ফারহানা আনন্দময়ী: সকলেই বলছে ১৮, কিংবা এর কম কিংবা এর খানিকটা বেশি… অর্থাৎ একটি সংখ্যাই প্রধান। বিয়ের মতন এমন একটা গুরুত্বপূর্ণ এবং দায়িত্বপূর্ণ ঘটনায় কোন মেয়ের জীবনকে জড়ানোর সিদ্ধান্তটা কি শুধুই একটা সংখ্যার উপর নির্ভরশীল হতে পারে? এতোই খেলাখেলা-হেলাফেলার বিষয় এটা?
একজনের জীবনের পুরো বাঁক ঘুরে যায় যে ঘটনায় তা কেবলই একটা সংখ্যার উপর নির্ভরশীল হতে পারে না কখনও। বিয়ে নামক সামাজিক প্রতিষ্ঠানে একজনকে সদস্য হতে গেলে বয়সের সঙ্গে সঙ্গে তার মানসিক, শারীরীক, সামাজিক, অর্থনৈতিক অবস্থানটা বিবেচনার মধ্যে আনতেই হয়। কেবল বয়স নির্ধারক হতে পারে না বিয়ের উপযুক্ত সময় নির্ধারণে।
১৮ বছর… এই বয়সটাকেও একজন মেয়ের বিয়ের জন্যে সর্বনিম্ন বয়স মানতে ব্যক্তিগতভাবে আমার আপত্তি আছে। একজন কন্যাশিশু যখন কেবল নিজের পরিচয় থেকে ‘শিশু’ ট্যাগটি সরিয়ে নিজের জীবনকে নিজে পরিচালনা করার প্রথম ধাপে পা রাখলো, সেই বয়সটাকে বিয়ের জন্য উপযুক্ত ঘোষণা করাটা মোটেও সুবিবেচনার কাজ নয়। কন্যাটির মাত্র পথচলার শুরু, নিজেকে পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে দাঁড় করানোর লড়াই মাত্র শুরু… ঠিক তখুনি তাকে থামিয়ে দেয়ার এই বন্দোবস্ত পাকা করার কোনো মানে হয় না।
একজন নারীর বিয়ের সর্বনিম্ন উপযুক্ত বয়স নির্ধারণ করা উচিৎ ২৮ বছর বয়সে। লেখাপড়া শেষ ক’রে অন্ততঃ ২/৪ বছর তার পেশাগত জীবনে স্থিত হওয়ার পরেই সে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেবে।
বিশেষ পরিস্থিতি বিবেচনায়, আদালতের নির্দেশে সেটি ২৫ বছরে কমিয়ে আনা যেতে পারে। এবং এটি কার্যকর করতে প্রথমেই যে পরিবর্তনটা দরকার, তা হলো সমাজে “বিয়ে দেবে” থেকে ধারণাটা বদল করে “বিয়ে করবে” তে প্রতিস্থাপিত করা। অর্থাৎ বিয়ের সিদ্ধান্তটা নেয়ার অধিকার থাকবে বিয়ের পাত্র-পাত্রীর। যতদিন একজন মেয়ের বিয়ের সিদ্ধান্ত নেয়ার একচ্ছত্র অধিকার থাকবে তার পরিবারের কাছে, ততদিন এই মেয়ের জীবনে মুক্তির দিশা মিলবে না, এটা নিশ্চিত।
কারণ, আমাদের সমাজে এখনও একজন মা-বাবা নিজ কন্যাকে বিয়ে দিয়ে পাত্রস্থ করাকেই জীবনের পরম স্বস্তির কাজ মনে করে। কন্যার জীবনের সিদ্ধান্তটাও তারা নিজের কাঁধে নেয়াকে দায়িত্ব মনে করেন। এবং সেই দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তারা ভুলে যান যে এই কন্যাটিরও একটি স্বতন্ত্র সত্তা আছে, নিজের জীবন নিয়ে তারও একটি নিজস্ব ভাবনা আছে। অধিকারের দাবী এতোটাই প্রকট যে তারা বিশ্বাস করতে শুরু করেন, জন্ম দিয়েছেন ব’লেই সন্তান আমার সম্পত্তি। পেলে-পুষে বড় করেছি ব’লেই সন্তানের জীবনের সকল সিদ্ধান্ত নেয়ার মালিক মা-বাবা।
১৮ বছর বয়সে একটি মেয়ে যখন কেবল নিজের জীবনের দায়িত্ব নেয়ার বয়সে পৌঁছলো, ঠিক তখনি তাকে নিজজীবনের সকল দায়িত্ব্ব নেয়া থেকে অব্যহতি দিয়ে পরনির্ভর্শীল করার ব্রতে নামেন যেন বাবা-মা। একজন বাবা-মা নিজেদের সিদ্ধান্ত মেয়ের উপর চাপিয়ে দিয়ে তাকে সংসারে ঢুকিয়ে দিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন। যেন সন্তান আমার সম্পত্তি, আমি যেভাবে ইচ্ছে তার ব্যবহার করতে পারি, ভালবাসার দাবীতে সেই সম্পত্তি হস্তান্তরের অধিকারও বাবা-মায়ের।
অধিকারের সীমা এবং সীমানা জানাটা খুব জরুরী যে কোনও সম্পর্ককে মুক্তভাবে শ্বাস নিয়ে বেড়ে ওঠার জন্য, শেকড় শক্ত করার জন্য। বন্ধু বলুন, ভালবাসার মানুষ বলুন, সকলের আগে নিজের সন্তানকে সম্পর্কের দখলদারীত্বে সম্পত্তি করে তোলা উচিত নয়। অধিকার চর্চার একটা নির্দিষ্ট সীমা আছে, সেটাই সবার আগে আমাদের সমাজের মা-বাবার চিন্তা-চেতনার ভেতরে ঢুকাতে হবে।
১৮ বছর… কেবল একজন মেয়ের উচ্চশিক্ষার প্রথম ধাপ শুরু হয়। তাকে সেই সিড়িতে উঠিয়ে দিয়ে শিক্ষা সম্পূর্ন করার আগেই মাঝপথে তার পথচলা থামিয়ে দিয়ে বিয়ের আয়োজন শুরু করেন অভিভাবকেরা। বেশিরভাগ মা-বাবাই তাদের কন্যাসন্তানকে লেখাপড়া শেখান বিয়ের পাত্রী হিসেবে কিছুটা জাতে তোলার জন্যে। মেয়ের কেরিয়ার কিছুতেই তাদের ভাবনার মধ্যে থাকে না। আমি অবাক হয়ে যাই এসব মা-বাবার সাহস দেখে! কী অবলীলায় তারা নিজের মেয়েকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী না ক’রেই অন্য একজন পুরুষের হাতে তুলে দেন নিশ্চিন্তে।
এইসব মা-বাবার প্রতি আমার সনির্বন্ধ অনুরোধ, অনুগ্রহ ক’রে নিজ কন্যাকে লেখাপড়ার পর্ব শেষ ক’রে পেশাগত জীবনে প্রবেশের সময়টুকু দিন। কিছুদিন মেয়েটি নিজপেশায় কাজ করুক, অর্থনৈতিক ভাবে স্বনির্ভর হোক। নিজের আয়ে নিজের জীবনটা একটু উপভোগ করুক। তারপর তাকেই সিদ্ধান্ত নিতে দিন, কাকে সে বিয়ে করবে, কবে নাগাদ বিয়ে করবে। বিয়ে-পরবর্তী জীবনটা তো তাকেই যাপন করতে হবে। তো সেই সিদ্ধান্তটা নেয়ার স্বাধীনতা তো আপনার মেয়েরই থাকা উচিত, নয় কি?
সমাজে আরেক দল মানুষ আছেন, যারা মাতৃত্বের দোহাই দিয়ে বিয়ের বয়সসীমাকে কিছুতেই বাড়াতে রাজী নন। তারা মনে করেন যেন একজন মেয়ের জীবনের একমাত্র লক্ষ্য বিয়ে এবং তার নারীত্বের স্বার্থকতা মাতৃত্বে। তারা তাদের যুক্তিতে উঠেপড়ে লাগেন, বেশি বয়সে বিয়ে হলে সন্তানজন্মদানে দেরি হয়ে যাবে এবং সেই বেশি বয়সে বিয়ে হওয়া মা সন্তান বড় করতে গিয়ে বার্ধক্যে পৌঁছে যাবেন। কেন, একজন মেয়ে যদি ২৮ বছরে বিয়ে ক’রে ৩০ বছরে মা হন সংসারে কী এমন ক্ষতি হয়ে যায়? তার দুজন সন্তানকে প্রতিপালন করে ১৫ এবং ১৮ বছর বয়সে পৌঁছে দেয়ার জন্যে সেই নারী কি ৪৮ বছর বয়সে মানসিক এবং শারীরীক ভাবে যথেষ্ট সমর্থ নন?

একজন মেয়ের বিয়ের বয়সসীমা নির্ধারণ করে একটা রাষ্ট্র কেবল তার দায়টুকু সারতে পারে। দায়িত্ব্ব কিন্তু পুরোটাই একজন মেয়ের পরিবারের। এখনও আমাদের সমাজে সাধারণত বিয়ের সিদ্ধান্তের ভার থাকে পরিবার অর্থাৎ মেয়ের অভিভাবকের উপর। একজন মা কিংবা বাবাই সবচেয়ে ভাল বুঝতে পারেন কীসে তার সন্তানের মঙ্গল। তাই ভাবনার পরিবর্তনটা আসতে হবে সেই মা-বাবার চিন্তাধারায়। রাষ্ট্র যতই আইন করে বিয়ের বয়সসীমা ১৮ করুক, পরিবারই পারে একজন মেয়ের বিয়ের বয়সসীমাকে টেনে ২৮এ পিছিয়ে দিতে।
সবশেষে বলতে চাই, এই লেখাটি আমি শিক্ষিত, নাগরিক মা-বাবাকে বিবেচনায় রেখেই লিখেছি। আমাদের দেশের গ্রামের প্রেক্ষাপটে এই পরিবর্তন কার্যকর করার মতোন উপযুক্ত সময় এখনও আসেনি।