পাখিরা মায়ের পেটেও মার খাওয়া মেয়ে

আলফা আরজু: বাচ্চাটার নাম পাখি (ছদ্মনাম)।  বয়স ১১..কি ১২..? সিডনির এক প্রাইমারি স্কুলে পরে। কয়েকদিন আগে আমাদের বাসায় বেড়াতে এসেছিলো দুই রাতের জন্য। ওর মা গেছেন অস্ট্রেলিয়ার বাইরে দুই সপ্তাহের জন্য- মেয়েকে নিতে পারেননি। অনেক খরচ তাই। সেইজন্য এক খালার কাছে রেখে গেছেন। সেই খালা আবার আমার পরিচিত। সেইসূত্রে আমার বাসায় ওর বেড়াতে আসা। আমার দুই সন্তান, ওই আপার  দুইজন আর পাখি। সারাদিন এই পাঁচজন মিলেমিশে এটা-সেটা খেলা করেছে।     

রাতে আমাদের দুই বেডরুমে উপরে-নিচে মোট চারটা বিছানা করে সাতজন মানুষের ঘুমের আয়োজন। আমার বেডরুমে উপরের বিছানায় পাখি ও ওর খালা। আর নিচে আমার ছেলে আর আমি। প্রথম রাতেই আমি লক্ষ্য করি – পাখী খুব উশখুশ করেছে – অনেক রাত অবদি।

arzu-alpha-edited
আলফা আরজু

পরের রাতে ওর উশখুশ দেখে -আমি জিগ্যেস করলাম। কী হয়েছে, মা? ক্ষিদে পেয়েছে? মায়ের কথা মনে পড়ছে? ও সুন্দর করে ইংরেজি ও বাংলা মিশিয়ে উত্তর দেয় “আমি Lullaby শুনছি, ঘুমানোর জন্য।” ওর বয়সের জন্য সেটাই স্বাভাবিক। তারপরও আমার আট বছরের ছেলে দুষ্টামি করে বলে – আপু, তুমি এখনো লুল্লাবি শুনে ঘুমাও? জবাবে পাখি বললো – আমার ঘুমের কষ্ট হয়।

শুনে খুব খারাপ লাগলো ! তাই চুপ করে রইলাম – কী বলবো? এতো ছোট বাচ্চা- ঘুমাতে কষ্ট হয়। কিন্তু আমার ছেলে জিগ্যেস করলো – কেন তোমার ঘুমাতে কষ্ট হয়? তারপর পাখী যা যা বললো, নিজে না শুনলে বিশ্বাস করতাম না।

এরই মধ্যে আমার ছেলে আর পাখির খালা ঘুমিয়ে গেছে। আমি আর পাখি সজাগ। পাখি নিজে থেকেই বলে – আন্টি তুমি কি জানো – আমার জন্ম সৌদি আরবে? আমার জবাবের অপেক্ষা না করেই ও আবার বললো – আমার বাবা ওখানে ভালো জব করতো। আমাদের বাসা ছিল মক্কা শরীফের খুব কাছে একটা হিলের উপর। আমরা হেঁটেই অনেকদিন মক্কা শরীফে যেতাম। এইসবের ফাঁকে ফাঁকে ও বলতে থাকে – আন্টি আমি যখন খুব ছোটো – তখন বাবা মা’কে মারতো সারা শরীরে – মা অনেক কষ্ট করে মায়ের পেটটা বাঁচাতো – যাতে আমি ব্যথা না পাই!

সেখান থেকে আমি বাংলাদেশে গেছি, তারপর অস্ট্রেলিয়াতে। আমি তিনটা দেশেই স্কুল করেছি। মানে ওইটুকু ১১/১২ বছরের বাচ্চাটার শুরু থেকেই একটা অস্থির জীবন। কখনো ও সৌদিতে, কখনো ও বাংলাদেশের রংপুরে আবার কখনো সিডনিতে।

এর মধ্যে আবারও বলতে শুরু করলো – “আমি একদিন স্কুলে (সিডনিতে) গেছি – হঠাৎ করে মা স্কুলে এসে আমাকে নিয়ে একটা রিফুজ (শেল্টার হোম) এ উঠে। তারপর থেকে আমি আর মা অনেকদিন কাউন্সেলিং ও পুলিশের কাছে গেছি। মায়ের তখন খুব ফিনান্সিয়াল হার্ডশিপ গেছে।”   

পাখি আবার বলতে থাকে – “প্রথমে যখন আমাদের বাসা থেকে বের করে দেয় বাবা, তখন আমরা এক আত্মীয়ের বাসায় উঠেছিলাম – সেখানে একটা পাজি আঙ্কেল ছিল – আমার সাথে inappropriate আচরণ (যৌন হয়রানিকে শিশুরা এখানে inappropriate behave বলে!) করলে আমি মাকে বলে দেই – মা সেটা নিয়ে ঝগড়া করলে আমাদের ওই বাড়ি থেকে বের করে দেয়। তারপর আমরা অনেক বাড়ি বাড়ি থেকেছি – শেয়ার করে অন্যদের সাথে।”

“মায়ের সাথে কী হয়েছিলো -জানো? বাবা আসলে দেশে আরেকটা বিয়ে করেছে – একটা বাচ্চাও আছে ওর। কিন্তু আমার মাকে বলেনি। মাকে প্রায় মারতো। মা অনেক কষ্ট পেয়েছে। কিন্তু আমি এইসব ভাবি না। “ওই লোকটা আমার মায়ের কথা, আমার কথা ভাবে নাই। জানো? – আমার নানুর সাথে এইরকম হয়েছে, মার সাথেও আবার আমার ওই খালার হাজব্যান্ডটা (ও আমার সাথে inappropriate ব্যবহার করেছে!)।”

আমি কী বলবো – কোনো সান্ত্বনা দেবার ভাষা আমার নেই। আমি শুধু বললাম – “ভালো করে স্টাডি করো, অনেক বড় হতে হবে – মায়ের পাশে দাঁড়াতে হবে” – এই সব আট-দশজনের মতো আর কী!

কিন্তু এরপর সারারাত আমি ওর মা হয়ে ঘুরে এসেছি রংপুর, লালমনিরহাটে- উচ্ছল ও প্রাণবন্ত শৈশব, তারপর ২২ বছরের একটা মেয়ের সৌদি আরবে সংসার, তারপর উপরের দৃশ্যপট! আর ঘুমাতে পারিনি – ওই রাতে।

আমি ওর মাকে চিনি না। দেখা বা কথাও হয়নি কখনো। কিন্তু ওর মা’কে অনুভব করার জন্য – যা যা দরকার তার সব আমার আছে। আমার দুঃসহ অতীত আছে, আমি একজন মা। যাহোক, কয়েকদিন আমি পাখি’র ঘোরের মধ্যে ছিলাম। এর মধ্যে দেশ-বিদেশে অনেক কিছু হয়ে গেছে। কিন্তু আমি পাখিকে নিয়েই ছিলাম। পাখি সারা দিন-রাত আমার সামনে।

এই পাখির সাথে আমার অনেকগুলো অপ্রাসঙ্গিক নাম মনে পড়লো – খাদিজা (বদরুলের কোপের আঘাতে নির্মমভাবে আহত হয়ে হাসপাতাল), রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক আকতার জাহানের চলে যাওয়া, রিশা (বাচ্চা একটা মেয়েকে দিনেদুপুরে খুনির হাতে মরতে হলো), সোহাগী জাহান তনু (উনিশ বছরের তনুকে ধর্ষণ করে খুন, মার্চ ২০, ২০১৬), মাফরুদা হক সুতপা (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের ছাত্রী সুতপা ১৯ সেপ্টেম্বর ২০০৯ সালে স্বামীর বাড়িতে মারা গিয়েছিলো অথবা মেরে ফেলা হয়েছিল), সিমি বানু (স্থানীয় মাস্তানদের অত্যাচারে আত্মহত্যা করেছিল ২০০১ সালে)।

মহিমা খাতুন (ছত্রদল ও জামাতশিবির নেতাদের দ্বারা ধর্ষিত হওয়ার পর আত্মহত্যা করে ২০০২), শাহিনুর (ধর্ষণের শিকার হয়ে আত্মহত্যা করেন ২০০৩), বিভা রানী সিং (অপহণের পর এক সপ্তাহ ধরে ধর্ষণের শিকার হয়ে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন ২০০৩ সালে), ফারজানা আফরিন রুমি (আত্মহত্যা করেন স্থানীয় মাস্তানরা অপহণের জন্য তার বাড়িতে প্রবেশ করলে, ২০০৩), আলপনা (চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্রী আত্মহত্যা করেন মায়ের সামনে নির্যাতিত হবার পর ২০০৩), চামেলী ত্রিপুরা (নয় বছরের শিশুকে ধর্ষণের পর খুন করা হয় ২০০৮ সালে)।

মডেল তিন্নি (সায়েদা তানিয়া মাহবুব তিন্নি যার লাশ বুড়িগঙ্গা নদী থেকে উদ্ধার করা হয় ২০০২ সালে, সাবেক সাংসদ গোলাম ফারুক অভি যেই খুনের সাথে জড়িত ছিলেন!)। আরো কত জানা-অজানা নাম, কতশত জন সংবাদের শিরোনাম হয়েছেন অথবা হননি।    

তাই একটা মেয়ে নাম যাই হউক – কী পাখি, কী খাদিজা, সিমি, সুতপা, মহিমা, তিন্নি , রিশা, নাহ তনু, নাকি আফরোজা, একটা হলেই হলো। ওদেরকে পেটান, অ্যাসিড মারেন, খুন করেন – ভয়ের কিছুই নাই। কখনো আপনাদেরকে রাজনৈতিক দল আশ্রয় দিবে, কখনও পরিবার, আইন অথবা টাকা আপনাদের নিরাপদ আশ্রয় দিবে।   

শেয়ার করুন:

আরিফা অভিনন্দন নির্মম সত্যকে নিয়ে লেখাটি শেযার করার জন্য। বেশীরভাগ মানুষ বলবে পাখির মা সব সহ্য করে মেয়েকে বুকে আগলে ধরে ঘরের কোনে চুপটি করে বসে থাকল না কেন? কিন্তু একবারও ভাবে না এবং বলে না পাখির বাবা আঙ্কেলদের মত পুরুষরা সংশোধন হচ্ছেনা কেন, কি করলে সংশোধন হবে, কিভাবে তাদের অমানুষ থেকে মানুষ বানানো যাবে। এমন হাজার পাখির জন্য আমরা কষ্ঠ পাওয়া ছাড়া আসলে কিছুই করতে পারছিনা। বর্বরতার মধ্যে থেকেও সভ্যতার খোলস পরে ভাল থাকার ভান করছ। ধন্যবাদ সুন্দর লিখার জন্য।