জাহাঙ্গীরনগরে র‍্যাগিং এর নতুন সংজ্ঞায়ন

আনিকা জুলফিকার: তিন চারদিন ধরে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে চায়ের কাপে ঝড় তোলা বিষয় একটাই। এই বিশ্ববিদ্যালয়েরই ছাত্রী, জান্নাতুন নাঈম প্রীতির নিজ অভিজ্ঞতার কথা, হলে তাকে কেমন পরিস্থিতির শিকার হতে হয়েছে। এই বিষয়টি এই ক্যাম্পাসের জন্য নতুন কিছুই নয়। বরং রোজকার একটি ঘটনাই।

তবে এখানে এসেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে মতবিরোধ দেখা যাচ্ছে। একদল দাবী করছেন, প্রীতির কথা সর্বৈব মিথ্যা। হলে কোন রকম র‍্যাগ দেয়া হয়না। এটি এখানকার ‘সংস্কৃতি।’ সিনিয়র-জুনিয়র সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটাবার প্রক্রিয়া মাত্র।

annica-ju
আনিকা জুলফিকার

তারা এও বলছেন, “যদি রাত দুটোর সময় আমি অসুস্থ হবার পর সিনিয়র ভাইয়া আপুই আমাকে সবথেকে বেশি সেবা করে থাকেন, আর এটি যদি র‍্যাগ হয় তবে সারাজীবন আমি এই র‍্যাগ নিতে রাজি আছি।’ কিংবা, “আয় ছোট ভাই/আপু, আজ আমি তোদের দুপুরে খাওয়াই।” “চল আজ অমুক জায়গায় ঘুরে আসি” এইগুলো র‍্যাগ হলে আমি র‍্যাগ খেতে রাজি।

এখানেই আমার খটকা লেগেছে বলে লেখাটা লিখতে বসা।

আমার প্রশ্ন হলো, র‍্যাগ শব্দটার সাথে আপনারা আন্তরিকতা, মানবতা, স্নেহ এই ব্যাপারগুলো গুলিয়ে ফেলছেন না তো? উইকিপিডিয়া অনুসারে, “Ragging is a practice similar to hazing in educational institutions. The word is mainly used in India, Pakistan, Bangladesh, and Sri Lanka. Ragging involves existing students baiting bullying new students. It often takes a malignant form wherein the newcomers may be subjected to psychological or physical torture.”   আর কাউকে শারীরিক বা মানসিক ভাবে হেনস্থা করাটা হচ্ছে অপরাধ। কিন্তু কারো খাবারের বিল দেয়া, তাকে নিয়ে ঘুরতে যাওয়া, অসুস্থ হলে সেবাযত্ন করা- এগুলো আন্তরিকতা, মানবতা, স্নেহ।

আমি নিজেও এই বিশ্ববিদ্যালয়েরই ছাত্রী। হলে অনিয়মিত। কিন্তু প্রথম যে রাতে ঝড়বৃষ্টির জন্য হলে থাকতে হয়েছিলো, সে রাতেই ইমিডিয়েট সিনিয়র রা গণরুমে আসেন, “এটিকেট” শেখাতে।

পরবর্তী এক দেড় ঘণ্টা চলে কে অসভ্য, কে বেয়াদব, কে পাশ দিয়ে চলে গেছে সালাম দেয়নি, কেন অমুক সিনিয়রকে তারা চেনেনা এসবের ফিরিস্তি দিতে দিতে। তারপর শুরু হয়, “এই যে আপু, তুমি এইবার পাঁচভাবে কেঁদে দেখাবা, ১০ ভাবে হাসবা। অবশ্যই হাসতে হবে।” অথবা দেখে লাজুক, চুপচাপ মেয়েটিকে, “আপু শুনো, এখন এই আইটেম গানটার সাথে একদম ওইভাবেই নেচে দেখাও আমাদের। যদি না নাচো, তাহলে আগামী এক ঘণ্টাতেও তোমাদের ছাড়া হবেনা। বসায় রাখবো। একজনকেও ঘুমাতে দিবো না।” অনেকে গালিও দেন।

আমার প্রশ্ন, এটি কোন অর্থে ‘সম্পর্ক ভালো করা’র প্রক্রিয়ায় পড়ে? ওই মেয়েটির মনের অবস্থা ওই মুহূর্তে কেমন হতে পারে আন্দাজ করতে পারেন? যে মেয়েটি হয়তো সহজে মিশতে পারেনা কারো সাথে, তাকে এভাবে বলা, নাহলে তার বাকি রুমমেটদেরও সাফার করতে হবে, এটি শোনার পর তার কেমন লাগে? ওই মুহূর্ত থেকেই তো সে ওই সিনিয়রকে ঘৃণা করতে শুরু করবে। তাহলে এর পরেও কিভাবে তারা আশা করেন, জুনিয়ররা তাদের “ছোটবোন” হয়ে উঠবেন?

কিংবা আমার পূর্ববর্তী বিভাগে, যেখানে প্রথম ক্লাসের দিন ইমিডিয়েট সিনিয়ররা এসে জানিয়ে দিয়েছিলেন, এখানে তারাই আমাদের বাবা-মা। সাথে তুই তোকারি তো ছিলোই। তাদের কথাই আমাদের জন্য শেষ কথা। আর একেকজনকে সামনে ডেকে তুমি এখন সংশপ্তক হয়ে দাঁড়ায় থাকো। এরকম অঙ্গভঙ্গি করো।

সেসময় কেউ হেসে ফেললে তাকে দাঁড় করিয়ে একরাশ কথা শোনানো।

আর কেউ নার্ভাস হয়ে কেঁদে ফেললে, তাকে বাইরে নিয়ে একটু সান্ত্বনা দেয়া, চা বিস্কিট খাওয়ানো- তাতেই সম্পর্ক ভালো হয়ে গেলো? এভাবে সম্মান, শ্রদ্ধা পাওয়া সম্ভব? এরপর যখনই ওই সিনিয়রকে দেখবে, ওই ছেলে বা মেয়েটির মনে কি বিবমিষা জাগবে না? তারপরেও হাসিমুখে তারা কথা বললে সেটি কতটা মেকি আর কতটা প্রাণবন্ত হবে তা সহজেই অনুমেয়।

এইসব করার পিছনে সিনিয়রদের উদ্দেশ্য কি? মুখে তারা বলে থাকেন, সম্পর্ক ভালো হবে, শ্রদ্ধা, সম্মানের জায়গাটা বাড়বে। আদতেই কি তাই? তাদের সাথে যখন একই ঘটনা ঘটেছিলো, তারা মনে মনে ক’বার গালি দিয়েছিলেন এটি এখন কেউ প্রকাশ করবেন না তা অবশ্য বলাই বাহুল্য।

আর ছেলেদের হলের ব্যাপারে, বন্ধুদের সুবাদে শুনেছি অনেক। ছয়ফুট দেয়াল ধরে ঝুলে থাকা, রাতভর কুকুর বিড়ালের ডাক ডেকে তাদের বিনোদিত করা, রাত দুটোয় এসে,”এই যাহ, হল থেকে বের হ। ভোরের আগে আসবি না।”

এইগুলো কী? মজা করা? সকালে যে ছেলেটির ক্লাস আছে, ভোর পাঁচটা অবধি বাইরে থেকে এলে সে সকালের ক্লাসে মনোযোগ কিভাবে দেবে? অবশ্য এক্ষেত্রে তাদের জন্য বেদবাক্য, “ফার্স্ট ইয়ারে পড়াশোনা করতে হয় না!”

সমস্যা হচ্ছে, এমন এক ভয় সকলের মাঝে ঢুকে গেছে, যেকোনো ছেলেই এটি কেন যেন স্বীকার করতে চান না। ক্লাসে এসে তারা ক্লাসমেটদের বলেন, আরে কাল রাতেও সারারাত জাগায় রাখছিলো পড়া হয় নাই। অথচ শিক্ষক এসে জিজ্ঞেস করলেই, স্যার আসলে কালকে এই সমস্যা (নিজের শারীরিক বা পারিবারিক সমস্যা উল্লেখ) হয়েছিল। পড়তে পারিনি।

কেন তারা বলতে পারেন না? যারা পারেন, সেই রাতে তাদের উপর আরো বেশি মানসিক অত্যাচার চলে। ফলে সত্যি বলার সাহস, ইচ্ছে ওখানেই মরে যায়।

আর সেই রোজ রাতে জাগায় রাখার কারণে ঘুমাতে না পারা ব্যক্তিরাই এখন জোর গলায় বলছেন, এই ক্যাম্পাসে ‘র‍্যাগ’ নেই। ভাইরা খাওয়ালেই যদি র‍্যাগ হয়, আপু নিজের হাতে রান্না করে দিলে যদি র‍্যাগ হয়, আমি সারাজীবন র‍্যাগ খাবো।

আমার প্রশ্ন এটাই। কেন আন্তরিকতা, মানবতা, স্নেহ বিষয়গুলোকে র‍্যাগিং নামক ভয়ংকর একটি চর্চার সাথে গুলিয়ে ফেলা হচ্ছে।

আর সবশেষে প্রীতির প্রতি আন্তরিক ধন্যবাদ। সৎ সাহস দেখানোর জন্য, অন্যায়ের বিরুদ্ধে দলগত মেরুদণ্ডের জোরে মিথ্যে প্রচারের চেয়ে নিজের মেরুদণ্ডের জোরে একা দাঁড়িয়ে থাকাই উত্তম এটি আরেকবার জানান দেয়ার জন্য। এই ভয়ংকর চর্চা বন্ধ করার পক্ষে আমরাও আছি।

সম্পর্ক উন্নয়নের নামে দিনের পর দিন মানসিক অশান্তি থেকে মুক্তি পাক এই বিশ্ববিদ্যালয়, এবং আরো যাদের সাথে এটি হচ্ছে তারা সবাই। আর প্রার্থনা, র‍্যাগ এবং আন্তরিকতা যেন আর কেউ না গুলিয়ে ফেলেন। বিশ্ববিদ্যালয় জ্ঞান উৎপাদনের জায়গা। সেটি সবার শান্তিমতো করবার অধিকার আছে। কিন্তু একজনের মানসিক শান্তি নষ্ট করবার অধিকার অন্য কারোরই নেই। এই কথাটি সকলের জন্য প্রযোজ্য।

প্রথম বর্ষ, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

শেয়ার করুন: