রিমঝিম আহমেদ: বাবা আর মায়ের সাথে একদিন তুমুল ঝগড়া হলো, বাবা বললেন, “আমি গেলাম!” বাবা চলে গেলেন। বাবার আর খোঁজ নেই। মায়ের রাগ পড়ে গেল, মা আমাদের নিয়ে অসহায় হয়ে পড়লেন। খাবার-দাবার, টাকা-পয়সা ফুরিয়ে গেল, আমাদের দুই বোনকে নিয়ে চলে গেলেন বাপের বাড়ি। আমাদের অভাব রইলো না।
এখানেই শেষ হতে পারতো, কিন্তু হয়নি। মা নিজের সংসারকে বাঁচাতে চেয়েছেন। বাপের বাড়িতে ভাইয়ের গলগ্রহ হতে চাননি আমাদের নিয়ে। তাই মা ভাইদের অনিচ্ছাসত্ত্বেও আমাদের বাবাকে ফিরিয়ে আনতে নিজেই রওনা হলেন। যে মা কয়েকটা গ্রাম ছাড়া আর কিছুই চেনেন না, সে মা’র এমন সাহস আজ আমি উপলব্ধি করি, যিনি কিনা দুর্গম মহেশখালী যাচ্ছেন বাবাকে ফিরিয়ে আনতে!
হ্যাঁ, আমার বাবার যাবার জায়গা ছিল, সে গল্প কোনদিন হয়তো বলবো। ছিল না আমার মায়ের।
আত্মসম্মানবোধ এমনই প্রখর ছিল যে, আমাদের নিয়ে আমাদের বড়লোক মামাদের কাছেও থাকতে চাননি। তখন আমরা দুই বোনের জন্ম হয়েছে। জীবনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ স্মৃতি মনে নেই, অথচ এতো ছোটবেলার স্মৃতি কীভাবে মনে আছে অবাক হই ভাবলে।

মা, আমাদের নিয়ে মহেশখালী গেলেন, দেখে বাবা খুশি নয় শুধু, আনন্দে আত্মহারা। আমরা সুখে শান্তিতে বসবাস করতে লাগলাম। মা আমাকে পানিরছড়া মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দিলেন। ভাইয়ের সাথে মাদ্রাসায় যাই, মাত্র পাঁচ বছর বয়স আমার, বড্ড চটপটে। হুজুর জিজ্ঞেস করলেন, ও কি শহর থেকে এসেছে? ভাই বললো, হ্যাঁ।
হুজুর আমাকে তার রুমে নিয়ে গেল, আর কেউ নেই। আমাকে এটা-সেটা জিজ্ঞেস করে, আমি উত্তর দিই। হঠাৎ লুঙ্গির তলা থেকে পুরুষাঙ্গ দেখিয়ে বললো, ‘এই দেখ, অনেক বড়, নিবি’? আমি ভয়ে আঁতকে উঠেছিলাম। আমার মনে আছে সেদিন ভাই সে রুমে চলে এসেছিল হঠাৎ। না এলে হুজুর আমাকে কী করতো! আজও কল্পনা করলে গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যায়।
সেই রাতে ভয়ে আমার জ্বর এসেছিল। মা কী বুঝেছেন জানি না, অনেক নাটকীয়ভাবে তার কয়েকদিন পরেই আমরা নিজের বাড়িতে চলে এলাম। এই গল্পও অন্য কোনদিন বলা হবে। মা আর কোনদিন আমাকে আরবি পড়তে মাদ্রাসা বা হুজুরের কাছে পাঠাননি। নিজেই পড়িয়েছেন। আমি, আমাদের গ্রামের অনেক মেয়ে, ছেলেরাও মায়ের কাছে আরবি পড়তে আসতো।
তারপর থেকে আমি হুজুরকে, দাঁড়িওয়ালা ধার্মিকদের দেখলে ভয় পাই, আঁতকে উঠি এই বয়সেও। সেদিনের কথা মনে পড়ে। মনে পড়লেই আমার কান্না পায়, অপমানে গা জ্বলে যায়।
আমার মেয়েকে কোন হুজুর ডেকে আরবি পড়াই না। আমিও সময় দিতে পারি না। ঘরে মহাভারত, রামায়ণ যেমন আছে, আছে আরবি ও বাংলা উচ্চারণ, শানেনজুলসহ কোরান শরিফও। আমার মেয়ের ধর্মপাঠ সে শিখে নিচ্ছে জীবনাচরণ থেকে। তাকে বিশ্বাসের সাথে ব্যক্তি জীবনকে মিলিয়ে চলবার শিক্ষা দিচ্ছি। সুতরাং সকল ধর্মই সে পড়ছে।
আমি কাজ করছি প্রায় আট বছর ধরে নানারকম শিশুদের নিয়ে। যেসব শিশু পথে এসেছে, শেল্টার হোমে থাকছে তাদের জীবনকে খুব কাছ থেকে জেনেছি। এমন শিশুও আছে যারা নিজের বাবার দ্বারা সেক্সুয়াল এবিউজের শিকার হয়েছে। আমি ভাবছি, তাদের কাছে পিতার অবস্থানটা কোথায়? কী মর্মান্তিক, একজন স্নেহবৎসল পিতার আদল তারা কোনদিন কল্পনা করতে পারবে না। বিশ্বাস করতে পারবে না এমন কোন সম্পর্ককে, যেখানে পুরুষ আছে। যেখানে খুব কাছের মানুষ বিশ্বাসঘাতকতা করে, সেখানে আর কাউকে বিশ্বাস করার মতো বিশ্বাস অবশিষ্ট থাকে না। থাকার কথাও না।
আমি কেন, কোন নারীই কি বলতে পারে সে কারো দ্বারা নিগৃহিত হয়নি কোনদিন? এমন স্মৃতি কি নেই যা কাউকে আজ অব্দি বলতে পারেনি? কমবেশি সবারই আছে, আর সেসব ঘটনাবলির সাথে জড়িয়ে থাকা পুরুষটি আমাদের কাছের মানুষ। আত্মীয়-পরিজন অথবা প্রতিবেশি।
মেয়েরা মানুষ হয়ে জন্মায় না, জন্মায় পুরুষের কামনা-বাসনার একথাল মাংস পিণ্ড হয়ে। মানুষ হয়ে জন্মালে মানুষের মতোই নিরাপদে বাঁচার অধিকার জন্মাতো। মেয়ে তো জরায়ুর ভেতরেও নিরাপদ নয়। সুযোগ পেলেই থাবা বসাবে হায়েনার দল।
আমার পরিবারে আরাধ্য আমার মেয়ে সন্তান। তার জন্যই সব, সবকিছুই। তাকে একটি নিরাপদ পরিবেশ দেবার জন্য আমাদের সর্বস্ব ত্যাগ করতে পারি। ফলে মেয়েকে চার বছর বয়সেই শিখিয়ে দিয়েছি গুড টাচ, ব্যাড টাচ। কারো কোলে ওঠা নিষেধ, গা ঘেঁষে থাকা নিষেধ। তার বাবাও জানে নিজের সন্তান হলেও কোন ধরনের আচরণ গ্রহণযোগ্য নয়, জানে আমার পরিবারে থাকা আমার ছোট বোনটিও। এই তো সতর্কতার কথা!
কিন্তু অসতর্ক মুহূর্তে? যখন বাসে, মেলায়, পথে-ঘাটে, হাটে-বাজারে কালো হাত তাকে ছুঁতে আসবে, থাবা বসাবে? তখন? আমিও ভয়ে আতঙ্কে হিম হয়ে যাই। এটুকু সাহস কী হবে, ভেঙে গুঁড়িয়ে দেবার মতো! সর্বসম্মুখে টেনে হিড়হিড় করে নিয়ে আসার মতো?
সমাধান এসব কিছুতেই নেই। যারা এসব করে, তাদের সংখ্যা কম নয়, আমরা তাদের চিনি না। এই যে, যে মেয়েটি-পূজা, আজ হাসপাতালের বিছানায় পড়ে আছে অচেতন অবস্থায়, তার সর্বত্র পশুঘাত। সে হয়তো বেঁচে ফিরবে। আর কি চাটনি কিনতে দোকানে যেতে পারবে, খেলতে যেতে পারবে বাইরে, সে কি আর হাসতে পারবে? তার অন্ধকার দেখলে কেমন লাগবে সেটা ভাবছি আর নিজের মেয়েকে তার অবস্থানে বসিয়ে আমি ঘুমুতে পারছি না। তার কাছে আতঙ্কের নাম হয়ে উঠবে ‘পুরুষ’।
আমাকে নিষ্ঠুর বলুন, তবু আমি চাই মেয়েটা বেঁচে না উঠুক। যৌনাঙ্গে এতোগুলো সেলাই নিয়ে, শরীরজুড়ে এতগুলো কামড়ের দাগ নিয়ে, মনভর্তি এতোবড় ক্ষত নিয়ে সে কেমন করে বাঁচবে? শুধু শ্বাস-প্রশ্বাসের নাম কি বেঁচে থাকা? সে মরে যাক, সে মরে যাক, তার মৃত্যু হোক। এতে অন্তত আমৃত্যু হতাশা, অবিশ্বাস, ট্রমার মধ্যে তাকে বেঁচে থাকতে হবে না।

আর রাষ্ট্রকে কী বলি? বোবা রাষ্ট্র। ক্ষমতার কাছে জন্মান্ধ। আমাদের বর্তমান এবং সাবেক দুই নেত্রীই নারী। তাদের কাছে এই আহাজারি কেন পৌঁছায় না! এমন কোন দৃষ্টান্ত তারা কেন তৈরি করতে পারেন না, যা দেখে ধর্ষকের বুক হিম হয়ে আসবে? আইনের ফাঁক গলে কেন তারা বেঁচে যায়, আর আরেকটা অপরাধ করার জন্য প্রস্তুতি নেয়। আর ক্ষমতা যাদের আছে তাদের টিকিটিও ছুঁতে পারে না আইন। এই যদি হয় তবে সাইফুল’রা বারবার পুজাদের উপর ঝাপিয়ে পড়বে, পড়বেই।
আমি নিরাপদ নই, আপনিও না, আমাদের সন্তানও না। তবে আমরা কী করবো? তাদের তো জরায়ুর ভেতর আটকে রাখতে পারবো না! এই খোলা হাওয়া, আলো, সবুজে তাদের বাঁচার অধিকার নিশ্চিত হবে কবে? চোখ খুলুন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী!