অদ্ভুত বাঙালী জাতি ও আমাদের হিপোক্রেসি

শারমিন জান্নাত ভুট্টো: আমরা জাতি হিসেবে বড়ই অদ্ভুত। অবাক হবেন না, বেশ কিছু কারণ আর ঘটনা হাতে আছে বলেই তো বলেছি। একটু সময় দিন, ব্যাখ্যা পেয়ে যাবেন হাতেনাতে।

ব্যাখ্যা ১. আমরা খুব গর্ব করে বলি জাতি হিসেবে আমরা বেশ অসাম্প্রদায়িক। কথা সত্যি তবে সব সময়ের জন্য নয়। আমরা অসাম্প্রদায়িক যখন পহেলা বৈশাখ আসে। আমরা ঝাঁকে ঝাঁকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা আর রমনা বটমূলে জড়ো হই আমাদের অসাম্প্রদায়িক মনোভাব প্রমাণের জন্য। তখন আমাদের কণ্ঠ জুড়ে থাকে ঐক্য আর সাম্যের গান। নানা ধর্ম, লিঙ্গ, বর্ণ, শ্রেণী নির্বিশেষে মিলিত হই প্রাণের মেলায়। শুধু তাই নয়, পাহাড়ী জনগোষ্ঠী বা নৃগোষ্ঠীর বৈসাবী উৎসবে আমরা অংশ নেই প্রাণের স্পন্দনে আর একাত্মতা জানাতেই।

attack-6অথচ নাসিরনগরে সংখ্যালঘু কিংবা গোবিন্দগঞ্জে যখন সাঁওতাল গোষ্ঠীদের ওপর হামলা আর গুলি চালানো হয় তখন কিন্তু আমরা সবাই “ গাহি সাম্যের গান” এটি ভুলে যাই।

মজার ব্যাপার হচ্ছে, নাসিরনগরে সংখ্যালঘুদের হামলার ঘটনার প্রতিবাদের চাইতে আমরা বাঙালী জাতি বেশী মগ্ন ছিলাম ট্রাম্প আর হিলারি নিয়ে। ট্রাম্প তার নির্বাচনী ইশতেহারে যখন উল্লেখ করে-অবৈধ অভিবাসী বিশেষত মুসলমানদের দেশ ছাড়া করবে, আমরা তখন সোচ্চার বজ্রকণ্ঠে। কী অদ্ভুত ব্যাপার না। নিজের দেশে যখন হিন্দু,বৌদ্ধ,সাঁওতাল মরে তখন আমরা সবাই মুখে কলুপ আঁটি। আর কথায় কথায় সংখ্যালঘুদের বিতাড়িত করার হুমকি দেয়। ভাই অন্যের দেশ নিয়ে কথা বলার আগে আসেন একটু নিজের দেশের দিকে তাকাই। ট্রাম্প যদি সংখ্যালঘু মুসলমান বিদ্বেষী আর রেইসিস্ট হয় আমরাও কিন্তু কম যাই না। ট্রাম্পের মতো আমরাও কিন্তু সংখ্যালঘু বিদ্বেষী আর চরম সাম্প্রদায়িক।

তবে একটি বিষয় অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে, অনেক বন্ধু ও পরিচিতকে দেখেছি যার যার অবস্থান থেকে প্রতিবাদ জানাতে আর সেটির বেশীর ভাগই হয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে। অবশ্যই সাধুবাদ জানাই তাদের এ উদ্যোগকে, প্রতিবাদী লেখনীকে।

তবে অনেক আফসোসের সাথে বলতে হচ্ছে, সংখ্যালঘুদের পক্ষ হয়ে আর ক্ষমতাসীন দলের বিপক্ষে গিয়ে কথা বলায় অনেকেই তীর্যক মন্তব্য আর অশ্লীল শব্দ ছুঁড়ে দিয়েছে আমাদের দিকে। অনেকে আবার প্রশ্ন করেছেন, কেনো আমরা মিয়ানমার আর ভারতের মুসলমান যারা অত্যাচারিত হচ্ছে তাদের নিয়ে কথা বলি না। এদের কথা শুনে হাসবো না কাঁদবো ঠিক বুঝে উঠতে পারি না। আরে ভাই, অন্য দেশে ঝগড়া লাগলে লাগুক, আপনি আপনার নিজের দেশের দিকে তাকান। যতই ধর্ম নিয়ে লাফ দেন না কেনো, লাইনে না দাঁড়ালে কিন্তু কোন দেশেরই ভিসা পাবেন না। শাহরুখ খান আর সৌরভ গাঙ্গুলী যে ধর্মেরই হোক না, কেনো দিনশেষে কিন্তু তারা নিজেদের প্রাউড ইন্ডিয়ানই বলে।

attack-12এদিকে মজার ব্যাপার হচ্ছে, বাজে মন্তব্যকারীদের ফেসবুকে ওয়ালে গিয়ে দেখা গেলো তারা প্রায় প্রতিটি উৎসবে সবাইকে শুভেচ্ছা জানানোর পাশাপাশি নিজেকে বেশ আধুনিক আর অসাম্প্রদায়িক বাঙালী হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। হায় রে বাঙালী, কত যে রূপ তোমার…….আমাদের অন্যতম প্রধান সমস্যা হচ্ছে জাতীয়তাবোধের অভাব। আর কথায় কথায় নিজেদের ধর্ম নিয়ে বড়াই করা।

অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে আমাদের, বাইরের কোন শক্তি এসে দেশের ওপর আঘাত হানবে এমনটা ভাবার আগেই আমরা নিজেরা নিজেরা ধর্ম নিয়ে মারামারি করে দেশ সাফা করে ফেলবো। অন্য কারোর আমাদের দেশের দিকে তাকানোরও লাগবে না।নিজেদের ধ্বংস করার জন্য আমরা একাই একশো।

ব্যাখ্যা ২. সাঁওতালদের কান্নার আওয়াজে গোবিন্দগঞ্জের বাতাস ভারী হয়ে উঠছে আর এদিকে বাঙালীরা ব্যস্ত ফোক ফেস্টিভ্যালে। দেখে কোনভাবে বোঝার উপায়ই নেই যে দেশের কোন অঞ্চলে কোন অঘটন ঘটেছে। যে নিরাপত্তার বেষ্টনী দেখা গেলো আর্মি স্টেডিয়ামে, তার খানিকটা যদি নাসিরনগরে থাকতো হয়তো দ্বিতীয়বারের মতো সেখানে হামলা হতো না কিংবা স্থানীয় আওয়ামী লীগের প্রভাবশালীরা গোবিন্দগঞ্জে আক্রমণ চালাতে পারতো না। অদ্ভুত সব ব্যাপার-স্যাপার, মাঝে-মধ্যে মাথায় ঢুকে না। কোন একটি অনুষ্ঠান আয়োজন করতে হলে বেশ আগের থেকে তার প্রস্তুতি নিতে হয় সেটা আমিও জানি। আমার এ লেখাতে কোনভাবেই বলা হচ্ছে না যে ফোক ফেস্ট আয়োজন করাটা ঠিক হয়নি।

শুধু বলতে চাইছি এই যে, অনুষ্ঠান শুরু করার আগে অবহেলিত মানুষগুলোকে একটিবার স্মরণ করলে খুব বেশী সময়ও যেতো না কিংবা কারো কোন ক্ষতিও হতো না। যাই হোক এসব কথা বলে খুব একটা লাভ নেই জেনেও বলি আর নিজেদের সান্ত্বনা দেই, আমরা হয়তো আবারো একদিন মানুষ হবো।

মানুষের কথা বলতেই মনে পড়ে গেলো মানুষের মুখোশ পরা বেসরকারী একটি টেলিভিশনের এক সাংবাদিককে। যিনি তার ফেসবুক ওয়ালে গুলিবিদ্ধ একজন সাঁওতালকে নিয়ে ট্রল করেছেন। আশ্চর্য হয়ে গেলাম তা দেখে। একটা মানুষ গুলিবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালের বিছানায় যন্ত্রণায় কাঁতরাচ্ছেন, আর তাকে নিয়ে মশকরা করা হচ্ছে পাবলিকলি। কী দুনিয়া আসলো এইটা, ঠিক ঠাওর করতে পারছি না। মুখোশ পরা সেই সাংবাদিক আবার রবীন্দ্র ভারতী থেকে তার পড়ালেখা শেষ করেছেন। কী অদ্ভুত, পাঠ্যবইয়ের শিক্ষা তিনি গলাধ:করণ করলেও মানবিকতার শিক্ষা আয়ত্ত্বে আনতে পারেনি ছিটেফোঁটাও। ধিক্কার জানাই এসব মুখোশধারী প্রগতিশীলদের প্রতি……….

santals-5ব্যাখ্যা ৩. না খেয়ে দিনের পর দিন কাটাচ্ছে গোবিন্দগঞ্জের সাঁওতালরা। ইচ্ছে করে উপোস করছে তা কিন্তু নয়। ঘরের পুরুষরা প্রাণের ভয়ে কাজে বের হতে পারছে না তাই খাবার জুটছে না কারো মুখে। আর খাবারই যখন নেই, তখন আর শিশুরা স্কুলে যাবে কী আনন্দে। ঘর-বাড়ি পুড়ে ছারখার তাই এই শীতে খোলা আকাশের নিচেই রাত্রি পার করতে হচ্ছে তাদের। ইশশ কী কষ্ট আর যন্ত্রণা এসব মানুষগুলোর অথচ অনুভব করার কেউ নেই। নাসিরনগর কিংবা গোবিন্দগঞ্জ কি অন্য কোন দেশে যেখানে যেতে ভিসা লাগে কিংবা অনেক সময় লাগে? যাদের দেখি টেলিভিশনের টক শোতে ঝড় তুলতে তাদের তো কখনও দেখি না ঐসব ঘটনাস্থল পরিদর্শন করতে। ক্ষমতাসীন দলের এমপি, মন্ত্রীরা কোন ঘটনার সাথে জড়িত থাকলে কি অন্য মন্ত্রী বা এমপির সেখানে যাওয়া নিষেধ। সুশীল সমাজের অনেকেই ইতিমধ্যে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন তবে সুশীল সমাজ থেকে রাজনীতির ময়দানে পা দেয়া অনেকেই এসময়টাতে লোকচক্ষুর আড়ালে দেখা যাচ্ছে।

bhutto-4
শারমিন জান্নাত ভুট্টো

বলার অপেক্ষা রাখে না যে, ধর্ম ও সম্প্রদায়িকতার বিষয়ে সবাই নিশ্চুপ থাকতেই পছন্দ করেন। কারণ কেউ কারো লোকপ্রিয়তা সহজে হাতছাড়া করতে চান না এ দুটি বিষয়ের জন্য। তবে অন্যরা কে কি করছে তার আগে নিজের দিকে তাকাই একবার, আমরা কি করছি কিংবা কি করা উচিত। আমরাও পারি আমাদের কণ্ঠ সোচ্চার করতে পারি আর বাড়িয়ে দিতে পারি সাহায্যের হাত নিজ নিজ অবস্থান থেকে।

যে সুপারমুনের দিকে তাকিয়ে আমরা নিজেদের ভাগ্যবান মনে করছি, ছবি তুলে ফেসবুকে পোস্ট দিচ্ছি একের পর এক, আর লুফে নিচ্ছি চন্দ্রালোকের আনন্দ, ঠিক সেই সুপারমুনের দিকে তাকিয়ে হয়তো সনাতন ধর্মাবলম্বী আর সাঁওতালরা ভাবছে, এভাবেই কী কেটে যাবে তাদের পরবর্তী ৭০০ বছর অযত্ন, অবহেলা আর বঞ্চনায়?

শেয়ার করুন: