় সিরিয়াল দেখতে বসেন- এ প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে আপনাকে একটি টিপিক্যাল বাংলাদেশী নাটক এবং একটি ভারতীয়-বাংলা নাটক দেখতে বসতে হবে, তুলনা করতে হবে। প্রথমেই চোখে পড়বে সময়ানুবর্তিতার বিষয়টি। দেখা যাবে, বাংলাদেশী নাটকটি ১০টায় শুরু হবার কথা বলে গাদা গাদা বিজ্ঞাপন দেখিয়ে শুরু করেছে সোয়া দশটায়। কিন্তু ভারতীয়-বাংলা নাটকটি এক্কেবারে ঘড়ির কাঁটায় কাঁটায় যখন ১০টা বাজবে, তখনই শুরু হয়েছে।

বাংলাদেশী নাটকটি ৫ মিনিট দেখিয়ে ১০ মিনিট বিজ্ঞাপন দেবে। অপরদিকে ভারতীয়-বাংলা নাটকটি ১০ মিনিট দেখিয়ে ৫ মিনিট বিজ্ঞাপন দেবে! এ দেশীয় নাটকটি আধা ঘন্টার নাটক দেখাতে দেড় ঘন্টা লাগিয়ে দেবে, কিন্তু ভারতীয় নাটকটি নির্ধারিত সময়েই শেষ হয়ে যাবে। তারপরই কোনো বিরতি না দিয়ে সময়মত শুরু করবে আরেকটি নাটক।

কেন আমাদের মা-বোনেরা ও দেশের এত শৃঙ্খলিত নাটক না দেখে কষ্ট করে বিজ্ঞাপনের ফাঁকে ফাঁকে দেশের নাটক দেখতে বসবেন, আমাকে একটু বুঝিয়ে বলবেন কি? তা বাংলাদেশী সংস্কৃতি নিয়ে আপনার যখন এতই দরদ, তাহলে বিদেশী চলচ্চিত্র ছেড়ে দিয়ে ওমর সানি, শাকিব খান বা অনন্ত জলিলের সিনেমা দেখতে বসুন না! পারবেন তো তা সহ্য করতে?

বিনোদনের অধিকার সবারই। পুরুষের বিনোদন মাধ্যম নিয়ে কখনও নারী সমাজকে আন্দোলন করতে দেখেছেন? কখনও শুনেছেন ইএসপিএন, ডিসকভারি, এইচবিও- ইত্যাদি চ্যানেল বন্ধ করতে বাংলার গৃহিণীরা মানববন্ধন করেছেন? আপনার/আমার ভারতীয় বাংলা সিরিয়াল পছন্দ নাই হতে পারে। তাদেরও তো ‘শার্লক’, ‘ব্রেকিং ব্যাড’ ভালো লাগবে না! তাতে অসুবিধেটা কোথায়? সমাজটা সবারই। যার যা ভালো লাগছে, তাকে তাই নিয়েই থাকতে দেয়াটাই উত্তম নয় কি? নাকি সমস্যাটা কেবল নারীর বিনোদনে?

শেয়ার করুন: