আসুন, মন খুলে একজন মানব পুরুষ দেখি

খালিদা খালেক মিশু: গত বছর ডিসেম্বরের এক শীতের সকাল। অফিস যাচ্ছি। সাড়ে সাতটার মতো বাজে। অফিসের গাড়িটা মিস করে সিএনজি অটো ধরছিলাম। হঠাৎ একটু দূরে চোখে পড়লো এক ফুলপ্যান্ট পরা টং মামার এক ছোট্ট দোকান। খুব ইচ্ছে করলো এমন শীতের ভোরে এক কাপ চা খাই। কিন্তু অপিসসসসসস !

মনকে শান্তনা দিয়ে মাথাটা ঘুরিয়ে অটোতে ঢুকতে যাচ্ছি। হঠাৎ খেয়াল করলাম টং মামা চা বানাতে বানাতে একটু পর পর তাঁর দোকান বাক্সের ভেতর কী যেন দেখে নিচের দিকে। প্রথমে চা বানাবার কাজের কিছু একটা হবে ভাবলাম। কিন্তু তাঁর একটু পর পর এমন মনোযোগ দেখে ব্যাপারটা আমার কেমন যেন লাগলো। আমি সিএনজি ড্রাইভারকে বললাম,

— মামা, দুইটা মিনিট পরে গাড়িটা ছাড়ুন তো।

সেই টং দোকানের মামা তখনও আমাকে দেখেননি।

facebook-theke-neya২/১ মিনিট বাদে দেখলাম বাক্সের ভেতর থেকে একটা ২/৩ বছরের মানুষের বাচ্চা বেরোচ্ছে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে দেখি সেই বাচ্চা তেমন নড়াচড়া করে না। সেই বাক্সের ভেতর থেকেই খুব বাধ্য বাচ্চা একটু পর পর উঁকি-ঝুঁকি মারে, আবার চলে যায়। বোঝাই যাচ্ছে, ভেতরে কিছু একটা নিয়ে খেলায় ব্যস্ত তিনি। দেখে ব্যাপারটা খুব ইন্টারেস্টিং মনে হওয়ায় বাজে অভ্যাসগত কৌতুহল থেকে কথা বলা শুরু করেছিলাম।

— মামা এই বাচ্চা আপনার এইখানে করে কী!

— (হাসে) আপা এটা আমার মেয়ে (খেয়াল করলাম, উনার মুখে শব্দটা মাইয়া হবার কথা ছিল )।

— ওহ, বাচ্চাটাকে তবে এমন শীতের ভেতর বের করসেন কেন ভাই। কাশি হয়ে যাবে তো।

— আপা, অভ্যাস আছে ওর। ওরে সকালে মাঝে মাঝে লইয়া আসি আমি । বাসায় থাকলে ওর মারে ঘুমাইতে দেয় না তো!

— আচ্ছা। বাচ্চার মা কী করেন?

— তিনি বাসাত কাজ করেন।

— আরিব্বাহ্‌ ! মা বাসায় থাকবে না বলে বাচ্চাকে বাবার সাথে রাখা হচ্ছে!

— না না আপা, অন্যের বাসাত না। নিজের বাসাতই কত্ত কাম-কাজ থাকে না ! তাই আমি নিজেই লইয়া আসি মেয়েটারে। ওয়ে বাপের লগে দুনিয়াদারিও দেখলো, আর ওরের (ওর) মায়ের একটু আরাম হইলো আর কি! ওরের মায়ে সারা দিন কত্ত কাম করে !! তার ঘুম দরকার আছে !! ওর বড় একটা ভাইও তো আছে। দুই বাচ্চা দেখবো নাকি ঘরের কাম করবো। ওরের মায়ে একলা আর কত কিছু করবো?

— আপনি তো দেখি অনেক বিচক্ষণ মানুষ মামা ! 🙂কিন্তু বাচ্চাটা সকাল থেকে না খেয়ে থাকে আপনার সাথে ?

— না… আমি হোটেলে খাই নইলে রাইতের ভাত খাইয়া আসি। আর ওরটা বাসাত্তোন নিয়া আসি। হোটেলে বইসাই ওরে খাওয়াইয়া তারপর বাপ-বেটী দোকান খুলি। দুপুরে ওর মায়ে আসে। কিছুক্ষণ আমগো লগে থাইকা মাইয়া লইয়া বাসাত চইলা যায়গা। .

mishu-khalequeআপা, চা দেই একটা?

— নারে মামা, চাটা থাক আজ। আরেকদিন বিকেলে আইসা আপনার সাথে আর বাচ্চার মায়ের সাথে গল্প করে চা খেয়ে যাবো নে ! 🙂

— আইচ্ছা, আইয়েন আপা।

… আমার সকালটা সেদিন অন্য রকম লাগছিল।

ভাবছিলাম,

বড় মনের কিছু বেসিক কমন সেন্সের সুন্দর কৌশলের চর্চা অনেক বড় বড় প্রতিষ্ঠানের কাজ করা বাবাদের ভেতর না থাকলেও এমন ছোট্ট একটা বাক্সের টং দোকান মালিকের ভেতর ছিল। যা তাকে অনেক প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত মানুষ গুলো থেকে এক মুহূর্তে একজন বিচক্ষন মানুষ হিসেবে আলাদা করে দিতে বাধ্য !!

এদের কেউ চেনে না, কারণ এদের নাম-পরিচয়ের সাথে কোন বড় প্রতিষ্ঠানের নাম থাকে না।

লেখক পরিচিতি: Financial Aid Officer Independent University, Bangladesh (IUB) 

শেয়ার করুন: