লীনা পারভিন: ছোটবেলায় আমি কুমিল্লার যে এলাকাটিতে বড় হয়েছি তার নাম ছিলো ঠাকুরপাড়া। নাম শুনেই বুঝতে পারছেন। আমার বাসার আশেপাশে ছিলো অনেক মাসীমা, দিদিদের বাসা। বাসার জানালার পাশে ছিলো একটা বড় মাঠ। মাঠের পরেই ছিলো হিন্দুদের একটি বড় এতিমখানা আর বিশাল মন্দির। বাসার আরেকপাশে ছিলো একটি পুকুর। সবাই জানে কুমিল্লা পুকুরের শহর। সেই পুকুরে আমি সাঁতার কেটেছি অনেক। আরেকটু সামনে হেঁটে গেলে টলটলে পানির দীঘি। মাঝে মাঝে সাঁতার শিখার জন্য বড় ভাইয়ের হাত ধরে সেই দীঘিতে গোসল করতে যেতাম। দীঘির পাড়েই ছিলো শ্মশান ঘাট যেখানে মরা পোড়ানো হতো। সেই শ্মশানের পাশেই ছিলো নজরুলের স্ত্রী প্রমিলা দেবীর সমাধি ফলক।
যে দীঘিতে গোসল করতাম সেখানে হিন্দুরা পূজা করতো। লাশ পোড়া ছাঁই ফেলা হতো। পরিষ্কার মনে আছে আমি তখন ছোট। ক্লাশ ফোর বা ফাইভে পড়ি। প্রতি সন্ধ্যায় জানালায় বসে মন্দিরের সান্ধ্য কীর্তন শুনতাম। খেলার মাঠে এতিমখানার ছেলেরা খেলতে আসতো তাদের খেলা দেখতাম। জীর্ণশীর্ণ শরীরের ওদের মা-বাবা নেই জানার পর আমার খুব মায়া হতো ওদের জন্য। আমিও মাঝে মাঝে খেলতে যেতাম। গল্প করতাম ওদের সাথে। জানতাম ওদের খাবারের কষ্ট, কাপড়ের কষ্ট, মন্দিরের সকল কাজ ওদের নিজ হাতে করতে হতো। কেউ জানতো না তাদের পরিবার কী, কোথা থেকে এসেছে। সেই এতিমখানা আর আমাদের বাসার মধ্যে এমন দূরত্ব এ ওদেরকে কেউ যখন বেত দিয়ে মারতো তাদের কান্নার আওয়াজ আমরা শুনতে পেতাম। সেই দরিদ্র, শুকনামতো বাচ্চাগুলোকে কে পিটাচ্ছে সেটা কল্পনা করে আমার খারাপ লাগতো।
তবে পূজার সময় আমার অন্যতম কাজ ছিলো সকালবেলা উঠেই পড়াশুনা শেষ করে মন্দিরে চলে যাওয়া। একা একাই এই মণ্ডপ থেকে মণ্ডপে ঘুরে বেড়াতাম। সবাই যা করে আমিও তাই করতাম। তবে প্রসাদ দিতে আসলেই আমি পালাতাম কারণ এক হাতে চিড়া, দই, কলা, মুড়ি, নারকেল অমন একটি বোলে যেমন করে মাখাতো সেটা দেখেই আমার মন সায় দিতো না খেতে। কিন্তু কখনো মনে আসেনি হিন্দুর খাবার বলে খাচ্ছিনা। আমাদের পাশের বাসায় একজন পুরোহিত আর তার অসম্ভব সুন্দর বউ থাকতেন। বাসাটা ছিলো মাটির। কিন্তু দেখতে আমাদের বিল্ডিং এর চেয়েও সুন্দর পরিপাটি।
মাসীমা সকালবেলা উঠে স্নান করে সাদা ধবধবে লালাপাড়ের শাড়ী পরে পাশের গাছ থেকে লাল টুকটুকে জবা ফুল নিয়ে এসে পূজা করতে বসতেন। আমরা খুব শ্রদ্ধা করতাম ওই বয়স্ক দুইজন লোককে। খুব দরিদ্র ছিলেন উনারা। কেউ আজকাল আর পুরোহিতকে সেভাবে ডাকে না বলে আয়-রোজগার কম। শুনেছি এক সময় তাদের বিপুল বিত্ত ছিলো। মাসীমা কাঁসার থালাবাটি পুকুর থেকে ধুয়ে আনতেন। আমার মাকে দেখতাম প্রতিদিন বিকেলে মাসীমার কাছে গল্প করতে যেতেন। কী সৌহার্দপূর্ণ সেই সম্পর্ক। আমি সবসময় একটু বেশী কৌতুহলী। প্রশ্ন বেশী করি। তাই সকাল বা বিকাল যখনই টাইম পেতাম সান্ধ্য পূজা দেখতে যেতাম। ভিতরে যাওয়া নিষেধ ছিলো তাই জানালা দিয়ে দেখতাম।
ঠাকুরপাড়া আজো আছে কিন্তু সেইসবের কিছুই নাই। সব জায়গা জমি দখল হয়ে উঠেছে বড় বড় বাড়ী ঘর আধুনিক ফ্ল্যাট। আমার স্মৃতির সেই পুকুর, দিঘী বা শ্মশানঘাট আর নেই। সন্ধ্যার সেই কীর্তন আর হয় না। আমার বেড়ে উঠায় সেই মিশ্র সংস্কৃতির অনেক প্রভাব। সেই কীর্তন আমার শ্রবণ যন্ত্রকে তৈরী করেছে। সেই খেলার মাঠের স্মৃতি আমাকে ছেলে বা মেয়ে নয় সবাই খেলার সাথী এই বিবেচনাবোধের জন্ম দিয়েছে। পূজা দেখার স্মৃতি আমাকে সকল ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে শিখিয়েছে। আমার মা আর পুরোহিত বউয়ের গল্প ও আন্তরিক মিলামেশা আমাকে সামাজিক হতে শিখিয়েছে। আজকের দিনের ছেলেমেয়েরা কী পাচ্ছে এইসবের কিছু? পাচ্ছে না। শহুরে আটপৌড়ে জীবনে আমরা কেবলি স্বার্থপর হতে শিখছি। অন্যের ব্যথায় আমি ব্যথিত হতে ভুলে যাচ্ছি। কেউ খাবার পাচ্ছে না, কিন্তু আমার সামনে অঢেল খাবার। আমার একটুও খারাপ লাগছে না।
খেলার মাঠই নেই আর খেলার সাথী কই পাবো? আজকাল আমরা ইনডোর গেইমে অভ্যস্ত। আউটডোরে খেলার সুযোগ নেই থাকলেও তাতে আছে নানা বাধা বিপত্তি।
ক্রমশঃ আমরা হয়ে যাচ্ছি চারদেয়ালে বন্দি। এই বন্দিত্ব আমাদেরকে আবেগী হতে দেয় না। অন্যের কান্নায় গলা মিলাতে আহবান করে না। আজকের দিনে যখন আমাদের সন্তানদের বিকৃতি দেখি তখন এই বিষয়গুলো আরো বেশী করে পীড়া দেয়। মনে হয় কোথায় যেন গ্যাপ তৈরী হচ্ছে আগামী প্রজন্মের সামাজিকীকরণের শিক্ষায়। তাদেরতো এখন নিজের পরিবারের প্রতি মায়া মমতা কাজ করে না, পাড়া প্রতিবেশী বা আড়া পাড়াগাঁয়ের খবর আর কী রাখবে? অনুভুতিহীনতা গড়ে উঠছে চারপাশে। তাইতো আমাদের সামনে বেড়েই চলেছে নারী নির্যাতন, শিশু নির্যাতন, সাম্প্রদায়িক নির্যাতনের মতো ঘটনা।
আজকে চারদিকের এই অরাজকতায় আমি অসুস্থবোধ করি, আর হারিয়ে যাওয়া অতীতকে খুঁজে ফিরি। খুঁজতে খুঁজতে চারদিকে কেবল হতাশাই পাই। আশা ভরসা কেবল দিনেদিনে হাতের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। তবে আমি মানুষের শক্তিতে বিশ্বাস করি। তাই মানুশই পারে সব কিছু পালটে দিতে। দরকার কেবল আমাদের সদিচ্ছা আর ফিরে পাবার আকুতি।