আমি ভিখু হয়ে আসি বার বার

মনিজা রহমান: আপনাদের মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রাগৈতিহাসিক গল্পের কথা মনে আছে? ওইদিন সন্ধ্যায় প্রচণ্ড বৃষ্টির মধ্যে সাবওয়ে স্টেশনে দাঁড়িয়ে ছিলাম। এক সময় দেখলাম- এক জোড়া হোমলেস নারী ও পুরুষ, বৃষ্টি-বজ্রপাত থেকে বাঁচার জন্য নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে যাচ্ছে। দৃশ্যটা দেখে হঠাৎ আমার কেন জানি ভিখু আর পাঁচীর কথা পড়ে গেল।

ওইদিন ছিল রোববার। ‘একটি কবিতা সন্ধ্যা’ অনুষ্ঠানে যাবো। জ্যাকসন হাইটস সাবওয়ে স্টেশনে ঢোকার মুখে প্রচণ্ড বেগে বৃষ্টি শুরু হলো। সেইসঙ্গে বজ্রপাতের শব্দ। স্টেশনে ঢুকে ভীষণরকমের দ্বিধা-দ্বন্দ্বের মধ্যে পড়ে গেলাম।  যাবো কী যাবো না, বুঝতে পারছিলাম না!

monija-2
মনিজা রহমান

পারসন বুলভার্ডে নেমেও অনেকখানি পথ হেঁটে যেতে হবে। আমি না হয় ভিজলাম, কিন্তু আমার ছয় বছর বয়সী শিশু পুত্র, ওকে নিয়ে কী করবো, ওর তো ঠাণ্ডা লেগে যেতে পারে। প্রায় আধ ঘন্টা দাঁড়িয়ে ছিলাম দ্বিধাগ্রস্ত অবস্থায়। সেই ভাবনার মাঝে সাবওয়ে স্টেশনের দরজার কাঁচ দিয়ে দেখলাম ওই নর-নারীকে।

জীর্ণ-দুর্গন্ধময় হলেও ওদের পরার জন্য, শোবার জন্য সামান্য কিছু কাপড় আছে। আছে একটা বিশাল কুকুর। শীত-বৃষ্টি থেকে নিজেকে রক্ষা করার পলিথিন। সবকিছু গুছিয়ে ওরা প্রস্তুত হচ্ছে একটা উষ্ণ আশ্রয়ে যাবার জন্য। যেভাবে একদিন পাঁচীর সঙ্গীকে হত্যা করে, তার সমস্ত টাকা লুট করে, পায়ে ঘা-যুক্ত পাঁচীকে পিঠে নিয়ে ভিখু রওনা হয়েছিল নতুন জীবনের খোঁজে।

কেউ যদি আমাকে প্রশ্ন করেন, তোমার বাংলা সাহিত্যে সবচেয়ে প্রিয় চরিত্র কোনটি? আমার উত্তর হবে- ভিখু। প্রশ্ন করতে পারেন, এমন নোংরা, প্রবৃত্তির তাড়নায় উন্মক্ত, পশুর মতো একজন মানুষ কীভাবে প্রিয় চরিত্র হয়? ভিখুর মধ্যে আসলে আমি খুঁজে পাই মানুষের আদিমতম রূপ। যার মধ্যে কোন ভান নেই। নেই ভদ্রতার মুখোশ।

যে পেহলাদ ডাকাত ভিখুকে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরিয়ে আনে, সুস্থ হয়ে ভিখু তার স্ত্রীর প্রতি লালসার হাত বাড়িয়ে দেয়। তারপর, ধর্ষণের চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে পেহলাদের উত্তম-মধ্যম খেয়ে বাড়ী ছেড়ে পালায় ভিখু। মাঝরাতে এসে পেহলাদের বাড়ীতে আগুন লাগায়। এই না হলে মানুষ! পৃথিবীর সবচেয়ে অকৃতজ্ঞ জীব!

ভিখু ভালোবাসতো ভাঁড়ভর্তি তাড়ি খেতে। বেশ্যাপল্লীতে গিয়ে উন্মুক্ত রাত্রি যাপন করতে। গভীর রাতে গৃহস্থের বাড়ীতে গিয়ে সবাইকে মেরে কেটে টাকা-গয়না লুট করতে। স্ত্রীর সামনে স্বামীকে, মায়ের সামনে পুত্রকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে তাদের আর্তনাদ উপভোগ করতে। পুলিশের ভয়ে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে লুকিয়ে থাকতে হতো, বনে-জঙ্গলে বাস করতে হতো- তবু সেই পাশবিক-উদ্দাম জীবন ছিল ভিখুর প্রিয়। মানুষ খুন করতে তার ভালো লাগতো। কিন্তু একটা হাত অকেজো হয়ে যাওয়ায় এতো বড় বুকের পাটা নিয়েও সে হয়ে যায় ভিক্ষুক।

তবু, কামনা-বাসনা ভিখুকে ছাড়ে না। তার চোখ পড়ে পাঁচীর ওপর। যার পায়ে বিশাল এক ঘা। সেই ঘায়ের ভ্যাপসা পঁচা দুর্গন্ধে বাতাস দুষিত হয়। তবু জৈবিক তাড়নায় সেই পাঁচীকে ভাগিয়ে নিয়ে সে পালায় নতুন জীবনের খোঁজে। ভিখুর মতো পাঁচী দ্রুত হাঁটতে পারে না পায়ের ঘায়ের জন্য। ভিখু ওকে পিঠে তুলে নেয়।

homelessযে হোমলেস নর-নারীর কথা বলছিলাম, তাদের এখানে সবার চেনার কথা। জ্যাকসন হাইটসের রুজভেল্ট এভিনিউয়ের কাছে ৭৪ কিংবা ৭৫ স্ট্রিটে গেলে মেয়েটিকে আপনি দেখতে পারবেন। ময়লা পোষাক পরে নির্বিকারভাবে বসে থাকে। সামনে ওয়ান টাইম প্লেটে থাকে কিছু বাসী খাবার। হয়তো কেউ দিয়ে গেছে। এত বাজে খাবার যে কুকুরটাও খায় না। সারাদিন ফুটপাতে বসে থেকে মেয়েটা কতো ডলার পায় জানি না। তবে অনেক রাতে ভিক্ষায় পাওয়া ডলার দিয়ে ও বিয়ার কিনে খায়।

৭৩ স্ট্রিটে ডাইভারসিটি প্লাজার ওখানে ওর সঙ্গী ভিক্ষা করে। দেখে মনে হয় কোনদিন গোসল করেনি। ময়লা হলুদ দাঁত। কেমন পাগলের মতো এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করে। গলায় লাল ঘায়ের মতো আছে। দিনশেষে তারা একত্রিত হয়। যত কুৎসিতই হোক, একটি উষ্ণ শয্যার জন্য ওরা অপেক্ষা করে থাকে। এই দুই হোমলেস নর ও নারীর মধ্যে যে সম্পর্ক আছে, আমি জানতাম না। ওইদিন বৃষ্টিমুখর সন্ধ্যায় ওদের প্রণয়ের কথা জানলাম।

এতো গেল অসুন্দরের সুন্দর রূপ। কিন্তু যে ভিখু পেহলাদের স্ত্রীর প্রতি লালসার হাত বাড়ায়, সে কিন্তু আবার জন্মায়। এবার সে জন্মায় সাইফুল ইসলাম হয়ে। সে এবার পাঁচ বছর বয়সী শিশু কন্যার প্রতি পাশবিক আচরণ করে। যে ভিখু আশ্রয়দাতার ঘরে মাঝরাতে আগুনে দেয়, সে আবার জন্মায়, এবার সে সংখ্যালঘুদের মন্দিরে আগুন দেয়, বাড়ী-ঘর লুট করে।

ভিখু বার বার জন্ম নেয় মানুষের আদিম রূপ নিয়ে।

প্রাগৈতিহাসিক গল্পের শেষ লাইনগুলো আমি বার বার পড়ি আর শিহরিত হই। কথাগুলো এইরকম- ‘হয়তো ওই চাঁদ আর এই পৃথিবীর ইতিহাস আছে। কিন্তু যে ধারাবাহিক অন্ধকার মাতৃগর্ভ হইতে সংগ্রহ করিয়া দেহের অভ্যন্তরে লুকাইয়া ভিখু ও পাঁচী পৃথিবীতে আসিয়াছিল এবং যে অন্ধকার তাহারা সন্তানের মাংসল আবেষ্টনীর গোপন রাখিয়া যাইবে তাহা প্রাগৈতিহাসিক, পৃথিবী আজ পর্যন্ত তাহার নাগাল পায় নাই, কোনোদিন পাইবেও না।’

আসলেই তো, মাতৃগর্ভ থেকে মানুষ যে অন্ধকার সংগ্রহ করে এনেছিল, সেখান থেকে কতখানি আলোকিত হতে পেরেছে সে? আদৌ কি পেরেছে? আমরা সভ্যতার বহু উপকরণ আবিষ্কার করেছি। কিন্তু আসলে সভ্য হতে পারিনি। রয়ে গেছি প্রাগৈতিহাসিক যুগেই।

শেয়ার করুন: