আমার জাহাঙ্গীরনগর এবং কিছু প্রশ্ন

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে র‌্যাগিং এর অভিযোগ তুলেছেন প্রথম বর্ষের ছাত্রী জান্নাতুন নাঈম প্রীতি। সেই অভিযোগ উইমেন চ্যাপ্টারে ছাপা হওয়ার পর এ নিয়ে বেশ বিতর্ক শুরু হয়েছে। অনেকে র‌্যাগিং নিয়ে প্রীতির সপক্ষে লিখেছেন, অনেকে বিরোধিতা করছেন এই বলে যে, এমন কিছু হওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। প্রীতির অভিযোগটি জাবির উপাচার্য পর্যন্ত গড়িয়েছে, এ নিয়ে প্রীতির বিপক্ষে মানববন্ধনও যেমন হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ে, তেমনি অনলাইনেও পক্ষে-বিপক্ষে আলোচনা-সমালোচনা চলছে। এর মধ্যেই জাবির একজন সাবেক শিক্ষার্থী কিছু প্রশ্ন করেছেন প্রীতিকে, তিনি জানতে চেয়েছেন, ঘটনাটা আসলেই কী ঘটেছে? কতদূর ঘটেছে? এ নিয়েই নিচের এই লেখা…………….

আফসানা বেগম: উথালপাতাল ঝড় উঠতো আমার জাহাঙ্গীরনগরে। সামান্য সময়ে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য কিছু পানি ঘরে ঢুকে পড়তো, অথবা জমে থাকতো এমন কোথাও, যেখানে তার আসারই কথা না।

ju-4নওয়াব ফয়জুন্নেসা হলের এক ব্লকের শেষ প্রান্তে সারি সারি বাথরুমের সামনে পানি জমে থাকলো একদিন। স্নাতকোত্তর পরীক্ষার্থী এক আপু জমে থাকা সেই পানিতে আছাড় খেলেন। তার সহপাঠীসহ চিৎকার করে ডাকতে লাগলেন পাশের দুটো রুমের কিছু প্রথম বর্ষের মেয়েদের।

: এই পানি তোমরা বেসিন থেকে এনে এখানে ফেলেছ, না?

: আমরা কেন তা করবো, আপু, এ তো বৃষ্টির..

: বৃষ্টির পানি এতোদূরে আসে? মিথ্যা বলার জায়গা পাও না?

: মিথ্যা না, আপু।

: আবার মিথ্যা কথা? আগে তো কখনো এখানে পানি জমতে দেখি নাই! যাও, কাপড় নিয়ে এসে মুছে ফেলো।

: আমাদের তো ফ্লোর মোছার কাপড় নাই, আপু।

: জামা-কাপড় নাই তোমাদের? সেগুলা নিয়ে আসো।

: জ্বী, আপু।…

: সিল্কের কাপড় দিয়ে পানি উঠবে? সুতি কাপড়ের জামা নাই?

ju-6সিল্কের জামাটা বারে বারে চিপতে গিয়ে ফেঁসে গিয়েছিল। পরের সপ্তাহে প্রথম বর্ষের সেই মেয়েটির জন্য আপু একটা জামা উপহার এনেছিলেন, বলেছিলেন, আমার ভুল হয়েছে। কেউ বেসিন থেকে পানি এনে শুধু শুধু ওখানে ফেলে রাখবে কেন? আর তারপর থেকে আপু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চলে যাওয়া পর্যন্ত ওই মেয়েটিকে সেই আপুর সঙ্গেই দিনরাত দেখা যেত। স্নাতকোত্তর পরীক্ষা হয়ে গেলেও তার টানেই মাঝে মাঝে ঢাকা থেকে গিয়ে হলে ঢুঁ মারতেন আপু।         

স্নাতকোত্তর পরীক্ষার্থী দ্বিতীয় আপু—-

: এই তারটাতে জামা মেললে কেন? এখানে আমি পাঁচ বছর ধরে কাপড় মেলি।

: এখন তো এখানে আপনার কাপড় নেই, আপু। আমারটা শুকিয়ে গেলেই উঠিয়ে নেব।

: না। সামনে কাপড় থাকলে আমার বারান্দায় আলো আসবে না। আমি এখন বারান্দায় বসে পড়বো।

বিশ্রী শব্দ করে আপু ঘর থেকে চেয়ার টেনে বের করতে লাগলেন। আমি নীচে কোথাও কাপড় মেলে দিয়ে এক কাপ চা হাতে নিয়ে উঠে এসেছিলাম।

: অ্যাই শোনো, আমার জন্য এক কাপ চা আনো তো!

: জ্বী, আপু।…

: এটা কী চা আনলে, একদম ঠাণ্ডা তো। এরকম ঠাণ্ডা চা-ই তুমি খাও?

: আমার কাছে ফ্লাস্ক আছে, আপু।

: যাও, ফ্লাস্কে করে নিয়ে আসো।

ju-5এটা চলতে থাকলো। ফ্লাস্কে করে চা আনা, প্রায়ই, সকাল-বিকাল। চা আনতে যাবার সময়ে কখনো ভুলতাম না, জিজ্ঞাসা করতাম, আপু, চা আনবো? খাবেন? শীতকালে জাহাঙ্গীরনগরের হলটা দুপুরের পরে হয়ে পড়তো শীতল আর নিস্তব্ধ। সব রুমের দরজা হাট করে খোলা আর মেয়েরা সাদা লেপ গায়ে দিয়ে ঘুমাতো।

লেপ সরিয়ে ঘুমন্ত আপুকে বলতাম, চা আনবো, আপু? বিব্রত আপু কোনো রকমে ‘না’ বলে লেপের নিচে মুখ ঢুকিয়ে ফেলতেন। একদিন লেকের পাড়ে প্রেমিকের সঙ্গে বসে ছিলেন। শীতের প্রকোপে আমার ব্যাগে তখন সবসময় গরম পানিভরা ছোট্ট ফ্লাস্ক। দূর থেকে দেখলাম মুখ দুটো এগিয়ে আসছে, ঠিক তখনই মাঝখানে গিয়ে ফ্লাস্ক দুলিয়ে যথাসম্ভব নিষ্পাপ মুখ করে বললাম, চা লাগবে নাকি, আপু? রাত করে হলে ফিরে গম্ভীর এবং ততোধিক লজ্জিত আপু বললেন, চা এরপর থেকে আমি নিজেই এনে নেব, ঠিক আছে? তারপর থেকে নিজের সঙ্গে আমার জন্যেও আনতেন। এনে ডাকতেন। এর ব্যতিক্রম হতো না।   

স্নাতক তৃতীয় বর্ষের এক আপু—-

: তোমাদের ফার্স্ট ইয়ারের মেয়েদের কি মুখ বন্ধ থাকে না?

: আমরা তো কথা বলিনি, আপু!

: তবে কি আমি ভুল শুনছি? আমার পরীক্ষা সামনে, জানো না? এতো হাসাহাসি কীসের?

: আপনার না কদিন আগেই পরীক্ষা শেষ হলো, আপু!

: তাতে কী, আবার ছয় মাস পরে পরীক্ষা আসছে না?

: টিভি দেখার সময়ে তোমরা সাইড টক করো কেন?

: না আপু, আমরা তো বলিনি কিছু!

: আবার কথা বলছো? দিলা তো ডায়ালগ মিস করে!…

: আচ্ছা, তুমি তো দেখছ আমি কুপনের লাইনে আছি, আগে গেলা কেন, ভদ্রতা নাই?

: আপু, আমি আপনাকে দেখিনি।

: দেখনি মানে? নাকি দেখতে চাও নাই? সিনিয়র-জুনিয়র ব্যাপারটা বোঝো তো, না? আর একজনের পরে একজন, মনে থাকবে? …

: আফসানা, খিচুড়ি আছে?

: আছে একটু।

: আমি খেয়ে নিচ্ছি। রান্নার সময় হয়নি, বুঝলা? ডাইনিং তো দেরি আছে, আমার পরীক্ষা।

সব মিলিয়ে খিচুড়ি রান্না সহজ ছিল। তারা প্রায়ই ’খিচুড়ি আফসানা’ বলতেন। আমার খিচুড়ি ফুরাতো, তাদের পরীক্ষা ফুরাতো না। এখনো কথা হলে প্রথমে জানতে চান, খিচুড়ি রাঁধো এখনো? একদিন রেঁধে খাওয়াবা।

