জাহেদ-উর-রহমান: “এখানে আসলে বহুজন বহু কথা বলবে। স্কুলটা অপবিত্র হয়ে যাবে। তাই সে শুধু পরীক্ষার সময় পরীক্ষা দেবে।” একজন ধর্ষিতার পিতা, হরিধন চক্রবর্তী মেয়ের স্কুলে যাবার ব্যাপারে ওই স্কুলের হেডমাস্টার এর কাছে এই মন্তব্য শোনেন পাঁচ মাস আগে। কিন্তু না, ধর্ষিতা মেয়েটিকে সপ্তম শ্রেণীর ফাইনাল পরীক্ষায়ও বসতে দেয়া হয়নি – ‘স্কুল অপবিত্র’ হয়ে যাবে বলে কথা!
হ্যাঁ, এমন বর্বর একটা ঘটনা ঘটেছে আমাদেরই দেশের হবিগঞ্জে। আমি এই দেশের কোন মিডিয়ায় খবরটিকে গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করতে দেখিনি। বিবিসি বাংলা রেডিও এবং ওয়েবসাইট খুব গুরুত্ব দিয়ে খবরটি প্রকাশ করেছে (বিস্তারিত – http://www.bbc.com/bengali/news-38195396)।
না, এই খবরটা জানানোর উদ্দেশ্য এটা না যে, এই খবরের ওপর ভিত্তি করে ধর্ষিতার প্রতি আমাদের সমাজের নির্মমতা নিয়ে আমি আলোচনা করবো। আমি বরং আলোচনা করতে চাইছি এই ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির পেছনে প্রভাব ফেলা ভাষাগত একটা বিষয় নিয়ে।
ডিসেম্বর মাস এলো, ভেতরে স্বাধীনতার চেতনাহীন হলেও এই মাসে প্রতি বছরের মতো আমরা নিয়ম করে টিভিতে, পত্রিকায় মুক্তিযুদ্ধের আলোচনা করি, করছি এবারও। স্বাধীনতার ইতিহাসের কথা বলতে গিয়ে অনেককে বলতে শুনেছি, আমরাও অনেকে বলি – “ত্রিশ লাখ শহীদের রক্ত আর তিন লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রম/ইজ্জত এর বিনিময়ে” আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি। এখানে লক্ষ্যণীয় শব্দ হলো ‘সম্ভ্রম/ইজ্জত’।
যখন বেড়ে উঠছিলাম তখন ধর্ষণ শব্দটা পত্রিকা থেকে শিখেছিলাম। বন্ধুরা কেউ কেউ সিনেমা হলে বাংলা সিনেমা দেখে গল্প বলার সময় ধর্ষণের ঘটনা থাকলে সেটাকে বলতো ‘নষ্ট করা’। ধীরে ধীরে আবিষ্কার করলাম, আমাদের সমাজে মানুষ ধর্ষণকে একটা নিষিদ্ধ শব্দ হিসাবে ধরে নিয়েছে। তাই এই শব্দের ‘নেগেটিভিটি’ কমাতে তৈরি করেছে নানা ইউফেমিস্টিক শব্দ – সম্ভ্রমহানি হওয়া, শ্লীলতাহানি ঘটা, বেইজ্জতি হওয়া, ইজ্জত লুট হওয়া ইত্যাদি।
যেহেতু ইউফেমিস্টিক নয়, তাই ‘নষ্ট’ শব্দটা আপাতত বাদ দেই। বাঁকি শব্দগুলো এখনো আমাদের ‘ভদ্র/শিক্ষিত’সমাজে অনেক ব্যবহৃত হয়। তো ঐ শব্দগুলো ব্যবহার করার সময় আমরা কি ভেবে দেখি যে এই শব্দগুলো আদতে কেমন? এই শব্দগুলো ধর্ষণ নামক ভয়ানক অমানবিকতাকে কতোটা ‘শালীন’করেছে? ধর্ষিতাকে সমাজের চোখে কতোটা সন্মান দিয়েছে? নাকি এই শব্দগুলো আদতে ভয়ঙ্কর ‘নোংরা’?
ব্যক্তিগতভাবে আমি প্রায় সব ক্ষেত্রেই ইউফেমিজম বিরোধী মানুষ। (আমার খুব প্রিয় একজন ইন্টেলেকচুয়াল, স্ট্যান্ড-আপ কমেডিয়ান জর্জ কার্লিন ইউফেমিজমকে দারুণ যৌক্তিকভাবে কীভাবে তুলোধুনা করেছেন, আগ্রহীরা দেখতে পারেন – https://www.youtube.com/watch?v=qvISFZ7bQcE)। তবে অনেক ক্ষেত্রেই ভাষায় ওসব মারপ্যাঁচকে ছাড়ই দেই। কিন্তু ধর্ষণের ক্ষেত্রে আমার প্রথম প্রশ্ন হলো, এটার ইউফেমিস্টিক শব্দ লাগবে কেন? শব্দটা কি খুব কর্কশ? খুব নোংরা?
আমি তো বরং মনে করি, এটা হওয়াই তো ভাল। পৃথিবীর সবচাইতে ভয়ঙ্কর, নোংরা অপরাধগুলোর একটিকে প্রকাশকারী শব্দটির ভেতরেই তো ঐ কাজটির নোংরামি, ভয়ঙ্করতা প্রকাশিত হওয়া উচিত। আমার তো মনে হয় ‘ধর্ষণ’ এই উদ্দেশ্যকে দারুণভাবে পূর্ণ করে। তো আমরা ধর্ষণকে বোঝাতে অন্য শব্দ আমদানী করছি কেন? শব্দগুলো ক্ষতিকর না হলে না হয় গুরুত্ব নাই দিতাম; কিন্তু আমার বিবেচনায় এই শব্দগুলো ভীষণ রকম নোংরা এবং ভয়ঙ্কর ক্ষতিকর!
কিছুক্ষণ আগে বাদ দেয়া শব্দটি দিয়ে শুরু করি (শব্দটি যদিও তথাকথিত ইউফেমিস্টিক শব্দ নয়) – ‘নষ্ট হওয়া’। গ্রামাঞ্চলে এখনো শব্দটি ব্যবহৃত হয়। একজন নারী ধর্ষিত হলে তিনি ‘নষ্ট’ হয়ে যান! আর বাংলায় সম্ভ্রম, ইজ্জত আর শ্লীলতা শব্দগুলো প্রায় সমার্থক হিসাবে ব্যবহৃত হয়, যার মানে সন্মান বা মান-মর্যাদা। অর্থাৎ যিনি ধর্ষিত হন তাঁর সন্মান বা মান-মর্যাদার ‘হানি’ হয় বা ওসব ‘লুন্ঠিত’ হয়।
আমি বিশ্বাস করি এই অত্যন্ত অবমাননাকর শব্দগুলো আমাদের দেশে ধর্ষণজনিত আত্মহত্যা আর প্রচন্ড মানসিক বৈকল্যর জন্য অনেকাংশে দায়ী। একজন নারী বেড়ে ওঠার সময় কৈশোরে, তারুন্যের শুরুতে এই শব্দগুলো যখন শুনে থাকে তখন তার মধ্যে এই শব্দগুলো একটা ভীষন ভয়ঙ্কর ধারনা তৈরী করে দেয় না? আর গ্রামের মেয়েটিতো শোনে ধর্ষিত হওয়া মানে ‘নষ্ট’ হয়ে যাওয়া। শুধু নারী হবে কেন, সমাজের পুরুষ মানুষগুলোও ধর্ষিতাকে দেখে সম্ভ্রম/ইজ্জত/শ্লীলতা হারিয়ে ফেলা মানুষ হিসেবে।
এবার ধর্ষিতা নারীটির মনস্তত্ত্ব যদি খেয়াল করি তবে দেখা যাবে, ওই নারী ধর্ষণ পরবর্তী শারীরিক এবং মানসিক যন্ত্রনার সাথে ভুগতে থাকে সম্ভ্রম/ইজ্জত/শ্লীলতা হারিয়ে ফেলার গ্লানিতেও। তাই তার ওপর চাপিয়ে দেয়া ভয়ঙ্কর অপরাধটির পর কোথায় সে আমাদের সর্বোচ্চ সহানুভূতি, সহমর্মিতা পাবে, তা না, সে আমাদের কাছে ‘লজ্জায়’ মুখ দেখানোর সাহস পায় না। আজও অজস্র নারী এজন্য আত্মহত্যা করে। অনেকে সেটা না করলেও সম্ভ্রম/ইজ্জত/শ্লীলতা হারিয়ে ফেলার গ্লানিতে ভুগতে থাকে আজীবন।
শুধু তাই না, যেহেতু ধর্ষিত হওয়া মানে সম্ভ্রম/ইজ্জত/শ্লীলতা হারিয়ে ফেলার ব্যাপার, তাই এটা হয়ে গেলেও গোপন করে রাখতে হবে, আইনগত ব্যবস্থা নেয়া যাবে না – এমন একটা দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের সমাজ লালন করে যাচ্ছে দীর্ঘকাল থেকে। আর এতে তো ধর্ষণকারীর পোয়াবারো। তার ওপর ধর্ষনের ঘটনা জানাজানি হলে গ্রামাঞ্চলে এখনো ধর্ষিতাকে ধর্ষকের সাথে বিয়ে দেয়া হয় ‘ইজ্জত রক্ষা’ করার স্বার্থে। কী মর্মান্তিক!

আমাদের শব্দ ব্যবহার কোন বিষয়ের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় বহন করে নিঃসন্দেহে। ধর্ষনের ক্ষেত্রে আমাদের ওই শব্দগুলো ব্যবহার করা প্রকারান্তরে ধর্ষন এবং ধর্ষিতা সম্পর্কে আমাদের ভয়ংকর নির্মম মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ। যার মাশুল আমাদের ধর্ষিতা নারীরা দিয়ছে যুগ যুগ ধরে। শুরুতে উল্লেখ করা হবিগঞ্জের ধর্ষিতা কিশোরীটিও দিয়েছে ঠিক এই মানসিকতার মাশুল। আর শুধু এই কারনেই মানুষের প্রতি সবচাইতে ভয়ংকর একটা অপরাধের একটি করেও ধর্ষক পার পেয়ে যায়, এবং সাহস পায় বার বার ঐ অপরাধ করার।
প্রশ্ন হলো, শব্দের পরিবর্তন কি ধর্ষণ সম্পর্কে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি আমূল পালটে দেবে? দেবে না, কিন্তু আমি বিশ্বাস করি এটা পরিবর্তনের পথে সাহায্য করবে। নারীরা জানুক কেউ যদি কখনো ধর্ষিত হয়েই যায়, তাতে তার গ্লানির কিছু নেই, তার জন্য মরতে তো হবেই না, বরং মানসিক বৈকল্যে ভোগারও কিছু নেই। আমাদের উচিৎ হবে ধর্ষিতাকে সব রকম সহানুভূতি, সহমর্মিতা দেখিয়ে এমন পরিবেশ তৈরি করা যেন আর কোনদিন কোন নারী বা তার পরিবার ধর্ষনের ঘটনা চেপে না যায়, প্রতিবাদী হয়, আইনের আশ্রয় নেয়।
তাই আসুন, সবক্ষেত্রেই বর্জন করি ‘নোংরা’ সব ইউফেমিস্টিক শব্দ; ধর্ষণকে ধর্ষণ-ই বলি।