ফওজিয়া খোন্দকার: নারীবাদকে নিয়ে এতো ভুল ব্যাখ্যা ও বিভ্রান্তির কারণে খুব হতাশ হয়ে পড়ি। নারীবাদ নিয়ে আমাদের এতো ভয় কেন? কেনই বা নারীবাদীদের গালাগাল দেয়া?
সেই কিশোরীবেলা থেকে শুনে আসছি যে নারীবাদীরা ভালো না। কেন ভালো না? তা ভালো না জানলেও এটা বলা খুব সহজ যে, তারা ভালো না। এমনকি নারী অধিকার এর জন্য যারা কাজ করছেন, তাদের মধ্যেও বিভাজন রয়েছে। অনেকেই নিজেদের নারীবাদী হিসেবে পরিচয় দিতে আগ্রহী নয়। এমনকি অনেক প্রথম সারির নেত্রীও নিজেকে নারীবাদী বলেন না, অথবা বলতে সাচ্ছন্দবোধ করেন না। কে নিজকে নারীবাদী বলবেন বা বলবেন না এটা অবশ্যই তাঁর নিজস্ব বিষয়। এটা আমার মাথা ব্যথার কারণ নয়।
অনেকে আবার বলেন, কেন নারীবাদী? আমি মানবতাবাদে বিশ্বাসী, কেউ বলেন, এটি পশ্চিমের দেশ থেকে আগত, কেউ বলেন নারীবাদীরা পুরুষবিদ্বেষী, নারীবাদীরা ফ্রি সেক্স এ বিশ্বাসী, ইত্যাদি। এসব ‘ইত্যাদি’র শেষ নেই।
আমি নারীবাদীদের নিয়ে অনেক খারাপ খারাপ কথা যে প্ৰচলিত আছে তা বাদই দিলাম।
প্রথমেই যদি বলি নারীবাদী কারা? অথবা নারীবাদ কী? ক’জন আসলেই এর অর্থটা জানি? কেননা জানলে এরকমভাবে নারীবাদকে আমরা ব্যাখ্যা করতাম না। ক’দিন আগে একটি লেখায় পড়লাম, নারীবাদীরা যেন সভ্যভাবে কথা বলেন। এ যেন চোর কে চোর বলা যাবে না। ধর্ষণকারীকে ধর্ষক বলা যাবে না।
যে নারী প্রতিদিন মার খায়, সারাদিন অক্লান্ত পরিশ্র্ম করেও কোনো কাজ করে না বলে ধিক্কার শোনে, প্রতিরাতে স্বামীর দ্বারা ধর্ষিত হয়, তার কষ্ট আর বেদনার জন্য সে যদি প্রতিবাদ করে, তাহলেই সে অসভ্য নারী, খারাপ নারী। সে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলো।
নারী কেন পুরুষ আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করবে?
নারীবাদীরা পুরুষের এই আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করে। তারা বিশ্বাস করে “পিতৃতন্ত্রের শাসকরা (ক্ষমতাবান পুরুষেরা) ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলা জীবনবিরোধী এক যুদ্ধে লিপ্ত” (মেরি ডালি)
তাহলে নারীবাদ কী? নারীবাদের সংজ্ঞা অনুযায়ী নারীবাদ হচ্ছে, “সমাজ, কর্মক্ষেত্র এবং পরিবারে নারীদের উপর যে নির্যাতন ও শোষণ হয় সে সম্পর্কে সচেতনতা এবং এই পরিস্থিতি পরিবর্তনের জন্য সচেতন উদ্যোগ গ্রহণ করা”।
অন্য সংজ্ঞাটি আরেকটু সুস্পষ্ট -” নারীবাদ হচ্ছে পরিবার, কর্মক্ষেত্র এবং সাধারণভাবে সমাজে বস্তুগত ও ভাবগত পর্যায়ে নারীদের শ্রম, উদ্ভাবন শক্তি ও যৌনতার উপর পুরুষতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ, শোষণ ও নির্যাতন সম্পর্কে সচেতনতা এবং বর্তমান পরিস্থিতি পরিবর্তনের জন্য নারী ও পুরুষের সচেতন কার্য পরিচালনা।” (“নারীবাদ বিষয়ে কিছু প্রশ্ন এবং দক্ষিণ এশিয়ায় এর প্রাসঙ্গিকতা”)।
এই সংজ্ঞা অনুযায়ী কোনো নারী বা পুরুষ যদি নারী – পুরুষের বৈষম্য, পুরুষের নারীর উপর আধিপত্য ও পুরুষতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ উপলব্ধি করেন এবং কোনো কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেন, তিনিই একজন নারীবাদী।
এরপর কি আমরা বলবো, আমরা নারীবাদী নই? আমি আবারো বলছি, নিজেকে নারীবাদী বলবো কী, বলবো না, এটা মূল আলোচনা নয়। আলোচনাটা নারীবাদকে বোঝার জন্য প্রয়োজন।
মেয়েদের নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য নানাভাবে পুরুষ নিপীড়ন, নির্যাতন করে থাকে। পুরুষের এই আচরণকে সমাজ বৈধতা দেয়। সিলভিয়া ওয়ালবি নারীর উপর পুরুষের এই আচরণকে একটি বিশেষ নির্মিতি বলেছেন। তিনি বলেছেন, “আপাতদৃষ্টিতে ব্যক্তিগত ও বিচিত্র হলেও আসলে পুরুষের অত্যাচার হিংসাত্মক একটি নির্মিতি বিশেষ।
নারী নিয়মিতভাবে পুরুষের এ হেন আচরণের সম্মুখীন হয়। রাষ্ট্র ব্যতিক্রমী কিছু ক্ষেত্র ছাড়া এ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে অস্বীকার করে, এবং এই ভাবে পুরুষের এই অত্যাচারকে অনুমোদন করে”।
নারীবাদীরা খারাপ, তার প্রধান কারণ নারীবাদীরা বলেন যে, পুরুষ নারীর দেহকে নিয়ন্ত্রণ করে, নারীকে মাতৃত্বের বোঝা বহন করতে বাধ্য করে এবং তাকে যৌন দাসীতে পরিণত করে। কথাটি কী বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সত্য নয়? কতজন নারী পারেন তার নিজের শরীরের সিদ্ধান্ত নিতে?
পাঠকের নিশ্চই জানা আছে বাংলদেশে ৬৬% নারীরই ১৮ বছরের মধ্যে বিয়ে হয় যায় (ইউনিসেফ)। আর তার মধ্যে একটি বিরাট অংশ মা হয়ে যান শিশু বেলাতেই? যে শরীরটি সে নিজেও চেনে না তা খুব অনায়াসে অন্যের সম্পদ হয়ে যায়। আর এই পরিসংখ্যানটা তো আমাদের জানা যে দক্ষিণ এশিয়ায় প্রতি দুজন নারীর একজন পারিবারিক নির্যাতনের শিকার ( WE CAN)।
কট্টরবাদী নারীবাদীদের মতে, নারীর পীড়নের কারণ তার প্রজনন ক্ষমতা। সুলামিথ ফায়ারস্টোন এর মতে, “নারীর প্রজনন ক্ষমতার ওপর পুরুষের দখলই নারী-শোষণের মূল ভিত্তি।“
কট্টরপন্থী নারীবাদীদের মতে, পুরুষের নারীকে শোষণ করার মূল কারণ নারীর শরীরী গঠন নয়; নারীর সে গঠনকে পুরুষ যতোটা মূল্য দেয়, বরং তার ওপর কর্তৃত্ব করে যে ক্ষমতার স্বাদ পায় সেটাই হলো মূলকথা। আর এসব কথা আমাদের বার বার নারীবাদীরা মনে করিয়ে দেয়। তাই নারীবাদীরা খারাপ।
আমরা জানি যে সকল পুরুষ খারাপ নয়। সকল পুরুষ অসংবেদনশীল নয়। সকল পুরুষই নির্যাতনকারী নয়। অনেক পুরুষ আছেন যারা নারীর এ অধস্তন অবস্থাকে মেনে নিতে পারেন না। অনেক পুরুষই নারীবাদীদের এ আন্দোলনকে সাপোর্ট করেন। কিন্তু তারা কয়জনা?
নারীবাদ নারী-পুরুষের সমতার লক্ষ্যে কাজ করে। নারীবাদ অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলে। নির্যাতনের শিকার নারীর পাশে হাত বাড়িয়ে দেয়। নারীবাদী মানে পুরুষের মতো হতে চাওয়া নয়। পুরুষ এ সমাজ থেকে এককভাবে যে সুযোগ পেয়ে যাচ্ছে তার বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলা। নারীবাদ পুরুষের নিয়ন্ত্রণের বিপক্ষে দাঁড়ায়। নারীবাদীরা পুরুষ বিদ্বেষী নয়। তবে যে পুরুষ ধর্ষণকারী, যে পুরুষ স্ত্রীর গায়ে হাত তোলে, নারীকে অমর্যাদা করে, যৌন নিপীড়ক, নারীর প্রতি অসংবেদনশীল, তেমন পুরুষকে নারীবাদীরা শিক্ষা দিতে চায়।
নারীবাদীরা শুধু পুরুষকে নয়, যে সিস্টেম পুরুষ পক্ষপাতদুষ্ট, যে সিস্টেম পুরুষতান্ত্রিক, তাকে প্রশ্ন করে। রাষ্ট্রযন্ত্রকেও নারীর বিরুদ্ধে এ হেন আচরণের জন্য জবাব দিতে বলে।
নারীবাদ অনেক নারীদের কাছেও অপ্রিয়। তার কারণ নারীবাদ অনেক নারীকেও চ্যালেঞ্জ করে। নারীদের মেয়েলি আচরণ, নারীদের ক্ষমতার প্রতি পুরুষের মতোই লোভ, পরিবার ও প্রতিষ্ঠানে অগণতান্ত্রিক চর্চা, অন্য নারীকে এবং দুর্বলকে শোষণকারী নারীদের, নারীবাদ সমালোচনা করে থাকে। নারীবাদ নারীদের ভেতর যে পুরুষতান্ত্রিকতা রয়েছে তাকে চ্যালেঞ্জ করে। নারীদের ভেতর যে পুরুষালি আচরণ রয়েছে তাকে আঘাত করতে পিছপা হয় না।
হ্যাঁ, তবে নারীবাদের বিভিন্ন ধরন রয়েছে। কেউ বিশ্বাস করেন উদারনৈতিক নারীবাদে, কেউ আবার কট্টরপন্থী নারীবাদী, কেউ মার্কসীয় নারীবাদী, কেউ সমাজতাত্বিক নারীবাদী, কেউবা পরিবেশবাদী নারীবাদী, ইত্যাদি। তারা সকলেই নারীর অধস্তন অবস্থা থেকে মুক্তির জন্য কাজ করে যাচ্ছেন।
নারীবাদ তাই নারী অধিকার আদায়ের সংগ্রামেরই অপর নাম।