সংখ্যাগুরুর সংখ্যালঘু বলছি

সোনিয়া আশরাফী: সংখ্যালঘুরা যে আজ কতটা নিরাপত্তাহীনতা এবং মর্মবেদনায় জর্জরিত তা প্রতিদিন, প্রতিরাতে স্পষ্ট হয়ে উঠছে এই বাংলাদেশে। যে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে প্রতি নাগরিককে তার যোগ্য ও প্রাপ্য মর্যাদা দেয়ার জন্য।

attack-3ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ঘটনায় নাগরিক সমাজ প্রতিবাদ জানাচ্ছে কিন্তু সেই প্রতিবাদ কি কর্ণকুহরে প্রবেশ করছে রাষ্ট্রের মালিকদের? হলফ করে বলতে পারি প্রবেশ করছে না আর প্রবেশ করে না বলে একজন মন্ত্রী নির্দ্বিধায় সাংবাদিক এবং ক্ষতিগ্রস্ত হিন্দুদের  হুমকি দিতে পারেন বেশি বাড়াবাড়ি না করার জন্য। আর এদিকে প্রশাসন তো আর এক কাঠি উপরে। নির্দ্বিধায় তারা সমাবেশের অনুমতি দেন যেখান থেকে আসে হামলার মূল মদদ।

কিন্তু এরমধ্যে আমি বা আমার মতো সংখ্যাগুরুর সংখ্যালঘুর অবস্থান কোথায়? সংখ্যাগুরু হয়ে দিনকে দিন মানসিক যন্ত্রণায় অতীষ্ট। লজ্জায় ঘৃণায় কুঁকড়ে যাওয়া মানুষ আমি/আমরা দাঁড়াতে পারছি না সংখ্যালঘুর সীমানায়, আবার সংখ্যাগুরুও আমায় চিহ্নিত করছে ’খাঁটি বান্দা’ নই বলে।

বাসে ভিড়ে অথবা চলতি পথে দমাদম তর্কে জড়িয়ে ক্ষতবিক্ষত মনে ফিরে আসছি। ঘরোয়া আড্ডায় এতোদিনের পরিচিত ’আত্মীয়’ মুখগুলি অচেনা-অজানা ঠেকছে। যে বিশ্বাস নিয়ে সবার একসাথে বেড়ে ওঠা, সেই বিশ্বাসের আজ হচ্ছে মূলোৎপাটন। জীবনের বন্ধু যারা ছিল, তারাও আজ অচেনা ভঙ্গীতে, অচেনা লেবাসে, অচেনা ভাষায় মুখরিত। আমি আজ সেখানে বেমানান, তাই শুধু সরে যাওয়া, পিছিয়ে আসা। ফিসফিস করে কথা বলা, আশপাশ দেখে নেয়া কে আছে দেয়ালের পাশে।

sonia-ashrafi
সোনিয়া আশরাফী

অফিস আড্ডায় রেস্তোরায় সর্বত্রই এক। কারণ অামার নিরাপত্তার দায় আমার, রাষ্ট্র সে কথাই মনে করিয়ে দেয় বারবার। এ আমার কেমন সংখ্যাগুরুতে বসবাস!  প্রশ্ন জাগে, কী এমন হলো যে আজ সবাই আমরা এতোটাই বদলে যাওয়া মানুষ! সাম্প্রদায়িকতায় পূর্ণ, বেহেস্ত লাভের আশায় মশগুল! কই আমার পূর্ব পুরুষ তো সে উদাহরণ আমাকে দিয়ে যায়নি।

আমার জন্ম বেড়ে ওঠা সবই পুরোনো ঢাকার অলি-গলিতে। মিশনারী স্কুলে পড়া। সিস্টারদের হাত ধরেই আমার হাতেখড়ি। আমার ঈদ-পূজা-ইষ্টার সানডেতে নাড়ু, কেক আর ফিরনির ভাগাভাগি ছিল নিশ্চিত। অথবা অংক বোঝার জন্য স্কুল সহপাঠীর (সনাতন ধর্মাবলম্বী) মামা (যাকে আমিও মামা ডাকতাম) ছিলের একমাত্র ভরসাস্থল। আজ এই ভরসাস্থলের মানুষেরা কারো উপর ভরসা করতে পারছেন না। চোখে-মুখে আতংক নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। একজন সংখ্যাগুরুর তকমা আঁটানো আমি তাদের চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে পারি না। ভরসার কথাও বলতে পারি না জোর দিয়ে।

কারণ এই রাষ্ট্রের রাজনীতি আমাকে সে দৃষ্টান্ত দেয়নি। আমাকে আশ্বস্ত করেনি এ অপরাধীদের বিচার হবেই (আজ পর্যন্ত সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়ে একটি মামলারও বিচার হয়নি)। আজ পর্যন্ত এ রাষ্ট্র একটি আইন তৈরি করতে পারলো না অসম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে।

মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কেন সরকারকে বাধ্য করাতে পারেন না, বারবার চাপ দিতে পারে না, কেন এনজিও, নাগরিক সমাজ চাপ প্রয়োগ করতে পারে না এ নির্যাতনের শাস্তির বিধানের জন্য?

এ প্রশ্নের উত্তর আমার জানা। তবু আক্রোশে গলা ফাটিয়ে, প্রশ্নবানে জর্জরিত করতে চাই, ছিন্নভিন্ন করতে চাই এই রাষ্ট্রের মালিকদের “এই বাংলাদেশ কি আমরা চেয়েছিলাম?” তবু আমি বিশ্বাস হারাতে চাই না এই দেশ সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পে জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যাবে। আমরা রুখবোই, রুখতে আমাদের হবেই।  

শেয়ার করুন: