মাসকাওয়াথ আহ্সান: কালীপূজার সময়টিতে দীপাবলীর আলোয় উদ্ভাসিত হবার শুভক্ষণে ফেসবুকে একটি কথিত ফটোশপ করা ছবি শেয়ারের “অজুহাতে” ইসলাম ধর্মের অনুভূতিতে আঘাতের “অভিযোগে” একদল সশস্ত্র মুসলমান তাণ্ডব চালালো ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও সন্নিহিত এলাকায়। প্রায় তিনশো হিন্দু পরিবারের বসতবাটিতে হামলা চালিয়ে তাদের বুঝিয়ে দেয়া হলো; এ তোমার জন্মভূমি হতে পারে; কিন্তু এখানে বসবাসের অধিকার তোমার নেই। মন্দিরে ঢুকে প্রতিমা ভাংচুর হলো; যে প্রতিমা অসূয়া বধের আস্থার প্রতীক; সেই প্রতিমাকে ভাংচুর করলো উত্তেজিত মুসলমানেরা। তাণ্ডব চালিয়ে তাদের ফিরে যাবার পথে পড়ে রইলো প্রতিমার ভেঙ্গে যাওয়া ম্লান মুখাবয়ব।
রামুতে বৌদ্ধদের গ্রামে ঠিক একই পদ্ধতিতে ফেসবুকে একটি কথিত ফটোশপ করা ছবিকে কেন্দ্র করে সেই মুসলমানদের অনুভূতিতে আঘাত লেগেছিলো। আর সেই অনুভূতিতে আঘাতের অজুহাতে বৌদ্ধ পল্লীতে তাণ্ডব চালানো হয়েছিলো। রবিবার আক্রান্ত ব্রাহ্মণবাড়িয়া সাম্প্রতিক অতীতেও এই প্রখর অনুভূতির মুসলমানদের তাণ্ডবের শিকার হয়েছে। ভারতীয় উপমহাদেশের শাস্ত্রীয় সংগীতের কিংবদন্তী আলাউদ্দীন খাঁর স্মৃতিধন্য সংগীত সদনে ভাংচুর করেছিলো এই অসুরেরাই।
সুতরাং জেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন, আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য প্রগতিশীল দলের স্থানীয় নেতা-কর্মী সর্বোপরি ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও সন্নিহিত এলাকার সমাজের মাঝে এই দাঙ্গাবাজদের ব্যাপারে সচেতনতা ও সক্রিয়তা প্রত্যাশিত ছিলো। গত দুর্গা পূজার উপলক্ষটিতে আইন-শৃংখলা রক্ষাবাহিনী সচেতন থাকায় অন্যান্য বছরের তুলনায় শান্তিপূর্ণ পরিবেশে শারদীয় উৎসবটি পালিত হতে পেরেছে। এটা প্রমাণ করে বাংলাদেশের আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী চাইলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে। তাহলে কালীপূজার সময় কেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আইন-শৃংখলা পরিস্থিতি এতো ঢিলেঢালা ছিলো!
প্রতিটি উৎসবে আয়োজনে আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে অতন্দ্র থাকবে; এটা তো একটা প্রশাসনিক ঐতিহ্যের অংশ। বিশেষ করে বাংলাদেশের যেসব অঞ্চলে ইতোমধ্যে অতি অনুভূতিপ্রবণ মুসলমানের অপতৎপরতা পরিলক্ষিত হয়েছে; সেসব এলাকায় আইন-শৃংখলা হুঁশিয়ারি সর্বোচ্চ মাত্রায় রাখতে হবে; এ বিষয়টি নতুন অফিস অর্ডার বা দপ্তর নির্দেশের অপেক্ষা রাখে না। দুর্গা পূজার সময় সচেতন থেকে পুলিশ কালীপূজার সময় গা-ঢিলা দিয়ে বসে রইলো; এটা পেশাদারিত্বের বিপুল বিপর্যয়।
প্রাথমিকভাবে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দাঙ্গাবাজ মুসলমানেরা যে ছবিটি ফেসবুকে আপলোডের দায়ে হিন্দু ধর্মাবলম্বী এক ব্যক্তিকে অভিযুক্ত করছে; সেই ছবিটি আপলোড ঐ ব্যক্তিই করেছেন কীনা সেটি তদন্ত সাপেক্ষ। কারণ যে কোন অপরাধের মোটিভ (লক্ষ্য), মিনস (সংঘটনের হাতিয়ার) এবং অপরচুনিটি (সুযোগ) থাকে। বাংলাদেশের বাস্তবতায় একজন হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান-আদিবাসীর কোন অপরাধ সংঘটনের জন্য প্রয়োজনীয় এই তিনটি উপাদানের কোনটিই নেই। ফেসবুকে একটি ছবি আপলোড করে কোন কিছু ঘটানোর সামর্থ্য তাদের নেই। এই সামর্থ্য রয়েছে দাঙ্গাবাজ মুসলমানদের; এই ফটো আপলোডের বেনিফিশিয়ারি বা সুফলভোগী তো তারাই।
আর অপরাধ সংঘটনের জন্য প্রয়োজনীয় তিনটি উপাদান যে তাদের ভরপুর; তাতো তাদের তাণ্ডবে লণ্ডভণ্ড হিন্দু বসত এলাকায় সুস্পষ্ট। সুতরাং অধিকতর তদন্তে এই ফটো আপলোডের পেছনে দাঙ্গাবাজদেরকে খুঁজে পাওয়া যাবার সম্ভাবনাই বাস্তবসম্মত। আর এই আপলোড করা ছবিটি ইসলাম ধর্মের কোনো “অনুভূতি”তে আঘাত হানলে তা মন্দিরের প্রতিমা ভাঙ্গা ও এতোগুলো হিন্দুবাড়ী তছনছ করার সমানুপাতিক আঘাত কোনভাবেই নয়। এ যে ভয়ভীতির মাধ্যমে হিন্দুদের উচ্ছেদ করে তাদের বাড়ী-জমি দখলের “লোভাতুর অনুভূতি” সে কথা বুঝতে অপরাধ বিশেষজ্ঞ হতে হয় না।
এই হিন্দু-বৌদ্ধ-খৃস্টান-আদিবাসী সম্পত্তি দখল করার যে দীর্ঘ ঐতিহ্য তার বেনিফিশিয়ারি বাংলাদেশের প্রতিটি রাজনৈতিক দলের নেতা, আমলা, ব্যবসায়ী প্রমুখ। অর্থনীতিবিদ আবুল বারাকাতের একটি গবেষণাকাজে খুব স্পষ্টভাবেই উন্মোচিত হয়েছে এই অপ্রিয় সত্যটি। তাদের কেউ কেউ বলে কয়ে সাম্প্রদায়িক; কেউ কেউ একটু লুকোনো; অসাম্প্রদায়িকতার নানান ভং ধরে ভেতরে ভেতরে চরম সাম্প্রদায়িক তারা। ফলে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার রবিবারের ট্র্যাজেডির প্রতি সমানুভূতিসম্পন্ন মানুষের সংখ্যা ক্ষমতা কাঠামোতে উল্লেখযোগ্যভাবেই কম। বাংলাদেশে ধর্মে অবিশ্বাসী ব্লগারদের ধারাবাহিক হত্যাকাণ্ডের সময় হত্যাকারীদের প্রতি ঠারে-ঠুরে সমর্থন প্রকাশ করে কথিত প্রগতিশীল রাজনৈতিক সংগঠনগুলোই যেরকম আচরণ করেছেন; তাতে বোঝা যায় কট্টরপন্থার ইসলাম কীভাবে আচ্ছন্ন করেছে বাংলাদেশ সমাজকে।
এই সমস্যাটিকে আরো ঘনীভুত করেছে ধামাচাপাজীবী বুদ্ধিজীবীরা। কোথাও হিন্দু-বৌদ্ধ-খৃস্টান-আদিবাসীর ওপর হামলা হলেই এরা হাজির হয়ে যায়, দায় অস্বীকার ও জাস্টিফিকেশানে। এইখানে কথিত প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীরা এসে শুরু করে দেয় স্মৃতি রোমন্থন। বিএনপি-জামাতের পাচালী; সেই গল্পের শাখা-প্রশাখা। এই ব্যাপারগুলো আমরা জানি। আমরা নিজের চোখে দেখেছি বিএনপি জামাতের মানবতা বিরোধী কর্মকাণ্ড। আবার গত ৮ বছরে নিয়মিত জামাত কর্মীদের ফুল দিয়ে আওয়ামী লীগে বরণ আর জামাতের টাকশাল ইসলামী ব্যাংকের স্পন্সরশিপ, চেক ইত্যাদি গ্রহণের মনোরম ছবি দেখেছি। হেফাজতে ইসলামকে খাসজমি উপহার সহ নানা প্রশ্রয় পেতে দেখেছি। ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা সাবেক স্বৈরাচারী শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে ক্ষমতাসীন সরকারের বিশেষ দূত হিসেবে দেখেছি। খুব সুন্দর ভারসাম্যের রাজনীতি দেখছি। এটাকে বাংলাদেশ রাজনীতির জাদুকাল বললেও ভুল হবে না।
তবে বিগত বিএনপি-জামাত শাসনামল আর চলমান আওয়ামী লীগ শাসনামলে ইসলাম ধর্মের নানা “অনুভূতি” সংরক্ষণের যে তোড়জোর দৃশ্যমান; তাতে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তাণ্ডব খুব অপ্রত্যাশিত নয়। নিরংকুশ ক্ষমতার আধিপত্য বিস্তারের নেশায় কেউ যত্রতত্র ইসলামের “অনুভূতি” রক্ষার অজুহাতে যদি ৫৭ ধারার প্রচলন করে এটিকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেও ব্যবহার করে; সে জাদু রাজনীতির তিক্ত চিত্র সমাজের সর্বত্রই দেখা যাবে। সেইখানে সবচেয়ে বেশী নিপীড়িত হবে দরিদ্র মুসলমান উপায়হীন মানুষ, হিন্দু-বৌদ্ধ-খৃস্টান-আদিবাসী আর কিছু উদারপন্থী মানুষ।
ধর্ম নিয়ে রাজনীতির উর্বর ভূমি আজকের বাংলাদেশ। সৌদী আরবের সংস্কৃতির অনুকরণে শিক্ষা-সংস্কৃতি বর্জিত টাকশাল মুখী এক সমাজ নির্মিত হয়েছে। পরিসংখ্যানের বাংলাদেশ শাইনিং; ফিলগুড বিজ্ঞাপন ফেরি করে বেড়াচ্ছে কতিপয় উন্নয়নের হকার। অথচ জাতিগত নিমজ্জনের অশনি সংকেত সমাজের সর্বত্র। তারুণ্যের কর্ম সংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির ক্ষেত্রে সবচেয়ে ব্যর্থ রাষ্ট্রগুলোর একটি বাংলাদেশ। দক্ষিণ এশিয়ায় শিক্ষার মানে সবচেয়ে পিছিয়ে বাংলাদেশ।
ধর্ম নিয়ে রাজনীতিতে দাঙ্গাবাজ মুসলমানদের নিপীড়নের চূড়ান্ত গন্তব্য নারী। সুতরাং নারী নির্যাতনের খবর এখন প্রতিদিনের সঙ্গী হয়েছে এ সমাজে।
ক্ষমতাসীন সরকারের ৮ টি বছর নিরংকুশ ক্ষমতায় কেটে যাবার পরেও যদি যে কোন ঘটনায় ষড়যন্ত্রের আকাশ-কুসুম গল্প শুনতে হয়; দেশপ্রেমের আলংকারিক শব্দের আফিমে যদি লুকাতে হয় এইসব ব্যর্থ দিনরাত্রি; বুঝতে হবে আরব্য রজনীর হাজার রাত্রির গল্পের আসর জমে উঠেছে।

এইসব আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামাত, জাতীয় পার্টি শেষ পর্যন্ত শিক্ষা-সংস্কৃতিতে পিছিয়ে থাকা অনুভূতিকামী মুসলমান আত্মপরিচয়ে বিলীন; তাদের আর মানুষ আত্মপরিচয়ের উদ্ভাসে আলোকিত হওয়া হলো না। আর এরাই যখন ঘুরে ফিরে নীতি নির্ধারক; তখন অসাম্প্রদায়িক মানব সমাজ সৃজনের কোন সুযোগ তারা রাখেনি। এরা বোঝেই না নানা ধর্মের-নানা গোত্রের-নানা ভাবনার সমাজের সৌন্দর্য্য।
এইখানে সমাজ তার দায় এড়াতে পারে না। যে সমাজে মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ সেখানে সংখ্যায় কম হিন্দু-বৌদ্ধ-খৃস্টান-আদিবাসীদের নিরাপত্তা ও স্বাচ্ছন্দ্যের দায়িত্ব মুসলমানদের। ভারতের পশ্চিমবঙ্গে হিন্দুরা যেহেতু সংখ্যায় বেশী তারাই মুসলমানদের নিরাপত্তা হয়। পুরো ভারতেই মুসলমান জনসংখ্যা বেড়েছে। কট্টরপন্থী বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর মুসলমানদের নিরাপত্তা কিছুটা বিঘ্নিত হলে ভারতের অন্ততঃ আড়াইশো বুদ্ধিজীবী এর প্রতিবাদে তাদের রাষ্ট্রীয় পদক ফিরিয়ে দেন। ভারতে ধামাচাপাজীবীর সংখ্যা কম হবার কারণে মুসলমানের সংখ্যা বেড়ে গেলো। অন্যদিকে বাংলাদেশে ধামাচাপাজীবীর সংখ্যা আশংকাজনকভাবেই বেশী হওয়ায় হিন্দুদের সংখ্যা আশংকাজনকভাবে হ্রাস পেয়েছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া হিন্দু উচ্ছেদের ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার অন্যতম অধ্যায় মাত্র।
তাই ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে ধামাচাপাজীবীদের চর্বিত-চর্বন শুনতে আমরা মোটেই আগ্রহী নই। হিন্দু-বৌদ্ধ-খৃস্টান-আদিবাসী নির্যাতনের এই কালো অধ্যায়ের অবসান চাই। এরজন্য যা প্রয়োজন তা-ই করতে হবে সরকার এবং সমাজকে। দিনের পর দিন নিজভূমে পরবাসী সংখ্যালঘুদের রক্ত, অশ্রু ঝরিয়ে কোন সভ্য জাতির বিনির্মাণ সম্ভব নয়। পৃথিবীর ইতিহাসে যেসব জাতি অনুতাপহীনভাবে সংখ্যালঘু নিধন ও নির্যাতন করেছে; তারাই অভিশপ্ত জাতিতে পরিণত হয়েছে; অতঃপর নিমজ্জিত হয়েছে রক্ত-অশ্রুর পাপ সাগরে।