বন্ধুর জন্যে…….

সালেহা ইয়াসমিন লাইলী: খুব কথা বলতে ইচ্ছে করছিল বলে তোকে আজ ফোন দিয়েছিলাম। তুই ব্যস্ত বলে পরে ফোন দিবি বললি। পরে কখনও এতোটা ইচ্ছে করতো কিনা জানি না, তবে সেসময় খুব চেয়েছিলাম। যাক, তোর সময় ছিল না আজ।

অবশ্য পরে মতিকে ফোন দিলাম। এমনি এমনি বলতে পারিস। মতি অনেক উচ্ছাস নিয়ে কথাও শুরু করছিল। কিন্তু আমার বাড়াতে ইচ্ছে করলো না। কুশল জেনে কেটে দিলাম। তারপর লীনা, সন্ধ্যা, অঙ্কু সব্বাইকে ফোন দিলাম একে একে। কারো সাথেই কথা বলা হলো না কুশলটুকু ছাড়া। কিন্তু ফোনে একটা নম্বর থেকে কয়েকবার কল আসছিল, আমি রিসিভ করছিলাম না। কেটে দিচ্ছিলাম। একেবারেই কলটি ধরতে মন সায় দেয়নি। যতবারই ফোন বেজেছে, ততবারই বুকের ব্যথাটা ডুকরে ডুকরে উঠেছে।

laily-3
সালেহা ইয়াসমিন লাইলী

কয়েকদিন ধরে নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। বুকে চাপ চাপ লাগে সব সময়। যখন আয়নায় নিজের চেহারাটার দিকে তাকাই, খচ করে কী একটা কলিজাটায় বিঁধে যায়। চিন চিন ব্যথা হয়। কিচ্ছু ভালো লাগে না। তবে জানিস, আমার দুইটা অভ্যাসের বদল হয়েছে আজকাল। ভালোই হয়েছে হয়তো। মন বেশি খারাপ হলে গপগপ করে বেশি বেশি খাবার খেয়ে ফেলি। আর মনে চাপ বেশি হলে লাগাতার ঘুমিয়ে থাকতে পারি। আগে যেগুলোর উল্টা হতো। কী অদ্ভুত ব্যাপার, তাই না? হয়তো সময়ই সবকিছু বদলিয়ে দেয়।

তোকে আজ যে কথাটা বলতে ফোন দিয়েছিলাম তুই শুনে হয়তো খুশি হতিস। আমি যে সবসময় বলতাম আমার পাশে থাকার কেউ নাই বলে দু’দণ্ড বিছানায় পড়ে থাকতে চাই না। তাই আমি বিছানায় পড়ার আগেই দ্রুত মরে যেতে চাইতাম। এখন আর চাই নারে। কথাটি কয়েকদিন ধরেই ভাবছিলাম তোকে বলবো বলে। আজ মনে হলো বলেই ফেলি।

আমি এখন এমন মৃত্যু চাই, রোজ মৃত্যুকে একটু একটু করে উপভোগ্য করে মরতে চাই। জীবন তো আমার সাথে কম খেললো না, আমি না হয় মরণের সাথে জড়াজড়ি করে খেলেই মরবো। একটু ধরতে দেবো, আবার সরে যাবো, একটু ছুঁতে দেবো, আবার নড়ে যাবো, আবার একটু সামনে দাঁড়াবো, একটু লুকিয়ে রবো। মৃত্যুকে বলবো, একটু ঘুরে দাঁড়াও, তোমাকে দেখি, একটু হো হো করে হেসে দেখাও, একটু চিৎকার করে কেঁদে দেখাও, একটু ভয়ানক করে বীভৎসতা দেখাও। জানি, সে আমাকে ততোটা বীভৎসতা দেখাতে পারবে না, যা আমি এই জীবনে ইতোমধ্যে দেখে ফেলেছি।

একাকিত্বের বীভৎসতাকে আমি আর ভয় পাই না। আগে সে আমাকে অনেক ভয় দেখাতো। তাকে আমি অতিক্রম করে আজকাল সময়ের উপর ছেড়ে দিয়েছি। মৃত্যুকে যেমন অস্বীকার করে এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই, তেমনি আমার একাকিত্বও এড়ানোর কোনো উপায় নেই। মৃত্যুর মতো আমি একাকিত্বকেও উপভোগ করতে শুরু করেছি।

আহা! আমি কতো ভাগ্যবান! আমার চারপাশের অক্সিজেন- আলোয় ভাগ্য বসানোর আর কেউ কেউ নেই! একাকিত্বকে ভালবাসতে শুরু করেছি মৃত্যুর মতো আপন করে।

ভালবাসার কথায় মনে পড়লো, আমি এখন একটু একটু করে নিজের প্রেমে পড়ে গেছি। নিজেকে অনেক ভালবাসি এখন আমি। নিজেকে ভালবাসি বলে অন্য কারো বদনাম, প্রেম আমাকে ভোলাতে পারে না। নিজের প্রতি আমার মুগ্ধতা হলো নিজের অনুভূতির প্রতি আমি বিশ্বস্ত থাকতে পারি। যা ভালো লাগে তা যেমন বলতে পারি, যা মন্দ লাগে তাও জানান দেই নিজেকে। হ্যাঁ, নিজেকে। নিজের সাথে কোনো ভনিতা আমি করি না। শরীর-মন দুটোকেই অনেক পাত্তা দেই আজকাল। দুটোকেই খাবার দেই, ঔষধ-দাওয়া দেই, সেবা-যত্ন করি।

মনটা ভালো ছিলো না বলে তোকে আজ ফোন দিয়েছিলাম। তুই তো জানিস, কী এক অদৃশ্য মিল আছে তোর আর আমার মাঝে। আমাদের কারো মন খারাপ হলে আমরা একজন আরেকজনকেই বলি। আমরা তো আমাদের জীবনের ভালো-মন্দ, পাপ-পূণ্যের কোনো কথা কাউকে গোপন করিনি। তাই একজন আরেকজনের জন্য যতোটা দ্রুত সমাধান দিতে পারি টনিকের মতো। নাক কেটে ফেলেও আমরা নরুন নিয়ে খুশিতে নাচতে পারি। আমার আজ মন ভালো নেই। হয় তুইও মন খারাপ করে লিখতে বস, নয়তো কাজ ফেলে আয় কথা বলি। আমরা কথা বলে হাসতে থাকি যতক্ষণ বাঁচি। আয়। সেই রিসিভ না করা ফোন নম্বরটার কথা বলি। আমি কোনো কষ্ট পেতে চাই না রে।

ইতি- তোর বন্ধু     

শেয়ার করুন: