প্রাপক: প্রিয় সমাজ, প্রেরক: একজন চরিত্রহীন!

জান্নাতুন নাঈম প্রীতি: খেয়াল করে দেখলাম এদেশের যত ছেলের সাথে কথা হয়েছে, কাছাকাছি এসেছি, মিশেছি, প্রেমে পড়েছি…প্রত্যেকের একটি কমন ব্যক্তিগত গোপন প্রশ্ন আছে। প্রশ্নটা হচ্ছে- তুমি কি সেক্স করেছ? আগে কখনো? করলে কবে করেছো? কয়জনের সাথে?

বলা বাহুল্য যেসব ছেলেরা আমার কাছে আসার, পাশে বসার সুযোগ পেয়েছে খানিকের জন্য হলেও তাদের প্রত্যেকেই আমার কাছে উদার, আধুনিক এবং মুক্তমনা বলে পরিচিত হয়েই কাছে এসেছে, অথবা ভালবাসার সুযোগ পেয়েছে। তবুও রক্তে বয়ে আনা পুরাতন কুসংস্কারের ডিব্বা থেকে বেশীরভাগকেই আমি বেরুতে দেখিনি। যে কয়েকজনকে দেখেছি বেরুতে তাদেরকে পুরুষ হিসেবে পুরুষ সমাজে নিন্দার নৈবেদ্য হতেই দেখেছি। যেমন- ও তো মেয়েদের নিয়ে ফুর্তি করে, চরিত্রহীন, লম্পট…ইত্যাদি। বলা হয়ে ওঠেনি-আমার কাছে ওই চরিত্রহীনেরাই বেশি প্রিয়, যারা চরিত্রবান সেজে ‘চরিত্রহীন’ হয় তাদের চেয়ে বহুগুণে প্রিয়!

prity
জান্নাতুন নাঈম প্রীতি

লেখালিখি এবং শিল্পচর্চার সুবাদে এদেশের সংস্কৃতিবান বলে যেসব পরিবারের সুনাম আছে, সুনাম আছে উদার, প্রজ্ঞাবান হিসেবে তাদের ভেতরের ক্ষুদ্রতা দেখেও অবাক হয়েছি। তাদের মাঝেও খুব কমন একটি প্রসঙ্গ, লুকিয়ে রাখা একটি প্রাচীন মনোভাব- একজন মেয়ে কেবল তার স্বামীর সঙ্গেই শোবে। তার সকল স্বাধীনতা থাকতে পারে, কিন্তু যৌনতার স্বাধীনতা থাকতে নেই। কাজেই কোনো মেয়ে যৌন স্বাধীনতা নিয়ে দুটি শব্দ উচ্চারণ করলেই পরামর্শ দেয়া হয়- আহা, তসলিমা নাসরিন হওয়া হচ্ছে! তসলিমা মার্কা আচরণ করছ কেন?

যদি আগ বাড়িয়ে জানতে চাই- তসলিমার দোষটা কি?

-সেও তোমার মতই বেয়াড়া এবং অসভ্য। তুমি যেমন মাস্টারবেশন, যৌনতা নিয়ে লেখা ছাড়া দুই পা ফেলো না। ঠিক তেমনি! ভালো মেয়েরা এরকম হয়না।

-ভালো মেয়েরা কীরকম হয়?

-আহা, তোমার ঘরের কথা পরের কাছে লেখার দরকার কি? কে জানতে চেয়েছে?

-কেন, তুমিই তো জানতে চেয়েছ! না চাইলে তার ঘরের কথা পড়ে না লেখার জন্য গলাবাজি করতে এসেছ কেন?  

এরপর যেটি ঘটে, সেটি হচ্ছে- পুরুষটি আমাকে আমার ‘ভালো’র জন্য কিছু পরামর্শ দেয়। সেই পরামর্শগুলি হচ্ছে- আমার ভালো চায় বলেই সে আমার অধিকার নিয়ে বলা কথাগুলিকে বাঁধতে এসেছে। আমার ভালো চায় বলেই সে আমাকে পুরাতন প্রথার বিরুদ্ধে কথা বলতে মানা করছে। আমার ভালো চায় বলেই আমার মানসম্মান বাঁচাতে সে এগিয়ে এসেছে।

কারণ এই সমাজ নামের গাছের গায়ে কেবল একটি আগাছার আস্তরণ, যেটির নাম- চরিত্র। তাই খুব সহজেই একটি মেয়ের চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তুলে ফেলা যায়। কোনো মেয়ে যদি কোনো ছেলের বিরুদ্ধে কেবল উত্যক্ত করার অভিযোগ করে, তবেই প্রশ্ন ওঠে- মেয়েটি কি যৌন উত্তেজক পোশাক পরেছিল? ওড়না ছিল? যেন কেবলমাত্র যৌন উত্তেজক পোশাক পরার অজুহাতে, ওড়না না থাকার অজুহাতে হাত দেয়া যায় মেয়েটির চরিত্রে। মেয়েটির শরীরে! এসব নিয়ে দু’কলম লিখলে, তিনকলম বললেই- তুমি চরিত্রহীন, তুমি অনাদর্শ একটি মেয়ে। তোমার কথার কোনো গুরুত্ব নেই কোথাও।

কখনো বলার সুযোগই তুমি পাবেনা যে, যৌন স্বাধীনতা মানে যৌন সম্পর্কের প্রস্তাবে কেবলমাত্র ‘হ্যাঁ’ বলে দেয়া নয়, একইসঙ্গে ‘না’ বলার স্বাধীনতাও!

আমার খুব ইচ্ছে এই সমাজের কাছে একটা চিঠি লিখি। চিঠিতে সমাজকে চিৎকার করে গমগমে গলায় জানিয়ে দেই-

প্রিয় সমাজ,

rape-victimআমি এই তোমার চোখে চরিত্রবান আদর্শ মেয়ে নই। হতেও চাইনা। কারণ জন্মগতভাবে আমি নিজেকে স্বাধীন বলে ভাবি। যৌনতার স্বার্থেও আমি নিজেকে স্বাধীন বলেই মানি। কাজেই তোমার ‘চরিত্র’ নামের চরিত্রটিতে আমি চন্দনের ফোঁটা দিয়ে রাখতে মানুষ হিসেবে দাসী হতে পারবো না কোনো পুরুষের বা কোনো প্রথার। ব্যক্তিগত স্বাধীনতা বলে, নিজের প্রতি নিজের শতভাগ অধিকার বলে, নিজেকে করা নিজের সম্মান বলে আজ ঘোষণা করছি- আমি কোনো তথাকথিত সতীসাধ্বী বা কুমারী মেয়ে নই। আমি যাকেই প্রাণ থেকে ভালোবেসেছি, তাকে উজাড় করে দেয়ার চেষ্টা করেছি নিজের সবটুকু শরীর এবং মন।

ভালোবাসার স্বাধীনতাসূত্রে আমি আমার শরীরকে সম্পূর্ণ স্বাধীন ভাবি।

ভালবাসার মানুষটির সঙ্গের সম্পর্কটিকে আমি প্রতারণা বলে ভাবতে পারিনা যদিনা সে আমার অসম্মতিতে আমাকে ধর্ষণ করে, নিপীড়ন করে।

আমার সম্মতিতে আমার সজ্ঞানে আমার শরীর এবং মনের মালিক কেবলমাত্র আমি। কাজেই আমি সতী নই, সাধ্বী নই, কুমারী নই, তোমার চোখে চরিত্রবান নই। আমি নিতান্তই তোমার চোখে নিতান্তই চরিত্রহীন, দুর্বিনীত, কলঙ্কিত ও বেয়াড়া।

তোমার ওইসমস্ত নারীকে সম্পত্তিকরণ সংক্রান্ত অপ্রথা কুপ্রথাকে আমি ছুঁড়ে দিতে চাই সেসব মেয়ের পায়ে- যারা প্রতিদিন স্বামীর মার খায়, মার খেয়ে কাঁদে, বিবাহসূত্রে ইচ্ছের বিরুদ্ধে ধর্ষিত হয়, ধর্ষণের সাক্ষী শিশুর মা হয়ে ওঠে, প্রাণপণে মেনে নেয় সকল অচ্যাচার।

ওরকম মা, মেয়ে বা চরিত্রবান হতে আমার বয়েই গেছে!

আমি ভদ্র অন্যায় মেনে নেয়া নারী হতে পারিনি, কুমারী হতে পারিনি, মুখ বুজে দুঃখ সয়ে যাওয়া চরিত্রবান মেয়ে হতে পারিনি। আমাকে ক্ষমা করো। তবুও মানুষ হিসেবে স্বীকৃতি দাও। নারী বলে নয়, মানব সন্তান বলে, কেবলমাত্র মানুষ বলে। ওইটুকুতেই আমার চলবে!

আমি ভালো নেই, তুমি ভালো থেকো প্রিয় সমাজ! তোমার কপালে চন্দনের টিপ পড়ুক, ফুল পড়ুক, তুমি চরিত্রবান হতে গিয়ে আমাকে বরং চরিত্রহীন বলেই অপবাদ দাও। তবুও বোলো- চরিত্রহীন হলেও আমি মানুষ ছিলাম! চরিত্রবান সেজে থাকা না-মানুষ নই!

ইতি

-তোমার চরিত্রকে চরিত্রহীন করে তোলা একজন চরিত্রহীন!

শেয়ার করুন: