চেনা অপরিচিতা: বিশ্ববিদ্যালয়। একটা নতুন জগতের দুয়ার খুলে গেল যেন। আম্মা আগেই বলছিল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারলে পারবা, নাইলে নাই। আমি পেরেছিলাম। প্রথম তিনশ এর মধ্যে আমার জায়গা ছিল। যেদিন প্রথম ক্লাসে গেলাম সেদিন আম্মা সাবধান করে দিলেন, যাতে অতীতের মতো বোকামি না করি। ওড়না দিয়ে বুক সাবধানে ঢেকে রাখা কতটা জরুরি, ছেলেদের চোখ ভালো না এসব জানলাম। এতদিন কো- এড এ পড়িনি, তাই এসব ভাবতে হয়নি।
আর আমি নিজের কাছে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম আমি কোনো সম্পর্কে জড়াবো না। নিজের দৈহিক অবয়ব আর চেহারা নিয়ে খুব উঁচু ধারণা কখনই ছিল না। তাই যখন ছেলেদের চোখে কথায় প্রশংসা আসতো, আমি খুশির থেকে অবাক হতাম। একটা ছেলে রোজ হল থেকে ভোরে ফোন করে আমার ঘুম ভাঙ্গাতো। তখন মোবাইল ছিল না। ল্যান্ড ফোনে হলের ফোনবুথ থেকে ফোন করতো। বাসায় যে হালকা প্রশ্ন উঠতো না, তা নয়, তবে ভাললাগা তখন পেখম মেলছিল। কথায় ঠাট্টায় দুষ্টুমিতে ভাললাগাগুলো প্রজাপতি হয়ে উড়ে বেড়াতো। আমার চোখ কখন যে তাকে খোঁজা শুরু করলো বুঝতে পারিনি। যখন খুঁজে পেতাম না সবকিছু বিরস লাগতো। যখন দেখতাম, কলাভবন রোদে ঝলমল করতো। ছেলেটা একদিন বলে ফেলল, ভালবাসে। কিন্তু আমি কখনও বলতে পারিনি।
এক বিকেলে বাসায় এলো। বিকেল চারটা থেকে রাত আটটা গল্প করলাম ড্রয়িং রুমে। তারপর ভেতর থেকে আম্মা ডেকে পাঠালো। বাড়িতে এক দূর সম্পর্কের খালাও ছিলেন। ভেতরে গিয়ে দেখলাম আম্মা বিছানায় বসে সময় নিয়ে পানি খাচ্ছে। আমার খালাও ছিলেন, পরে খালি গ্লাস নিয়ে চলে গেলে আম্মা যা বললো তার সারমর্ম হ’লো আমার কী কোনো সেন্স নেই, এতোক্ষণ ধরে আলাপ করছি! বাড়ীতে গ্রামের ঐ খালা আছেন। উনি কী ভাববে আর বাড়ীতে গিয়ে কী বলবে!
আরও অনেক কথা, যেগুলো শুনে আমার কান আর গাল ভয়ে লজ্জায় লাল হয়ে গেল। ভয়ে এজন্য যে আম্মা ছেলেটিকে বিদায় দিতে বলেছে। সেটা আমি কিভাবে করবো? ও আমাকে ভালোবাসে, আমি সেটা জানি। সেখানে কদর্য কাম কখনো দেখিনি। স্বপ্নিল চোখে ও আমায় দেখে। যেভাবে আমরা শরতের আকাশ দেখি সেভাবে। ওকে অপমান করবো কীভাবে?
এতো বছর পরে যখন পেছন ফিরি, তখন দেখি, যে ছেলেগুলো আমার প্রেমিক হয়ে আসতে চেয়েছিল তাদের ভীষণ নীচভাবে আমার সামনে তুলে ধরা হতো। তাদের পিতৃ পরিচয়, তাদের আর্থিক অবস্থান, আমার রুচি, আমার নজর এগুলো মনুষ্য বর্জ্যের চেয়ে খুব একটা উঁচুতে স্থান পেতো না। চরম আঘাত লাগতো। যে মানুষটিকে ভাল লাগছে , যাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে মন চাইছে, এসব কথায় লজ্জাবতীর ছোট্টো চারাটিকে কেউ যেন হাই হিল পরে থেঁৎলে দিত।
শুধু তাই নয়, অনেককে আপত্তিকর ও অস্বস্তিকর প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হতো। প্রথম পরিচয়ে যদি প্রশ্ন করা হয়, “তোমরা ভাড়া বাড়ীতে থাকো, না নিজের বাড়ীতে?” তা কারও আত্মসম্মানে আঘাত লাগাতেই পারে। ঘটনা আর কথাগুলো হয়তো সূক্ষ্ম। তবে এর প্রভাব গাঢ়। আমি কাউকেই কথা দিতে পারিনি। মা, বাবা, তাদের চাওয়া, আর আমার ইচ্ছেগুলোর তাল মেলাতে অপারগ ছিলাম।
থার্ড ইয়ারে থাকতে ইন্টারনেট আর ফোনে একজনের প্রেমে পড়ে যাই তুমুলভাবে। সেই মানুষটি যেভাবে নিজেকে উপস্থাপন করে তাতে আমার তো বটেই, বাবা মা’রও চোখ কপালে উঠতে বাধ্য। সে বিবরণ না হয় নাই দিলাম। তার সাথে দেখা করা হয়নি। বাসায় আসতে বলতো। আমার এভাবে যেতে ইচ্ছা করতো না। বন্ধুরা ভালবাসায় প্রশ্রয় দিলেও এ ব্যাপারটি নিষেধ করতো।
একটা সময় সেই মানুষটি নানান ছলে মুখ ফিরিয়ে নেয়। সে অনেক বড় একটা গল্প। কেন যেন বলতে ইচ্ছা করছে না। তবে তার প্রভাবে আমার মনোজগৎ এলোমেলো হয়ে যায়। আমি রাতে জাগি, দিনে ঘুমাই। আম্মার ঘুমের ওষুধ লুকিয়ে খাই। বাসায় যখন কেউ থাকে না, তখন চীৎকার করে কাঁদি। আম্মার সামনে খুশী থাকার অভিনয় করি। কারণ আমি জানি, আম্মা জানলে কী হতে পারে! নতুন কোন ঝড় মোকাবেলার শক্তি আর ছিল না। তবুও আম্মা বুঝে যেত। সন্দেহমূলক প্রশ্ন, তাতে যথারীতি সহানুভূতির ছিটেফোঁটা থাকত না। সত্যি বলতে , আমি আশাও করতাম না আমার মায়ের কাছ থেকে। কারণ , আমি জানি আমার মা কেমন। তবে আমার ঐসময় মাতৃ সুলভ একটা হাত, মাথায়-পিঠে বড্ড প্রয়োজন ছিল। আমার ভাই জানতো, সে সান্ত্বনা দিত। আর দিত আমার বন্ধুরা। ওরা না থাকলে হয়তো পাগল হয়ে যেতাম!
সুন্দর কিছু অনুভূতি ছিল সে সময়। নোংরা কোন অনুভূতি কাজ করতো না। বিয়ে, যৌনতা, সন্তান, লিপস্টিকের রং, নতুন কাপড়ের খবর, এসব থেকে দূরে থাকতাম। আমার বা আমার পারিবারিক আবহ এমন ছিল না। আমি মনে করতাম এবং এখনও করি একটি মেয়ের পায়ের নিচের মাটিটা শক্ত হওয়া প্রয়োজন। অর্থনীতিক এবং শিক্ষাগত ভাবে। বিয়েই প্রথম লক্ষ্য হওয়া উচিৎ নয়। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার যে বান্ধবীটি কাছের ছিল সে এমন ভাবত না। এরকম আরও অনেক ছেলে মেয়ে ছিল। তাদের কাছে তর্কে আমি একদিন হেরে গিয়েছিলাম। আমি এরপর ওদের এড়িয়ে চলতাম। বিবাহিত মেয়েদের কথা জুড়ে শুধুই সাংসারিক আলাপ, স্বামী সন্তান, শাশুড়ি, শাড়ী, কাপড়, মার্কেট। একদম ভাল্লাগতো না। আমার ভালো বন্ধু হয়ে উঠল ছেলেরা।
আমি সাজতাম না। আমি পড়াশোনা, ক্লাস শেষ করে বাড়ী ফিরতাম। আমার গান, আমার অভিনয়ের স্কুল, কম্পিউটার ক্লাস এসবে সময় দিতে হতো। বিপত্তি হ’লো অনার্সের রেজাল্ট বেরুনোর পর।
আসলে, ফার্স্ট ইয়ারে যে নম্বর গ্যাপটা হয়েছিল সেটা অন্য ইয়ারে সার্বিক ভাবে কভার করতে পারিনি। প্রতি বছর রেজাল্ট বেরুনোর পর বুকটা ধুকপুক করত। আমার টেনশন দেখে এক সহপাঠী সহজ হাসিতে জিজ্ঞাস করল, “এতো টেনশন করছ কেন”। আমি তো তাকে বোঝাতে পারবো না আমার বাসার অবস্থা ওর মত নয়। ওর প্রেম যেখানে পরিবার স্বীকৃত সেখানে আমার মেয়েলী কোন ছেলের সাথেও এক রিক্সায় বসা নিয়ে তূলকালাম অবস্থা।
আমসি মুখে বাড়ী যেতাম। সইতে হতো অনেক কথা। আপ্রাণ চেষ্টা করেছি। তবু, ফার্স্ট ক্লাস মিললো না। সেটার অনেক কারণ ছিল, সেগুলো না হয় নাই বললাম। তবে, দুজন শিক্ষকের আমাদের এক সুন্দরী সহপাঠীর প্রতি বিশেষ অনুরক্ততা ডিপার্টমেন্টে ভেসে বেড়াতো যে আগের ইয়ারে ফেল করেছিল এবং আমাদের সাথে সে দুটো সাবজেক্টে টপ করেও অন্য সাবজেক্টে ফেল করে।
যাই হোক, আমার মা ঘোষণা দিলেন, যেহেতু ফার্স্ট ক্লাস জোটেনি আমার মাস্টার্স পড়ার দরকার নেই।
(চলবে…)
লেখার বাইরের লেখা: আমার আগের লেখায় অনেকের অনেক প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করেছি। আমার লেখার উদ্দেশ্য আমার বাবা মা কে ছোট করা নয়। আমি যা, যতোটুকু তা তাদের কারণেই। বিশেষ করে আমার মা আমার জন্য কতটা করেছেন তা আমার পরিচিত সকলেই জানেন। যা জানেন না তা তুলে ধরেছি। এখানে কেবল যৌন হয়রানির গল্প খুঁজলে সময়হানী হতে পারে। একটা মেয়ে শারীরিক, মানসিক আরও নানান ভাবে বঞ্চনার শিকার হয়। সেগুলো ধাপে ধাপে আসবে। হয়তো আমার মতো বা আমার চেয়ে আরও ভুক্তভোগী সন্তান রয়েছেন। হয়তো রয়েছেন অনেক বাবা-মা। আমার লেখায় কেউ যদি কোন শিক্ষা লাভ করে থাকেন, সেটাই আমার লেখার সার্থকতা। অন্যথায় কেউ আঘাত পেয়ে থাকলে আন্তরিকভাবে দুঃখিত।