ডিপার্টমেন্টে স্নাতকোত্তর ক্লাসের এক ভাই——

ju-7সমাজ বিজ্ঞান অনুষদের মাঝখানে ছিল শিউলি গাছ। আমাদের অনেকের মতো সে শিউলি গাছেরও এখন কোনো অস্তিত্ব নেই সেখানে। শিউলি গাছের নীচের বারান্দায় সারি বেঁধে বসে ছিল আমাদেরই ব্যাচের কিছু ছেলে। কেউ চেনা, কেউ অচেনা বা মুখ চেনা। ব্যাচের ভেবেই সবাইকে ‘তুমি’ করে বলছিলাম। মাঝে যে একজন দুষ্টু সিনিয়র ছিলেন তা বুঝতে পারিনি। অন্যদেরকে কী ইশারা করতেন কে জানে, যেখানে সেখানে তাকে ব্যাচমেট ভেবে তুমিই বলতাম, সবাই মুখ টিপে হাসতো, আমি হাবা হাবা চেহারা করে রাখতাম, কিন্তু কিছুই বুঝতে পারতাম না। বহু পরে একদিন জানলাম।

যাই হোক, বিকেলের ঠিক পরের ক্লাসটিতে খুব ঘুম আসতো। একদিন মুঠির উপরে থুঁতনি রেখে গেলাম ঘুমিয়ে। সিনিয়র ভাইয়াটি ক্লাসরুমের পাশ দিয়ে যাবার সময়ে দেখে ফেললেন। আর যায় কোথায়, পরিচিত সবার সামনে বলতে লাগলেন, এই হলো আফসানা, এ না ক্লাসে ঘুমায়! তারপর থেকে ক্লাসের পাশ দিয়ে যেতে গেলেই শূন্যে বালিশের আকৃতি দেখিয়ে ইশারায় বলতেন, লাগবে?

যাই হোক, এই গল্প শেষ হবার নয়। এমনই ছিল আমার জাহাঙ্গীরনগর। সম্মানহানি হয়েছিল, নাকি ভালোবাসা প্রাপ্তি হয়েছিল যে ওরকম একটা মুহূর্ত ফিরে পাবার ইচ্ছা আজও মরে না! পরিবার থেকে বেরিয়ে গিয়ে ওখানে পরিবার পেয়েছিলাম।

বিশাল এক পরিবার। বাড়িতে বড় বোন ছিল না, আফসোস ছিল। পেয়েছিলাম শত শত বড় বোন। সারাদিন ধরে বিভাগ, ক্যাফেটেরিয়া, প্রান্তিক কী ডেইরি ফার্ম হয়ে রাত-বিরাতে লেকের পাড়ে আড্ডা দিয়েও গণরুমে এসে নিয়মমতো গোল হয়ে বসতো মেয়েরা। বাড়িতে ফেলে আসা স্বজনের গল্প, কান্নাকাটির আসর, সে আরেকরকম।

বড় আপুরা গণরুমে আসতেন, বলতেন, দেখবা কয়দিন পরে ছুটি হইলেও বাড়ি যাইতে ইচ্ছা করবে না। আর একটা প্রেম হইলে তো কথাই নাই!    

স্মৃতিচারণ অনেক হলো। এখন কিছু কথা যা বেরিয়ে আসার জন্য তাড়না দিচ্ছে। নিজের সমস্যার ব্যাপারে অভিযোগ করতে গিয়ে জাহাঙ্গীরনগর নিয়ে মিডিয়ার কাছে প্রশ্ন তুলেছেন ৪৫ তম আবর্তনের জান্নাতুন নাঈম প্রীতি। প্রশাসনের উপরে আস্থা নেই বলে তিনি তার উপরে হওয়া নির্যাতনের সংবাদ সরাসরি মিডিয়ায় প্রকাশ করেছেন। তার পরপর দুটো লেখা তথা অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে আমি কিছু বলতে চাই।

বর্তমান ছাত্রী হিসেবে তার তবু প্রশাসন আছে, আমার কিছুই নেই। মনটা সেখানে ফেলে আসা ছাড়া জাহাঙ্গীরনগরের সঙ্গে আজ আর আমার কোনো যোগাযোগ নেই। তাই যে মিডিয়ায় এসে তিনি তার অভিযোগের কথা বলে গেছেন, সেখানেই এসে পৌঁছলাম তাকে কিছু প্রশ্ন করার জন্য।

প্রথমেই বলা প্রয়োজন, কোনো সুস্থ মানুষ র‌্যাগিং কর্মকাণ্ডের সমর্থক হতে পারে না। বলাবাহুল্য, নিজেকে সুস্থ দাবি করছি, তাই, আমার প্রাণপ্রিয় জাহাঙ্গীরনগরে তো বটেই, পৃথিবীর যেকোনো স্থানে র‌্যাগিং-এর অস্তিত্বের প্রতি তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি।

প্রীতির অভিযোগ সত্য হলে প্রত্যেকেরই এই নির্যাতনের বিপক্ষে অবস্থান নেয়া প্রয়োজন বলে মনে করি। কিন্তু অভিযোগগুলো পাঠ করতে গিয়ে কোথায় কোথায় হোঁচট খাচ্ছি, সেই বিষয় নিয়ে তার সঙ্গে কথা বলবো।

ju-8পরপর দুই বছর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বর্ষে থাকার অভিজ্ঞতা হয়েছে আমার। না, অকৃতকার্য হইনি, বিভাগ বদলেছিলাম ব্যক্তিগত কারণে। তাই দুটো হল এবং দুটো বিভাগে প্রথম বর্ষে থাকার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা আছে আমার।      

একটু-আধটু ফিকশন লেখার অভ্যাস থেকে জানি, একটি বিষয় পুরোপুরি ব্যাখ্যা না করে দিলে পাঠক তার নিজের মতো করে ভেবে নিতে পারেন। এটা এক ধরনের বহমানতা এবং সম্ভাবনা তৈরি করে। আর লেখক বলেই হয়তো প্রীতি, আপনি পাঠকের জন্য সেরকম সম্ভাবনাময় কিছু শব্দ রেখে গেছেন আপনার প্রথম অভিযোগনামায়, যেমন, ‘নানারকম নির্যাতন’, ‘যন্ত্রণাকর অধ্যায়’, ‘অপমানিত’, ‘নানারকম ভয়ভীতি প্রদর্শন’।

এখানে কি পাঠক হিসেবে একজন তার নিজস্ব যন্ত্রণাকর অধ্যায়, অপমানিত হবার কার্যকারণ, নির্যাতিত হবার অভিজ্ঞতা, ভয়ভীতির হুমকি পাওয়ার ভয়াবহতা, ইত্যাদির সঙ্গে মিলিয়ে যার যেমন খুশি ভেবে নেবে? অর্থাৎ নেয়ার সুযোগ আছে? আপনি যদি তাই চান, তবে আলাদা কথা, সেক্ষেত্রে পাঠকের জীবনের যাবতীয় নির্যাতন আপনার উপরে হয়েছে বলে ধরে নিতে হবে।

আর যদি আপনি তা না চান, তবে আমি আপনাকে অনুরোধ করবো, ব্যাখ্যা করুন যাতে আমরা, যারা না বুঝে কিছু ধরে নিতে চাই না, তারা সঠিকভাবে জানতে পারি। ঠিক কী উপায়ে কী নির্যাতন আপনার উপরে হয়েছে, কী বলে বা করে অপমান করা হয়েছে, ‘নানারকম ভয়ভীতি’ প্রদর্শনের ভাষা, বাক্য বা কাজকে দয়া করে ব্যাখ্যা করুন।

কে বা কারা আপনার সঙ্গে ছয় মাসব্যাপী কোন সময়ে কোন রুমে বা স্থানে সেসব করেছে তার অন্তত কিছু নমুনা দিন। যিনি আপনাকে ধমকেছেন তার যেমন নাম, বিভাগ জানিয়েছেন, তাদের ক্ষেত্রেও একইভাবে নাম, বিভাগ, আবর্তন জানান, যার উপরে ভিত্তি করে আপনার অভিযোগ যথাযথ বলে ধরে নেব, কারণ সেখানে কিছু শূন্যতা বা ভাসা ভাসা কথা দেখতে পাচ্ছি, যেখানে ভেবে নিতে হচ্ছে কী হতে পারে।

আর আগেই বলেছি, সবার ভাবনা এক নয়। র‌্যাগিং কীভাবে হয় বা কাকে বলে, সে নিয়ে কমবেশি ধারণা সবার আছে, সেটা জানা অপ্রয়োজনীয়। অভিযোগ যেহেতু আপনি করেছেন, আপনার সাথে কখন কোথায় ঠিক কী ঘটেছে, সেটুকুর উপরে নির্ভর করে কথা বলতে চাই।

পূর্বপরিচিত এক আপু রুমের পাশে নিয়ে দুটো ধমক দেয়াকে আপনি ‘র‌্যাগিং’ নামে কেন চালাচ্ছেন, সেই ব্যাখ্যাটা জানতে চাই। আপনি কি পাঠকদেরকে র‌্যাগিং-এর আওতায় নতুন কী কী পড়তে পারে তার তালিম দিচ্ছেন? বাড়িতে বড়ো বোনের ধমক খেলে কি তাকে আপনি র‌্যাগিং বলেন? তবে, জাহাঙ্গীরনগরের পারিবারিক আবহটা আপনাকে এতোদিনেও ছুঁতে পারেনি কেন তার কারণটা জানতে ইচ্ছে করে।

কী বলে বা করে আপনাকে ছোটো করা হয়েছে তার ব্যাখ্যাটা জানাবেন দয়া করে। কারণ ‘ছোটো করা’ খুবই অনির্দিষ্ট একটি ব্যাপার। কে, কীসে ছোটো হয়, সে বিষয়ে প্রত্যেকের লম্বা তালিকা থাকা সম্ভব। এরপর, মাত্র ছয় মাসের মাথায় আপনি একটি বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে মিডিয়ায় জানাচ্ছেন, ‘নির্যাতনটা এখানে একটা ট্র্যাডিশন’, এর যথোপযুক্ত ব্যাখ্যা জানা প্রয়োজন।

কত বছরের ট্র্যাডিশন? কী করে জানলেন যে এটা ট্র্যাডিশন? আগে কখনো ওখানে ছিলেন? কাউকে নির্যাতিত হতে দেখেছিলেন? দেখলে, কীভাবে নির্যাতিত হয়েছিলেন তিনি?

আপনার অভিযোগ অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ের যে বা যারা আপনাকে একই কাজ বারবার করে দেখাতে বলেছেন, আপনি করেছেন, আজ যখন আপনি উন্মুক্ত অভিযোগ নিয়ে এসেছেন অথচ সেই মানুষগুলোর নাম, সময় এবং স্থান উল্লেখ করছেন না কেন?

আপনার অভিযোগে ‘সম্ভবত ভয়ভীতি প্রদর্শন করা হয়’ বলেও একটি কথা আছে। বিনীতভাবে জানতে চাচ্ছি, ভয়ভীতি প্রদর্শনের কেবল সন্দেহও কি আপনার লিখিত অভিযোগের অন্তর্ভুক্ত হতে পারে?

আপনি বলতে পারেন, এসব উত্তর আপনি তদন্ত কমিটি তথা প্রশাসনের কাছে দেবার কথা। আমি বা আমরাও সেই আশাতেই ছিলাম। কিন্তু ২৭ অক্টোবর তারিখের অভিযোগের পরে আপনি গত ৪ নভেম্বরে আবার মিডিয়ার কাছে গেলেন একই অভিযোগ নিয়ে, যখন আপনি জানেন বিষয়টির তদন্ত চলছে। আপনি নিজেই কোথাও বলেছেন, ‘… আমাকেও ভাবতে হচ্ছে! কাজেই তদন্তের স্বার্থে আমি চুপ। যা জানানোর তা আমার আইনজীবী, প্রশাসন, তদন্তকারী কর্মকর্তারা এবং আমার স্বপক্ষের সাক্ষীরা জানেন।’

আপনার এই কথায় ভরসা পেয়েছিলাম যে প্রশাসনের উপরে আপনার আস্থা ফিরে এসেছে। অন্য কোথাও আপনি একাধিকবার বলেছেন যে সুবিচার পাবেন বলে আপনার আশা আছে। আমরাও একই প্রত্যাশা করি।  কিন্তু তদন্তের মাঝপথে আপনি যে আবার অভিযোগনামা নিয়ে মিডিয়ায় হাজির হলেন, একে কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?

প্রথম অভিযোগটি হতাশা বা উত্তেজনার বশে হয়ে যেতে পারে, দ্বিতীয়বার প্রশাসনকে তোয়াক্কা না করে মিডিয়ায় আসাটা আপনার ‘সুচিন্তিত পদক্ষেপ’ ছাড়া অন্য কোনো ব্যাখ্যা থাকলে আমাদের জানাবেন। কারণ আমার বোধগম্য নয় যে ‘…যদি এই র‌্যাগিংয়ের কারণে আমি আত্মহত্যা করতাম বা র‌্যাগিংয়ের কারণেই মারা যেতাম…’ এরকম একটি বাক্য বলে তদন্তের দিনগুলোতে আপনি কাকে প্রভাবিত করতে চাচ্ছেন?   

এখন আপনি যদি মনে করেন, প্রশাসনের তদন্ত বা বিচারের মাধ্যমে নয়, একমাত্র মিডিয়ায় আলোচনার মাধ্যমে আপনার প্রতি হওয়া নির্যাতনের বিচার এবং আপনার প্রত্যাশা মতো একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের র‌্যাগিং সমস্যার সমাধান সম্ভব, তবে আসুন আলোচনাই চলতে থাকুক।

আপনার এবারের নতুন অভিযোগনামাটিতে আপনি আপনার বর্ণিত ‘র‌্যাগিং’কে বিশ্ববিদ্যালয়ের হল থেকে ডিপার্টমেন্ট অব্দি নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছেন। আপনি লিখেছেন, ‘যেহেতু জাহাঙ্গীরনগর আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়, সেহেতু আমাকে হলে থাকতে হয় এবং হল থেকে ডিপার্টমেন্টে যেতে হয়। ডিপার্টমেন্টে সম্মিলিতভাবে যে বিষয়টি চলে তার নাম ব্যাচ কল আর হলে যা চলে তাকে বলে সিটিং।’

আপনি হয়তো র‌্যাগিং-এর সংজ্ঞা উদ্ধারে ব্যস্ত, অথবা এই দুটো লাইনের কথা ধরলে, নিশ্চয় এই ব্যাচ কল বা সিটিং আপনার সঙ্গে কখনো হয়েছে। না-হলে এই উল্লেখ কেন? যদি হয়ে থাকে তবে স্থান, সময় এবং কে বা কারা পরিচালনা করেছে তাদের নাম উল্লেখ করুন। যেহেতু ধরে নিচ্ছি আপনি এমনিতে র‌্যাগিং এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হননি, যেমন আমরা সাধারণভাবে বলি, র‌্যাগিং-এর বিরুদ্ধে আমরা, আপনি নিজে ভুক্তভোগী এবং ব্যক্তিগত অভিযোগ নিয়ে উপস্থিত হয়েছেন, সুতরাং দয়া করে আপনার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাটি বর্ণনায় মনোযোগ দিন, যাতে পাঠক হিসেবে আমাদের কোনো দ্বিধা বা সন্দেহের অবকাশ না থাকে। র‌্যাগিং-এর সংজ্ঞা বা প্রকারভেদ আমরা প্রয়োজন পড়লে অন্য কোথাও থেকে জেনে নেব।

আপনার বর্ণনা মতো, ডিপার্টমেন্টের সিনিয়র ভাইদের নাম বলতে পারলেন না বলে লজ্জায় আর অপমানে আপনার মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে হলো। আপনাকে যতটা প্রতিবাদী হিসেবে জানি, নিজের ব্যাচের নয়, অন্য ব্যাচের কারো সামান্য নাম বলতে না পারার ক্ষেত্রে আপনার এই অনুভূতি কি যৌক্তিক? আপনার মতো মানুষের ক্ষেত্রে পরমুহূর্তেই তো এই ঘটনা অবহেলা ছলে ভুলে যাবার কথা। মানে ধরুন, ফিকশনে আপনি আপনার মতো একটা চরিত্র তুলে এনে তার মুখে যদি এই সংলাপ বসান, তবে চরিত্রের ধারাবাহিকতা থাকবে?

আপনি লিখেছেন, ‘আমি মাঝে মাঝে শিউরে উঠি, যদি মাই ফার্স্ট ডে অ্যাট ইউনিভার্সিটি বা মাই ফার্স্ট ডে অ্যাট প্রীতিলতা হল অথবা মাই ফার্স্ট ডে অ্যাট মাই ডিপার্টমেন্ট লিখতে দেয়া হতো তাহলে কী লিখতাম? সিনিয়রদের দেয়া নিমের ডাল চিবানো, শার্ট-প্যান্ট পরতে নিষেধ করা, বুকে ওড়না দেয়া, সালাম দিতে না পারলে ধমক দেয়া, নিজের পরিচয় দিতে না পারলে মামুলি ভেবে বিশ্রী গালি দেয়া, গান গাইতে ইচ্ছে না হলেও গান গাইতে বাধ্য করা, ইচ্ছে না করলেও মনোরঞ্জনের জন্য পাঁচ রকম হাসি, দশ রকম কান্না কেঁদে দেখানো ইত্যাদি…’ আমি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যাচ্ছি, আপনার সাথে কেবল প্রথম দিনেই এতোগুলো ঘটনা ঘটে গেল!

আপনি, জান্নাতুন নাঈম প্রীতি, নিজের পরিচয় দিতে ব্যর্থ হলেন? এবং সেটা ঘটলো বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে, আবার ডিপার্টমেন্টেও? কখন তবে আপনাদের ওরিয়েন্টেশন ক্লাস হলো? কেবল ওই সমস্ত ঘটার জন্যেই তো দিনের বেশ অনেকটা সময় লেগে যাবার কথা। নাকি ওগুলোই একমাত্র রুটিন ছিল প্রথম দিনের?

আচ্ছা, অন্যগুলোর কথা বাদ দিন, নিমের ডাল আপনাকে কে কখন আর কোথায় চিবোতে দিয়েছিল, এতো তিতে স্বাদ ভোলার তো কথা নয়, মনে করে তার বা তাদের নাম উল্লেখ করুন দয়া করে। আমি কৌতূহল রাখতে পারছি না, আর আমাকে এ-ও জানতে হবে যে আমার জাহাঙ্গীরনগরে কি আজকাল নানান ছায়াবৃক্ষ বাদ দিয়ে কেবল নিমের গাছই রোপণ করা হচ্ছে?

এতোসবের বাইরেও আপনি উল্লেখ করেছেন যে ভিসি ম্যাডাম সেদিন এসেছিলেন, র‌্যাগিংকে ‘জিরো টলারেন্স’ বলে গেছেন। পরমুহূর্তেই আপনার আক্ষেপ যে তার ছায়াটিও আপনি আর দেখেননি। এই অভিযোগের আগে আপনি বলুন, আপনি কি আশা করেন যে ভিসি ম্যাডাম ক্লাসে আর হলের রুমের আশেপাশে টহল দিয়ে পাহারা দেবেন?

আমাদের যেখান থেকে স্বপ্ন রঙিন হতে শুরু করেছিল, প্রীতি, আপনি ঠিক সেইখানে গিয়ে বলছেন, আপনার স্বপ্ন সাদাকালো হয়ে যাচ্ছে। প্রথম ছয় মাস তো জাহাঙ্গীরনগরে উড়ে যাবার কথা। লেক, জঙ্গল, মানুষ আর পাখি থেকে তো চোখ সরতেই বছরখানেক লেগে যায়, তারপর হলো গিয়ে পড়াশোনা। এর মাঝে মানুষের বলা কথা, কে, কী ভাবছে বা করছে, এসব নিয়ে ভাবার সময় পাওয়া অবিশ্বাস্য ব্যাপার। মানে, আমরা তো পাইনি। এখনো ভাবি সেই প্রথম দিককার কথা, এই যে চোখ বুজলেই বুঝতে পারি শীত শীত আবহাওয়া ঘিরে ফেলছে জাহাঙ্গীরনগরকে, একটা দুটো করে পাখি আসতে শুরু করেছে, কেউ পাখি উড়িয়ে ছবি তুলতে চাইলে সেলিম আল দীন স্যার তাকে চিৎকার করে বকা দিচ্ছেন… দৃশ্যের পরে দৃশ্য, অদ্ভুত ভালোলাগার এক অধ্যায় আমার জাহাঙ্গীরনগর।

যাই হোক, আমার বা অন্য অনেকের সঙ্গে যা হয়নি তা যে আপনার সাথে হতে পারে না এমন ভ্রান্ত ধারণা নিয়ে আমি বসে নেই। সুতরাং আপনি এই প্রশ্নগুলোর ধারাবাহিক উত্তর দিলে কৃতার্থ হবো। আর প্রত্যাশা করবো যেন প্রতি সপ্তাহে উইমেন চ্যাপ্টারে আপনার অভিযোগের ডালপালা ছড়ানো দেখতে না হয়, আপনার সমাধান প্রশাসনে না মিডিয়ায়, তা আপনি অনুধাবন করতে পারেন।

আরো প্রত্যাশা থাকবে, অন্যায় হয়ে থাকলে দ্রুত বিচার পেয়ে যান আপনি। অন্য কথা, একজন পাঠক হিসেবে লেখক আপনাকে আমার ব্যাপক সম্ভাবনাময় মনে হয়েছিল। এখনো মনে আছে বইমেলায় আপনার বইয়ের স্টলে আপনি আসবেন শুনে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম। আপনার মধ্যে যে তারুণ্য বা প্রাণ আছে, তা মুগ্ধ হয়ে দেখবার মতো। তাই আপনার মতো একজনের কাছে আশা করবো, অভিযোগগুলো স্থান-কাল-পাত্র হিসেবে সুনির্দিষ্ট করুন, পাঠকদের কাছে খোলাসা করুন, যাতে যা হয়েছে তার চেয়ে কম ভাবার বা যা হয়নি তা ভেবে নেবার কোনো সুযোগ তৈরি না হয়।

afsana-begum
আফসানা বেগম

আমার স্বার্থ একটিই, আমি আমার জাহাঙ্গীরনগর বা সেখানকার কাউকে নিয়ে ভুল বোঝাবুঝি দেখতে চাই না। দেখতে চাই না আপনার ধোঁয়াশা অভিযোগের প্রেক্ষিতে আমার জাহাঙ্গীরনগরের সঙ্গে সম্পর্কহীন একদল লোক দিনরাত তার প্রতিটি বর্গ-ইঞ্চি  ব্যবচ্ছেদ করছে। যে পরিবার ছেড়ে এসেছি, তাকে এখনো অন্তরে লালন করি তো, তাই বড়ো ব্যথা লাগে। আপনার মতো এমন গুণী জুনিয়র পেলে কোলে তুলে রাখতাম।

যে পারিবারিক আবহ সেখানে আছে, তাতে এমনটাই হবার কথা আপনাকে ঘিরে। তাই আমাকে জানতে হবে, এই কয়েক বছরে আমার জাহাঙ্গীরনগর কী এতোটাই বদলে গেছে যা আপনি দাবি করছেন, অথবা বদলে গেছে আমাদের নতুন প্রজন্মের দৃষ্টিভঙ্গি, যে বিষয়ে আমি নিশ্চিত হতে চাচ্ছি।

শেষ কথা, এই যে আপনি কিছুদিন ধরে জাহাঙ্গীরনগরের ভিতরের বিষয় নিয়ে এবং বিষয়ের গভীরে না গিয়ে ভাসা ভাসা বর্ণনায় সুলভ মিডিয়ার মাধ্যমে আমার মতো জাহাঙ্গীনগর-অন্তঃপ্রাণ কিছু মানুষকে মানসিক নির্যাতন করে চলেছেন, এই বিষয়ে আপনার বিরুদ্ধে মানসিক নির্যাতনের অভিযোগ আমি কেন আনবো না সেটি অনুগ্রহপূর্বক পরিষ্কার করে জানাবেন।

এসব ভুলতে যা নিয়ে পড়ে থাকি…  আমার জাহাঙ্গীরনগরের কোনো বিকেল কিংবা সন্ধ্যা। মনে পড়ে সন্ধ্যায় ক্যাফের বারান্দায় দলবেঁধে বসে আছি, কোনো ব্যাচের র‌্যাগ অনুষ্ঠান চলছে ওদিকে মুক্তমে, এদিকে সিনিয়রদের মাঝখানে তাদের সঙ্গে গল্পে আমি মশগুল। নাম না বললে শান্তি লাগছে না, ডালিয়া আপা, বেবি আপা, রাজু ভাই, আরো কত মানুষ… প্রথম বর্ষের আমার মতো একজনের কথা তাদের মনে থাকার কথা নয়, কিন্তু তাদের উচ্ছলতা আমার স্মৃতিতে স্পষ্ট। অর্ঘ্য ভাইয়া ডেকে বলছেন, ‘আফসানা, বাসন্তী হে ভুবনমোহিনী গান ধরো’ কেউ গলা মেলাচ্ছেন। শেষ হলে বলছেন ‘আবার আবার!’ চলছে গান-আড্ডা… সে এক স্বপ্নময় সময়; কেবল স্মৃতিতে ফিরে ফিরে আসে।

২২ তম আবর্তন, ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগ, জাহানারা ইমাম হল। 

শেয়ার করুন: