লাশের আবার ইজ্জত কীগো রানীমা!

সুচিত্রা সরকার: রানীমাকে, 

ভূমিপুত্র। সন্স অব দ্য সয়েল। হাস্যকর আর হাস্যরসের চরম সীমায় পৌঁছে গেছে সভ্যতা। যাদের ভূমি নেই, যারা অন্যের দয়ায় বাঁচে, যাদের জমিতে কী ফসল ফলাবে, আখ না ধান, তাও জোতদারদের, জমিদারদের জিজ্ঞেস করে নিতে হয়, তারা নাকি ‘সন্স অব দ্য সয়েল’! সাঁওতাল।

santals-3তারা কি আর অতো জানে? সন্স কী, বা সয়েল কী? তারা জানে, তাদের আছে মারাং বুরু। শালগাছে তাই হত্যে দিয়ে পড়ে থাকে। শালগাছ পথ বাতলে দেয়! ঐক্য আর সংহতির প্রতীক তো ঐ একটাই ওদের কাছে। মারাং বুরু। শালগাছ। সাঁওতালদের ম্যাজিক জানা দেবতা।

সেই কোন কালে, আদি মানব, যাদের আমরা বলি মনু। বা এডম-ইভ। অথবা আদম-হাওয়া। ভূমিপুত্ররা তাদের জানে, পিলুর হড়ম ও পিলুর বুড়ি। কালো চিক্কন ত্বক, চ্যাপ্টা নাক, পুরু ঠোঁট, কোকড়া চুল। পিলুর দম্পতির সাতপুত্র থেকেই সাঁওতালদের সাত বংশ। গোত্র। মারাং বুরু, অতো আদ্দি যুগের বদ্দি বুড়ো! অতোদিনের দেখাশোনার, ভালো মন্দ বিচারের ভার ওর কাঁধে! সেই দেবতা কি সাঁওতালদের মন্দ রাখতে পারে! ভালো বিনে!

‘আমায় সাঁওতাল করেছে ভগবান গো!’

santals-2সেই ১৯৫৫, চানদো মাঝিকে দেবতা এসে বললে, ফিরিঙ্গিদের বন্দুক থেকে গুলি নয়, জলের ধারা বেরোবে। তোমরা লড়াই চালাও। চললো লড়াই। বাঁধলো যুদ্ধ। সমানে অসমানে। ‘উড়্ টাং টাং, ধনুকে জোর দেরে টাং, টানা বাবা টানা, ফিরিঙ্গি দেয় হানা, মাদল সিঙা বাজারে, ঝোপে, ঝাড়ে, পাহাড়ে।’

পঁচিশ হাজার সাঁওতাল মরেছিলো সেবার। ফিরিঙ্গির বন্দুকের নল থেকে জল নয়, গুলিই বেরিয়েছিল। দেবতা কথা রাখেনি। চানদো মাঝি বোকা বনে যায়। মারাং বুরুও। সিধু মাঝি, কানু মাঝি ঐ দূর আসমানে ঠাঁই নেয়। সাঁওতালদের একা ফেলে, আকাশের তারা হয়ে যায়।

তারপর কী একটা কাগজ পেল। নামে দলিল। দলিল বটে, আবার দলিল নয়ও। জমিটা তাদের দখলে, তবে অধিকার নেই। সেই হিন্দু বিধবাদের মত অচল পয়সা তারা!

খুব মনে পড়ছে কালো মেয়েটিকে। ইলা মিত্রকে। রানীমা আজ কোথায়? কোথায় আজ? তিনি সাক্ষী! তেকুটি ভাগে, তেভাগার লড়াইয়ে তারাই ছিল সহযোদ্ধা। কেউ নয় আর! সেই কালো চিক্বন শরীর, সেই সাহস, সেই ধনুকের ছিলা। রানীমা, তোমার সাঁওতাল আজ ধূলায় গড়ায়!

আখ ক্ষেতে, মাদারপুরে। ঠিক পরবের আগে আগে। ‘সোহরাই’ আসতে মাত্র দু’মাস বাকি। নতুন ধান উঠবে, গন্ধে ম ম হবে সাঁওতাল বাড়ির উঠান! ফসল দেবতার প্রতি কৃতজ্ঞতায় নাচ হবে, গান হবে সারি বেঁধে। চোলাই মদ ঢালবে গলায়! আনন্দ হবে সবচেয়ে বড় পার্বণে! সোহরাই এ। হলো না। আগেই বেঁধে গেল লড়াই। আবারও একই

নিয়মে। সমানে অসমানে!

Ila Mitra
ইলা মিত্র – রানীমা

গোবিন্দগঞ্জের মাদারপুর। রানীমা, মাদারপুর। হয়তো তিনশ পরিবার। অনাহারে- অর্ধাহারে বেঁচে থাকা কালো কালো, শ’য়ে শ’য়ে অসভ্য মুখ। ব্রিটিশ যুগ থেকেই এখানে। তুমি তো জানো সবই। জানো, ওরা বর্বর। তাই আজো এই বর্বরদের হাতে, বন্দুক ওঠেনি। সিধু মাঝির, কানু মাঝির রক্তস্রোতে আজো নিশানা আঁকে ধনুকের ছিলায়।

মাইনসি হাসপাতালে মারা গেছে। একা। কেউ তার পাশে নেই। সাঁওতালরা যেতে পারছে না লোকালয়ে। ওরা যে লোক নয়। মানুষ নয়! অসভ্য এক জাতি। অস্ট্রিয়!

রানীমা, দ্বিজেন টুডুর চোখে, যে চোখ রেখেছিল প্রিয়ার চোখে, আবেগে, আলিঙ্গনে, যে চোখ ফসলের আনন্দে নেচে উঠতো- সেই চোখে গুলি! নির্ভুল টার্গেট। শাসকের ভুল হয় না কখনো, রানীমা।

dwijen-tuduদ্বিজেন টুডু হাসপাতালে। রংপুর মেডিকেল থেকে রিলিজ দিয়ে পাঠালো ইসলামিয়া চক্ষু হাসপাতালে। পুলিশ রাজি না এক্ষুনি হাসপাতালে নিয়ে যেতে। আগে আদালতে যেতে হবে শুয়রের বাচ্চাদের। ম্যাজিস্ট্রেট আদেশ দিলে তারপর হাসপাতাল।

চোখ থেকে রক্ত গড়ায়? রক্তের বন্যা? হোক সে! আগে আদালত। চোখ যায় যাক! এ আর এমন কী! একটাই তো সাঁওতালের চোখ। ও চোখে দেখার কী আছে? না জমি, না জিরাত, না সুন্দরী বউ, না একমুঠ স্বপ্ন। তার নাকি নাম আবার ভূমিপুত্র!

দ্বিজেন টুডু হাসপাতালের বেডে রানীমা। বেডে। চোখে দেখতে পাচ্ছে না। সাদা ব্যান্ডেজ বাঁধা। তবু হাতে স্টেনলেস স্টিলের হাতকড়া, দড়ি! যদি মারাং বুরু, মাদারপুরের সব শালগাছ ওকে উদ্ধার করে নিয়ে যায়! যদি! ম্যাজিক করে!

আর এদিকে সন্ধ্যে হতে চললো, ভূমিপুত্রের লাশ পড়ে আছে মাদারপুরের খোলা প্রান্তরে। পুলিশ ময়নাতদন্তের পর ফেলে দিয়ে গেছে। লাশের মুখটা এখনও কী যেন বলতে চাইছে। এ জমি আমার বাপ-দাদাদের, এই স্লোগান তুলতে তুলতেই বোধহয় গুলি খেয়েছিল!

এক টুকরো কাপড়ও জোটেনি। লাশের আবার ইজ্জত কী গো রানীমা! আর বেঁচে থাকতেই, তাদের যেন কতো ইজ্জত দেয় লোকে! ওদের লাশ খোলা প্রান্তরেই থাকা ভালো! ভূমিরই যাদের কোনো অধিকার নেই, তারা কার ভূমিতে, কবর খুঁড়বে বলো!

রানীমা, বড্ড কঠিন সময়। বড্ড নড়বড়ে। আমাদের আজ কোনো সিধু, কানু নেই। মারাং বুরু নেই। শালগাছ নেই। রানীমাও নেই। থাকলে দেখতে, বাঙলার প্রতিটি ধনুকের ছিলায় আজ টান দিতাম। সক্কলে মিলে। তোমাকে সঙ্গে নিয়ে!

১১.১১.২০১৬

দুপুর: ৩.০৪ মিনিট

লালবাগ, ঢাকা

শেয়ার করুন: