নারীস্বার্থ বিরোধী ”বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন”

ড. সীনা আক্তার: বিশেষ ক্ষেত্রে ‘সর্বোত্তম স্বার্থে’ শিশু-কিশোরী বিবাহ বৈধ হতে যাচ্ছে! যা বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে সরকারের শুভ উদ্যোগকে ম্লান করার জন্য যথেষ্ট।  মন্ত্রিপরিষদে অনুমোদিত ”বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন, ২০১৬”-এর খসড়া আইনের ১৯ ধারা অনুযায়ী বিশেষ প্রেক্ষাপটে ‘সর্বোত্তম স্বার্থে’ আদালতের নির্দেশে এবং মা-বাবার সম্মতিতে ১৮ বছরের কম বয়সী মেয়েদের বিয়ের বিধান রাখা হয়েছে। অথচ দীর্ঘদিন থেকে নারীর ক্ষমতায়নে বিশ্বাসী দেশের নারী ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো, ব্যক্তিবৃন্দ এই খসড়া আইনের যৌক্তিক ত্রুটি, সীমাবদ্ধতা চিহ্নিত করে মেয়েদের বিয়ের বয়স শর্তহীনভাবে ১৮ রাখার প্রস্তাব করেছে। কিন্তু সরকার এতে ‘বিশেষ ব্যবস্থার’ শর্ত জুড়ে দিয়েছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে কোনো এক অজানা কারণে সরকার ”তাল গাছটা আমার” লোভ ছাড়তে পারছে না!

Stop Violence Collageযেকোনো আইন,সামাজিক নীতিমালা প্রণয়ন করা হয় অভীষ্ট জনগোষ্ঠীর মঙ্গল ও উন্নতির লক্ষ্যে। অনুমোদিত এই আইনের ‘বিশেষ প্রেক্ষাপটে সর্বোত্তম স্বার্থেশিশু-কিশোরীদের সুনির্দিষ্ট কী কল্যাণ সাধন হবে?

এ বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম সাংবাদিকদের  বলেন, অবিবাহিত মাতা, কিন্তু তার বাচ্চা আছে- এ রকম কেইস যদি হয়, এসব ক্ষেত্রে তাকে প্রোটেকশন দেওয়ার জন্য আইনে নতুন করে এই বিধান যুক্ত করা হয়েছে। তাছাড়া সমাজে এখন অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েদের বিয়ে নিয়ে নানা সমস্যা দেখা দেয়; যেমন ১০-১১ বছরেও কেউ পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করে প্রেগন্যান্ট হয়ে যায়। এ ধরনের বিয়ে শাদিকে লিগালাইজ করার জন্য এই নতুন বিধান।

অন্যদিকে মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি এক দৈনিক পত্রিকাকে বলেন, ”বাল্যবিবাহ বন্ধ করলেও কিশোর-কিশোরীদের প্রেম বন্ধ হয়ে যাবে, এমনটি নয়। কোনো কিশোরী পরিস্থিতির শিকার হয়ে গর্ভবতী হলে তখন তার ভবিষ্যৎ কী হবে? অভিভাবকহীন প্রতিবন্ধী কিশোরীর থাকার জায়গা না থাকলে ১৮ বছর পর্যন্ত অপেক্ষা না করে মঙ্গলজনক মনে হলে বিয়ে দেওয়া যেতে পারে।”

নীতি নির্ধারকদের নারীস্বার্থ বিরোধী এ ধরনের কথাবার্তা দুর্ভাগ্যজনক! কারণ তাঁদের ভাষ্যে স্পষ্ট  এই ‘বিশেষ প্রেক্ষাপটে’র বিধান নারীর প্রতি অবমাননাকর এবং বৈষম্যমূলক। যেমন, বলা হচ্ছে একজন ১১-১২ বছরের কিশোরী গর্ভবতী হলে বিয়ে দিয়ে তাকে তথাকথিত প্রটেকশান দেয়া হবে, যা সরকারের মতে ‘সর্বোত্তম’ সমাধান!

Sina Akhter
সীনা আক্তার

এর মানে শিশু-কিশোরী যৌন নিপীড়নকে আইনসিদ্ধ করা। স্পষ্টত:ই সরকার এই কিশোরীদের উপর যৌন নিপীড়নের ক্ষতিকর প্রভাব, তাদের শিক্ষা-স্বাস্থ্য, আকাঙ্ক্ষা, কৈশোরের আনন্দ অগ্রাহ্য করছে। তাদের ভবিষ্যত সামাজিক-সাংস্কৃতিক-অর্থনৈতিক অবস্থা ও অবস্থান সরকারের কাছে গুরুত্বহীন। কোনো কিশোরী প্রাপ্তবয়ষ্ক পুরুষ দ্বারা গর্ভবতী হওয়া মানে সে ধর্ষণের শিকার; সেক্ষেত্রে সেই ধর্ষকের সাথেই কিশোরীকে বিয়ে দিয়ে রাষ্ট্র তথাকথিত প্রটেকশানের ব্যবস্থা করছে।

আবার, একজন কিশোরী যদি অপ্রাপ্তবয়ষ্ক পুরুষ (২১ বছরের কম বয়সী) দ্বারা গর্ভবতী হয় তখন তাকে কার সাথে বিয়ে দেয়া হবে? অথবা ১৮ বছর বয়সী কোনো নারী যদি ১৮-২০ বছর বয়সী কোন পুরুষের সাথে ভালবাসাময় সম্পর্কে গর্ভবতী হয়, তখন সেই নারীকে কার সাথে বিয়ে দিয়ে ‘প্রটেকশান’ দেয়া হবে?

অন্যদৃষ্টিতে, ১৮ বছরের একজন পুরুষ ১৮ বছরের একজন নারীর সাথে ভালবাসাময় সম্পর্কে জড়াতে পারে, অতি আবেগে সহবাস করতে পারে, অসতর্ক কারণে মেয়েটি গর্ভবতী হতে পারে; তখন সেই প্রেমিক পুরুষটি খুব সহজেই আইনের দোহাই দিয়ে বিয়ের দায়িত্ব এড়াতে পারে, কারণ পুরুষকে সেই সুযোগ দেয়া হচ্ছে। তখন সেই মেয়েটির কী হবে?

উল্লেখ্য, শর্তহীনভাবে ছেলেদের বিয়ের ন্যূনতম বয়স ২১ বছর। এছাড়া, বাল্যবিবাহে প্রস্তাবিত একটি শাস্তির বিধান বাস্তববোধশূন্য; যেমন দুজন অপ্রাপ্তবয়স্ক ছেলেমেয়ে বাল্যবিবাহে তাদের ১৫ দিনের আটকাদেশ ও অনধিক পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা। বিয়ের সিদ্ধান্তে অটল অনেক অপ্রাপ্তবয়ষ্ক ছেলে-মেয়ের কাছে এই শাস্তি একটি তুচ্ছ চ্যালেঞ্জ মনে হতে পারে।

প্রতিমন্ত্রী অভিভাবকহীন বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন  কিশোরীকে (মন্ত্রীর ভাষায় প্রতিবন্ধী) ১৮ বছরের আগেই বিয়ের ব্যবস্থার কথা বলছেন। এই কিশোরীদের প্রতি এটা হবে চরম অন্যায্য এবং বৈষম্যমূলক। কারণ পরিপক্কতা ও সক্ষমতায় একজন বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন  ব্যক্তি এবং একজন স্বাভাবিক ব্যক্তির মধ্যে ব্যাপক ব্যবধান। সেজন্য জাতিসংঘ কনভেনশানে বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন ব্যক্তির প্রতি সমতা প্রতিষ্ঠায় গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।

জাতিসংঘের বিধান অনুযায়ী উন্নত দেশে বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন ব্যক্তিকে ২১ বছর পর্যন্ত, কখনো কখনো ২৫ বছর পর্যন্ত শিশু অধিকারের সুবিধাগুলো নিশ্চিত করা হয়। অথচ খসড়া বাল্যবিবাহ নিরোধ আইনের উল্লেখিত বিধানে বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন মেয়েদের অধিকারকে অবজ্ঞা করা হয়েছে; উপরন্তু অধিক বৈষম্যের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। (জাতিসংঘের কনভেনশানের বিস্তারিত ধারাগুলো এই লিংকে: (http://www.un.org/disabilities/convention/conventionfull.shtml)।বালবিবাহ নিরোধ আইনের সাথে দেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠীর জীবন এবং ভবিষ্যত কল্যাণ জড়িত, অথচ সরকার সমস্যায় মূলে দৃষ্টি না দিয়ে, সমস্যার কারণ দূরীকরণের উদ্যোগ না নিয়ে অসঙ্গতিপূর্ণ কিছু অপযুক্তি দিয়ে এই আইনকে জায়েজ করার চেষ্টা করছে।

উল্লেখিত ধারার ‘বিশেষ প্রেক্ষাপট/ব্যবস্থার’ সবচেয়ে বিপজ্জনক দিক হচ্ছে অপ্রাপ্তবয়ষ্ক মেয়েদের প্রতি লোভাতুর বয়স্ক পুরুষ, প্রভাবশালী পুরুষ বিয়ের লক্ষ্যে জোরপূর্বক বা ফুসলিয়ে কিশোরীদের সাথে যৌন সম্পর্ক তৈরির সম্ভাবনা। অসেচতনতা, নিরাপত্তাহীনতার কারণে কোনও দরিদ্র মা-বাবা বা কিশোরী নিজেই প্রলোভনে এই প্রক্রিয়ায় বিয়ের সিদ্ধান্ত নিতে পারে, বা বাধ্য হতে পারে। এতোদিন বাল্যবিবাহ হয়েছে লুকোছাপায়, এ আইনের অপব্যবহারে এখন তা হবে প্রকাশ্যে। পরিণতিতে, অসম-বয়সী বিয়ের কারণে দাম্পত্য ধর্ষণ, ভুক্তভোগী মেয়েটির উপর কর্তৃত্ব-নিয়ন্ত্রণ-নিপীড়ন,পারিবারিক সহিংসতা-নির্যাতন বাড়বে।

এছাড়া বিধবা, পরিত্যক্ত এবং একাকী মায়ের পরিবার বৃদ্ধির আশঙ্কাও আছে। পাশাপাশি অল্প বয়সে দাম্পত্যের চাপ, গর্ভকালীন শারীরিক-মানসিক জটিলতা, বিষণ্ণতা ইত্যাদিও বাড়বে। বলাই বাহুল্য, এইসব জটিলতা বহুমুখি সামাজিক সমস্যা সৃষ্টি করবে।

সরকার কিশোরীদের ভালবাসাবাসি নিয়ে উদ্বিগ্ন কিন্তু পুরুষের ভালবাসা নিয়ে তাদের কোন ভ্রুক্ষেপ নেই! কিশোর-কিশোরী মধ্যে ভালবাসাবাসি হবে, এটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু সরকারের দৃষ্টিতে এর সকল দায় কেবল কিশোরীদের! তাই বিয়ে দিয়ে কিশোরীদের রুখতে হবে, বিয়েই একমাত্র সমাধান, বিয়ের জন্যই তাদের জীবন; কী পুরুষতান্ত্রিক চিন্তাভাবনা! তাছাড়া বিবাহিত বা অবিবাহিত যাই হোক ১৮-এর কম বয়সে গর্ভধারণ একটা বিপজ্জনক ব্যাপার। অথচ প্রটেকশানের নামে আইন করে শিশু-কিশোরীদের ঝুঁকিপূর্ণ জীবনে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। বিয়ে-বহির্ভূত গর্ভাবস্থা অবশ্যই একটা সামাজিক সমস্যা এবং এ সমস্যা এড়াতে কৈশোরে মেয়ে-ছেলেদের দায়িত্বশীল যৌন আচরণ, যৌনতা এবং সম্পর্ক বিষয়ে ব্যাপক শিক্ষাদান জরুরি।

গবেষণায় দেখা গেছে কৈশোরে ‘লিঙ্গের ভিন্নতা/যৌনতা এবং সম্পর্ক’ বিষয়ে শিক্ষাদান প্রলোভন, প্রতারণা এবং গর্ভাবস্থা এড়াতে সহায়ক।   

early-endএটা স্পষ্ট যে ত্রুটিপূর্ণ এই আইনে মেয়েদের কল্যাণ, নিরাপত্তা, সুখ-সমৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হবে। কারণ, তথাকথিত ‘সামাজিক সমস্যার’ দোহাই দিয়ে অপ্রাপ্তবয়ষ্ক মেয়েদের ভবিষ্যতকে হত্যার ব্যবস্থা হচ্ছে। বিয়ের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনে মেয়ে-ছেলে উভয়েরই পরিপক্কতা, বিচারবোধ, শারীরিক-মানসিক-অর্থনৈতিক প্রস্তুতি দরকার, যা ১৮ এর কম বয়সে হয় না। যেকোনো কারণেই হোক অপ্রাপ্তবয়ষ্ক মেয়ের বিয়ের বৈধতা তাৎক্ষণিকভাবে ভূক্তভোগীর জীবনে নেতিবাচক পরিণতি বয়ে আনবে এবং দীর্ঘমেয়াদে সামাজিক বিপর্যয় দেখা দেবে।

প্রসঙ্গক্রমে, এ আইনের অপব্যবহারে নিম্নবিত্ত পরিবারে নারীর শিক্ষা-উন্নয়ন চরমভাবে ব্যাহত হবে, যা বিদ্যমান সামাজিক শ্রেণি বিভাজন-বৈষম্যকে আরও প্রকট করবে। আশা করি সরকার আইনটি চূড়ান্ত করার পূর্বে ‘বিশেষ প্রেক্ষাপট/ব্যবস্থা’ ধারাটি পূণর্বিবেচনা করে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে একটি কার্যকর পদক্ষেপ নেবে। বলাই বাহুল্য,  নারীবান্ধব আইন মানে প্রত্যক্ষভাবে সমাজ এবং দেশের উন্নয়ন।

লেখক: সমাজবিদ ও প্যারেন্টিং পেশাজীবী।

শেয়ার করুন: