ফেরদৌসি রিতা: কোনো শিশু পাশবিক নির্যাতনের শিকার হলে মিডিয়াতে আমরা কী দেখি? শিশু মেয়ে হলে সে ধর্ষিত হয়, আর ছেলে হলে বলাৎকার। কথা তা নিয়ে নয়। কথা হলো পাশবিক নির্যাতনের ক্ষেত্রে মিডিয়া হিসেবে বাংলাদেশ কী সিদ্ধান্ত নিয়েছিল?
দীর্ঘ সময় ধরে তা চর্চাও করে চলেছে অনেকে। নির্যাতিতের নাম, ছবি ও পরিচয় গোপন রাখা। নির্যাতনকারীর নাম, পরিচয় এবং আাইনের বিষয়গুলো জানানো। কিন্তু আমাদের মিডিয়া হয়তো বারবার সেটি ভুলে যায় বা ভুলে যেতে চায়। এমন অন্যায় কোনো নির্যাতনের ঘটনা ঘটলেই মিডিয়া নির্যাতিতের নাম, পরিচয় ও ছবি প্রকাশ করতে চায়। বিস্ময়করভাবে এই ডিজিটাল বাংলাদেশও এই চায়।
‘রাতভর পালাক্রমে ধর্ষণ’, ‘মুখ ধরে’, একের পর এক’, চলতি বাসে এরকম নানাকিছু দিয়ে পাশবিক নির্যাতনের একটা রগরগে বর্ণনা তৈরি না করলে হয়তো মিডিয়ায় সেটি ‘গরম খবর’ হয় না। একটি পাশবিক নির্যাতনের খবর তো একটি চরম শাস্তিযোগ্য অন্যায়ের খবর। যেখানে নির্যাতনকারীর নাম পরিচয় এমনভাবে আসা উচিত এবং তার আইনগত শাস্তি প্রক্রিয়া এমনভাবে তুলে ধরা উচিত যাতে এই ধরনের খবর পাঠকের মনে এবং এর বিরুদ্ধে একটা জনমত তৈরি করে। কিন্তু তা না করে মিডিয়া খবর পরিবেশনে এই ধরনের অন্যায়কে আরও উসকে দিতে চায়।
এই কথা বলতে গেলে দেশে ঘটতে থাকা যেকোনো দিনের পাশবিক নির্যাতনের কথাই বলা যেতে পারে। তবে বলছিলাম একটি পাঁচ বছরের শিশুর কথা, একটি মেয়ের কথা। পরীক্ষায় ভাল ফলাফলের জন্য বা খেলাধূলায় চ্যাম্পিয়নের জন্য তার হাসিমাখা দুরন্ত ছবি ছাপা হতে পারতো পত্রিকায়। তা না হয়ে তার এক করুণ নির্যাতিত মুখের ছবি ছেপেছে আমাদের সংবাদ মাধ্যমগুলো। বেশ কয়েকদিন সোশ্যাল মিডিয়া, ইলেকট্রনিক মিডিয়া এবং প্রিন্ট মিডিয়ায় তাকে নিয়ে কথা হচ্ছে।
আমার নিজেরও এক মেয়ে আছে। গেলো সেপ্টেম্বরে ৮ বছরে পা দিলো। আর ঐ শিশুটির বয়স ৫ বছর। সাংবাদিকদের সংবাদের বরাত দিয়ে যখন ওর শরীরের বিভিন্ন অংশের ছবি দেখানো হচ্ছিল তখন আমার মেয়েটির শরীরের ঐ অংশগুলোকে দেখতে পাচ্ছিলাম। যখন মিডিয়া কেমন করে, কোথায় কতখানি ব্লেড দিয়ে কেটেছে, ছ্যাঁকা দেবার ছবিসহ সংবাদটি ফেবুতে কেউ হাইলাইট করে জানানোর চেষ্টা করেছে, তখন আমার মেয়ের ঐ অংশের কাটা দাগগুলো আমি দেখতে পাচ্ছিলাম। সংবাদপত্রের এই অসংবেদনশীল আচরণে আমি ক্ষুব্ধ, লজ্জিত এবং আমাদের বোদ্ধাদের ফেবুতে শেয়ার করা নিয়ে আমি কিছুটা চিন্তিত। যাই হোক যে বিষয়টি নিয়ে আলাপে ঢুকতে চাই।
আমার মেয়ের সাথে এই ঘটনাটি ঘটলে কী হতো একটু ভেবে দেখি। আমার মেয়ের ছবি-আমার ছবি-আমার মেয়ের বাবার ছবি-আমার বাড়ির ঠিকানা সব মিডিয়ার বরাতে সারাদেশ জেনে যেতো।
তারপর?
শরীরের ক্ষততে মলম লাগিয়ে মেয়ে একদিন আমার সেরে উঠলো। বাড়িতে ফিরে এলো। আশেপাশের পাড়ার সকল লোক ওকে দেখার জন্যে ভিড় করলো। আহা-উহু বলে আমাকে সান্তনা দিলো, আর সাবধান করলো যেনো একা একা ওকে কোথাও না পাঠাই। আমার চলাফেরা যেন সংযত করি। মেয়েকে আমার যেন সালোয়ার-কামিজ পরিয়ে রাখি। মাথার চুলটি ঢেকে দেই হিজাবে। বাজারের কোন দোকানে এসব ছোট্ট ছোট্ট হিজাব পাওয়া যায় তার ঠিকানাটিও হাতের মধ্যে গুঁজে দিলো।
মেয়ে আমার খেলতে চায়, আমি সাবধান বাণী উপেক্ষা করে পাঠাই। ওকে ধরে সবাই জিজ্ঞাসা করে কী হয়েছিলো সেদিন। মেয়ে আমার স্কুলে যেতে চায়, ওকে পাঠাই। শিক্ষকসহ স্কুলের বড় ক্লাসের সবাই জানতে চায়, ঐদিন কী হয়েছিল, মেয়ে আমার দোকানে গিয়ে চকলেট কিনতে চায়, আমি পাঠাই, তখন দোকানদার ওকে জিজ্ঞাসা করলো, ও ব্যথা পেয়েছিল কীনা বা আর পাঁচজনকে বললো, এই সেই মেয়ে।
আমার মেয়ের বাবা বাজারে যায়, ওর দিকে আঙুল তুলে সবাই দেখায়, ঐ সেই মেয়ের বাবা। আমার মেয়ের বাবা আর বন্ধুদের সাথে চায়ের দোকানে গিয়ে চা খেতে পারে না। আর আমি প্রতিদিন পাড়ার সকল নারী আর পুরুষ দেখে লজ্জা আর ভয় পা,ই পাছে আামাকে ডেকে কেউ জিজ্ঞাসা করে কী কী ক্ষতি হয়েছে ওর?
এ আমার নিতান্তই কল্পনা। কিন্তু এই কল্পনার প্রত্যেকটি ঘটনা ঘটতে চলেছে সেই ছোট্ট শিশুটি এবং তার পরিবারের উপর দিয়ে।
কিন্তু কেন?
এই সবই হয়েছে গণমাধ্যম এমনতর ঘটনার সংবাদ পরিবেশনের ক্ষেত্রে তাদের নৈতিকতা ও নিয়ম লংঘন করেছে বলেই। শিশুটির ব্যক্তিগত সকল পরিচয় গোপন রেখেই এই সংবাদটির সব কিছু প্রকাশ করা জরুরি ছিল। ছবি ছাপানোর দরকার তো নেই, তার যদি একান্ত ছাপাতেই হয় তবে তা ঝাপসা করে দেয়া যেত। যাই হোক এটা আমাদের দীনতা। কী করতে পারি এখন আমরা?
প্রথমে আমাদের যা করা দরকার এই মেয়েটি ঘরে ফিরে আসলে যতটা সম্ভব ওকে খেলাধূলার মধ্যে রাখা। এই বিষয়ে বড়দের কোন নেতিবাচক আলোচনা ওর সামনে না করা। বিভিন্ন ধরনের খেলনা কিনে দেয়া। পরিবার এবং তার পাড়া প্রতিবেশি সকলকে ওর সাথে যে একটা অন্যায় কাজ করা হয়েছে সেই বিষয়টি ওকে সাথে নিয়েই আলোচনা করা এবং অপরাধীকে কিভাবে শাস্তি দেয়া যেতে পারে সেই বিষয়টিও তুলে ধরা, তাতে করে সামাজিকভাবেই যে এই অন্যায়কে বা ওকে যারা ব্যাথা দিয়েছে তাদেরকেও ব্যাথা দেয়া হবে, সেটি ওর মনের ভেতরে ঢুকিয়ে দেয়া। খুব সহজভাবেই ওর সাথে এই অন্যায় আচরণটি প্রকাশ করা, যাতে করে ওর মধ্যে অপরাধবোধ তৈরী না হয়। ওর বাবা ও মাকে এবং ভাই-বোনদের সাথে এই বিষয়ে খোলামেলা আলোচনা করা, তবে তারাও মানসিকভাবে এবং খুবই স্বাভাবিকভাবে অন্যায়টিকে বিশ্লেষণ করতে পারবে।
অন্য কোন শিশু বা মায়ের সাথে এমন ঘটনা ঘটলে কিভাবে আমরা তার প্রতিরোধ করতে পারি সেগুলো নিয়েও কিছুদিন পর আলোচনা করা এবং সেখানে স্কুলের শিক্ষকসহ সমাজের বা গ্রামের মাতব্বরদেরকেও রাখা। সেখানে শিশুটিকেও রাখলে ভালো হবে, কারণ ওর মনোজগতে এটা যে একটি অপরাধমূলক কাজ হয়েছে এবং তার জন্যে সবাই ওকে ভালোবেসে সেই অপরাধের শাস্তি কামনা করছে সেটা ও বুঝবে এবং আস্তে আস্তে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসবে।
আমাদের গণমাধ্যমে এ ধরনের ফিচার আমরা আশা করি। তবে নারী শুধু ভোগের পণ্য নয়, নারী ও শিশু আমাদের সমাজেরই একটি বড় অংশ সেটি প্রমাণিত হবে। ভোগবাদি মানসিকতা প্রকাশ আমরা শিশুর ক্ষেত্রে একেবারেই করতে পারি না। শিশুর ক্ষেত্রে এই অন্যায় সংবাদ প্রচার একটি জঘণ্যতম অপরাধ।
আসুন সবাই মিলে ঐ শিশুটির মতোন করে যারা এই যন্ত্রণা নিয়ে সমাজে অবস্থান করছে তাদেরকে সেই সামাজিক পরিবেশ দেই, যেখানে তারা প্রজাপতির মতো করে আবার পাখনা মেলে উড়তে থাকবে আর মানুষকে মানুষ ভাবতে শিখবে……..।