শিক্ষিত আপা-ভাবী’র সমুচা ও বিভ্রান্ত আমি

আলফা আরজু: আমি গত কয়েক বছর নির্বাসনে আছি। কেউ কেউ এটাকে প্রবাস বলবেন। কিন্তু আমি নির্বাসন বলি। কারণ খুব ব্যক্তিগত (অজুহাত আর কী!)। সব নির্বাসিত অথবা প্রবাসী বাংলাদেশীর অজুহাত আছে – কেন নিজের দেশ ছেড়ে প্রবাসী? আমিও একটা শক্ত অজুহাত দাঁড় করিয়েছি (পাগলের সান্ত্বনা!) ।

arzu-alpha-edited
আলফা আরজু

এই নির্বাসিত জীবনে তেমন কিছুই অর্জন নেই,  আমার মতো কিছু পাগলের দেখা ছাড়া। যারা শারীরিকভাবে নির্বাসিত কিন্তু তাদের মন পড়ে থাকে “মধুর ক্যান্টিন অথবা বটতলায়”, কিংবা বাংলাদেশের কোনো গ্রামের মেঠোপথে – যেখানে তার জন্ম ও বেড়ে উঠা।

যাই হোক, অস্ট্রেলিয়াতে নির্বাসনে এসেই প্রথম যেই কাজটা করি (নব্য আসা সব বাংলাদেশিরা তাই করেন) – প্রাত্যহিক বাজার সদাইয়ের জন্য বাংলাদেশী দোকান খুঁজে বের করি। ওখানে কিছু ইঞ্জিনিয়ার (অফ কোর্স বুয়েট) ও ডাক্তার (ঢাকা মেডিকেল কলেজসহ নামি-দামি সরকারি ও বেসরকারি মেডিকেল কলেজ থেকে পাশ করা) রাঁধুনি আপা-ভাবি-আন্টি’র খোঁজ পাই।

এই ভাবীরা উনাদের সমগ্র অর্জিত শিক্ষা দিয়ে খুব সুন্দর ও সুস্বাদু সমুচা, সিঙ্গাড়া, বুন্দাইসহ নানা-রকম মিষ্টি (রসমলাই থেকে শুরু করে নেত্রকোনার বালিশ মিষ্টিও বানান)। রাতে এইসব রকমারি খাবার বানান, সকালে উনাদের স্বামীরা গাড়ি চালিয়ে দোকানে দিয়ে যান – বিক্রির জন্য।

প্রসঙ্গত বলে রাখি, এই স্বামীদের ডিগ্রী BUET কিংবা কোনো মেডিকেল কলেজের না হলেও – বিয়ের বাজারে উনাদের পরিচয় খুব গুরুত্বপূর্ণ – উনারা অস্ট্রেলিয়ান নাগরিক। এর মধ্যে বেশির ভাগ কুকারী কিংবা hairdressing এর সার্টিফিকেট কিনে – এদিক-সেদিক পয়সা দিয়ে অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক হয়েছেন!

প্রথম প্রথম অবাক হতাম – এতো মেধাবী মানুষ কেন এইসব করেন! চাইলে কতো ভালো কিছুই না করতে পারতেন। দুই একজনের সাথে কথা বলি। বেশির ভাগ উত্তর, বাচ্চা পালন! যদিও উনাদের বাচ্চাদের জন্য খুব ভালো ভালো শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র আছে। সেগুলোতে উনারা চাইলে ফ্রি অথবা নাম-মাত্র পয়সা দিয়ে সন্তান রাখতে পারেন। কিন্তু, কিন্তু, কিন্তু?

আর কী কারণ থাকতে পারে – সেটা খুঁজতে গিয়ে যা জানলাম, মুগ্ধ হয়ে গেলাম।  উনারা সঠিকভাবেই মেধার ব্যবহার করছেন। অনেক বেশি মেধাবী হতে হয় এই কাজের জন্য। একরকম একাউন্টেন্ট হতে হয় (MPA-CPA করা থাকলে ভালো, না থাকলেও স্বামী আছেন এই হিসাব মেলাতে!)

বিষয়টা একটু অন্য রকম। এই দেশে বেশ কিছু সরকারি ভাতার ব্যবস্থা আছে। সাধারণভাবে এইরকম যে, আপনি বাচ্চা মানুষ করার জন্য সময় দিচ্ছেন, তাই আপনাকে মাতৃত্ব ভাতা দেয়া হবে। আপনি নিজেকে যদি কোনোভাবে প্রমাণ করতে পারেন, আপনি কাজ করতে অক্ষম (ডাক্তারি সুপারিশও রেডি পাওয়া যায়!), তাহলে আপনি “ডিজঅ্যাবল পেনশন ভাতা ও কার্ড পাবেন” – বয়স কোনো ব্যাপার না।

আপনি যদি প্রমাণ করতে পারেন যে, আপনি কাজ পাচ্ছেন না, সেটা “বেকার ভাতা” টাইপ একটা কিছু ছাড়াও আরও নানারকম ব্যবস্থা। আপনার খাবার কেনার সামর্থ্য নাই – স্যালভেশন আর্মি অথবা এই ধরনের বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা আপনার বাসায় খাবার থেকে শুরু করে – রেফ্রিজারেটর, টিভি, খাট – সবই কিনে দিয়ে যাবে।  

Fruits of Bandit Queens-Nazia Andaleeb Preema
ছবিটি এঁকেছেন শিল্পী নাজিয়া আন্দালিব প্রীমা

এই সুযোগে আমাদের অনেক মেধাবী মেধার চর্চা করেন এভাবে, “সন্তান লালন-পালন করি” অজুহাত মাত্র (সারাদিন সমুচা-সিঙ্গারার dough বানাই), মাতৃত্ব ভাতার জন্য। কেউ আবার নিজেকে কাজের জন্য “অক্ষম প্রমাণ করেন disabale pension card’ এর ভাতার জন্য” (আসলে সারাদিন এই ভাবী-সেই ভাবীর বাসায় আড্ডা, মিষ্টি বানিয়ে বিক্রি!) বাড়িতে বানানো কোনো খাবারের যেহেতু ট্যাক্স দিতে হয় না- সরকারের কাছে কোনো হিসাবও থাকে না।

একজন বলছিলেন – তার লাভ থাকে ১০০% থেকে আরও বেশি, ক্ষেত্রবিশেষে পণ্যের (খাবারের) আইটেম অনুযায়ী। আমি আপ্লুত হয়ে যাই। কী দারুন ব্যবসা! সেন্টার লিঙ্কের ভাতাও পরিমাণে ভালো (শোনা কথা), সাথে এই বাড়তি আয়! উনাদের দামি দামি বাড়ি-গাড়ি দেখি, আর মনে হয় ভালো- কী ভালো! অন্যের ট্যাক্সের দেয়া পয়সা দিয়ে যেই ভাতা দেয়া হয় – সেই ভাতা নিয়ে উনারা কত ভালো আছেন। দেশেও পাঠান।

আবার এক দল আছেন – যারা সেন্টার লিঙ্কের পয়সা (বেশিরভাগ অ-মুসলিমদের কন্ট্রিবিউশন – ট্যাক্স কিংবা অন্য কোনো কারণে দেয়া অনুদান) খান ও পরেন, কিন্তু নামাজ-ধর্ম-হিজাব নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে ভুল করেন না।

হজ্ব করেন বছর বছর, তাবলীগ করেন, দ্বীনের দাওয়াত দিয়ে বেড়ান। আবার কিছু স্বামী আরও একধাপ এগিয়ে, নিজেরাও কোন কাজ করেন না centrelink এর ভাতার জন্য। ট্যাক্সি চালান, যার আয়ের এক টাকাও সরকারকে ট্যাক্স দিতে হয় না, -উপরন্তু কী যেন সব দেখিয়ে আয়-রোজগার করেন। খুব ভালো। কিন্তু উনারা আবার সুযোগ পেলেই এমন সব সহীহ হাদীস ও সততার কথা শোনাবেন, যে কেউ মুগ্ধ হয়ে বিভ্রান্ত হয়ে যাবেন (!)।

আমি সিডনিতে একটা রেস্তোরাঁতে কাজ করতাম। ওখানে আমার এক জাত ভাই (বাংলাদেশী) ছিলেন রাঁধুনী হিসেবে। উনি প্রায়ই নিজের কাজ শেষ করে বাইরে এসে বসতেন, আর ক্রেতাদেরকে দ্বীনের দাওয়াত দিতেন। ওই ক্রেতাদের একজন একদিন আমাকে বললো, তোমার মালিকের নম্বর দাও, আমি অভিযোগ করতে চাই। খাবারের দোকানে ধর্ম-প্রচার চলছে, এইটা ধর্ম-প্রচারের জায়গা না, ইত্যাদি ইত্যাদি !

আমি একটু ভয় পেয়ে মালিকের সাথে কথা বললাম। মালিক ওই কাস্টমারের নম্বর রাখতে বলেন এবং আশ্বস্ত করতে বলেন যে, মালিক বিষয়টা দেখবেন। পরে মালিক ওই কাস্টমারকে কল দিয়ে মাফ চেয়েছেন। কিন্তু ওই ফ্যামিলি আর আসেন নাই। এইরকম একজন ভালো কাস্টমার হারালে রাঁধুনির কোনো ক্ষতি নাই, মালিকের ক্ষতি। তাই বলে তার দ্বীনের দাওয়াত কিন্তু থামেনি। আমাকে একদিন বললেন, খুব চেষ্টা করছি একজন বিধর্মীকে ধার্মিক বানাতে পারলে “আলফা বেহেস্ত নিশ্চিত”। বেচারার নিশ্চয় বেহেস্তে যাওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া উচিত! কী বলেন?

উনি একজন ধার্মিক মানুষ (!)। প্রয়োজনের (ফরজ) চেয়েও বেশি নামাজ-রোজা করেন, সারাদিন ধর্মের কথা বলেন। কিন্তু ঊনি এতোটাই অসৎ যে, বছর পাঁচেক আগে এই দেশে এসেছিলেন স্টুডেন্ট ভিসা নিয়ে – কিন্তু ঊনি কোনো পড়াশোনা করেননি, সারাদিন কাজ করে বৈধ ও অবৈধ পথে আয় রোজগার করেছেন। পরে একটা বাবুর্চির সার্টিফিকেট কিনে অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক হয়ে গেছেন। আমি কী যে মুগ্ধ ঊনাকে দেখে! ঊনার বয়স পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই, গত বছর বাংলাদেশ থেকে অল্প বয়সী পরীর মতো সুন্দর মেয়ে বিয়ে করে এনেছেন। ঊনার মতে, মেয়েটার বয়স আরেকটু কম হবে, পাসপোর্ট ও বিয়ের কাবিন নামায়- বয়স বাড়িয়ে  ১৮/১৯ করেছেন।   

ঊনার গল্পমতে, বিয়ের রাতেই ঊনি মেয়েটাকে একটা হিজাব গিফট করেছেন। এবং বাচ্চা মেয়েটা হিজাব পরে, স্বামীর সব কথা শুনে, বাইরের কোনো পুরুষ লোকের সাথে কথা বলে না – সারাদিন ধর্মীয় আচার-আচরণ মেনে চলে – এইসব গল্প করে ঢেঁকুর তুলেন আমার জাত ভাই – আর আমি মুগ্ধ হইয়া বিভ্রান্ত হয়ে যাই। ভাবি – আহা কী ধার্মিক একজন মানুষ (!)।

শেয়ার করুন: