জান্নাতুন নাঈম প্রীতি: কয়েকমাস আগে বিখ্যাত হলিউড অভিনেত্রী অ্যাঞ্জেলিনা জোলি নিজের স্তন অপসারণ করে শোরগোল ফেলে দিয়েছিলেন। পুরুষের চোখে সৌন্দর্য নয়, বরং নিজেকে স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি থেকে মুক্ত রাখতেই জোলির এই উদ্যোগ ছিল। পাশাপাশি স্তন ক্যান্সার প্রতিরোধে নারীদের সচেতন করাও ছিল তাঁর উদ্দেশ্য।
তাঁর উদ্দেশ্য কতোটুকু সফল হয়েছে তা বোঝা দুষ্কর। কারণ এতদসত্ত্বেও থেমে নেই স্তনকে তথাকথিতভাবে সুগোল, সুডৌল, সুকোমল, সুন্দর করে তোলার অপপ্রয়াসটি। থেমে নেই ট্রাপলেস, চেইনলেস, পেইনলেসসহ নানারকম হার্ড এন্ড নাট ব্রা আর বুক কৃত্রিম উপায়ে ছোটোবড় করে তোলার ক্রিমের, মেশিনের, সার্জারির রমরমা বাণিজ্যের। তবুও পৃথিবীর প্রায় চল্লিশভাগ নারী যে রোগের ঝুঁকিতে আছে তাকে হেলাফেলা করার মতন ক্ষমতা আমার নেই। কাজেই বেঁচে থাকার স্বার্থে কিছু সৌন্দর্যনাশক কথা আমি বলবোই।
স্তন ক্যান্সার ঠিক কেন হয় তার যথাযোগ্য যেসমস্ত ব্যাখ্যা এবং তথ্য উপাত্ত পাওয়া গেছে সেগুলির অন্যতম তিনটি হলো- স্তনকে বৃদ্ধি বা হ্রাস করার জন্য অতিমাত্রায় কেমিক্যাল প্রোডাক্ট ব্যবহার করা, অতিমাত্রায় পারফিউম ও ডিওডোরেন্ট ব্যবহার করা, অধিক সময় ধরে ব্রা বা বক্ষবন্ধনী পরে থাকা। বিজ্ঞানী ও গবেষকরা কারণ হিসেবে দেখিয়েছেন, পারফিউম এবং ডিওডোরেন্টে থাকে ক্ষতিকর সিলিকন, সীসাজাতীয় পদার্থ। এগুলি ঘামের সঙ্গে লোমকূপে ঢুকে অথবা বিক্রিয়া করে ক্ষতিকর কারসিনোজেনিক এজেন্ট তৈরি করে। যা থেকে দীর্ঘদিন এসব রাসায়নিক শরীরের চামড়ায় ব্যবহারের ফলে শুধুমাত্র ক্যান্সারের ঝুঁকিই বাড়ে না, পাশাপাশি বেড়ে যায় স্বাস্থ্যঝুঁকিও। আর ‘ব্রেস্ট ক্রিম’ বা ‘ব্রেস্ট এসেন্স’ নামের যে ক্রিমগুলি বাজারে পাওয়া যায়, তা শরীরের হরমোনের পর্যন্ত তারতম্য ঘটিয়ে ফেলতে পারে, ফলে বুকের আকৃতি পরিবর্তিত হয়ে যায়। হরমোনাল ইমব্যালান্সকে স্তন ক্যান্সারই শুধু নয়, অন্যান্য কান্সারেরও অন্যতম কারণ হিসেবে তাই চিহ্নিত করেছেন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ক্যান্সার গবেষণা সংস্থা- আমেরিকার স্লোয়ান-কেটারিংয়ের গবেষকরা। পাশাপাশি দিয়েছেন কিছু মেনে চলার মতন সহজ টিপস-
১। দীর্ঘক্ষণ ব্রা পরে থাকা অনুচিত। দিনের একটা নির্দিষ্ট সময়, অন্তত ঘন্টাখানেকের জন্য খুলে রাখুন আপনার বক্ষবন্ধনী।
২। ব্রেস্ট ক্রিম ও এসেন্স পরিহার করুন, এগুলি স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ায়। ফোমওয়ালা, অধিক শক্ত ব্রা পরিহার করে পাতলা সুতি কাপড়ের বক্ষবন্ধনী ব্যবহার করুন।
৩। নিয়মিত ডিওডোরেন্ট ব্যবহার পরিহার করুন। কারণ এগুলি শরীরের জন্য দূষণীয় এবং লোমকূপে সিলিকন ও সীসাজাতীয় পদার্থ জমতে সাহায্য করে।
৪। প্রতি চার মাস অন্তর অন্তর হেলথ চেকআপ করান, স্তন ক্যান্সারের স্বাভাবিক লক্ষণগুলো, যেমন- বুকে র্যাশ ওঠা, মারাত্মক চুলকানো, বুকে ব্যথা হওয়া, বুকের অভ্যন্তরে গোটার মতন অনুভব করা, দীর্ঘক্ষণ স্বাভাবিকের তুলনায় অস্বাভাবিক বুক ভারী লাগা, স্তনের বোঁটায় ফুসকুড়ি হওয়া বা পুঁজ হওয়া- ইত্যাদি যেকোনো একটি আলামত পেলেই ডাক্তারের কাছে যান। পরীক্ষা করুন।
৫। প্রতিদিন নিয়মিত বগল এবং শরীরের অভ্যন্তর পরিষ্কার রাখুন। রাতে ঘুমাতে যাওয়ার সময় ব্রা ও টাইট পোশাক পরিহার করুন। দীর্ঘক্ষণ সুগন্ধি মেখে থাকার প্রবণতা দূর করুন।
এদেশে মেয়েদের উত্যক্ত করার জন্য বখাটেদের সবচেয়ে প্রিয় উক্তি হচ্ছে, “তোমার ব্রা’র সাইজ কত? বুকের মাপ কত?” একটু বড় হওয়ার পর দেখলাম মেয়েরা নিজেরাও ‘স্তন’ শব্দটা উচ্চারণেও ভীষণ লজ্জা পায়। কারণ আর কিছুই না। ছোটোবেলা থেকে শেখানো হয়- স্তন ব্যাপারটা খুব লজ্জার, সেটা ঢেকে রাখতে হয় নানারকম কাপড় দিয়ে। একটু বড় হলে যখন স্তনের কারণে ওড়না পরা শুরু হয় তখন সবচেয়ে বড় চেষ্টা করা হয় ‘আমার স্তন নেই’ এমন একটা ভাব দেখানোর!
প্রতিদিন পৃথিবীতে স্তন ক্যান্সারে কতজন মেয়ে মারা যায় জানেন? আমেরিকার ব্রেস্ট ক্যান্সার স্ট্যাটিস্টিকস রিপোর্ট বলছে- গবেষণা অনুযায়ী ও স্তন ক্যান্সারে মৃত্যুর হার অনুযায়ী চলতি বছর শুধুমাত্র আমেরিকাতেই মারা যাবে ৪০,৪৬০ জন! ইংল্যান্ডের জরিপ আরও ভয়াবহ, সেখানে একমাসে স্তনক্যান্সারজনিত মৃত্যুর সংখ্যা ১০০০ এরও বেশি!
তবুও থেমে নেই স্তনকে আকর্ষণীয় করে তোলার ভুল চেষ্টা। কারণ পুরুষতান্ত্রিক সমাজ শিখিয়েছে স্তন থাকবে ধনুকের ছিলার মতন টানটান, সুডৌল। যদি তা না হয় তাহলেই শুরু হয়ে যায় ব্রেস্ট ক্রিম, ব্রেস্ট এসেন্স আর ফোমওয়ালা শক্ত কার্ডের মতন ব্রা পরে নিজেকে আদর্শ স্তনের অধিকারিণী প্রমাণের অপচেষ্টা। সেই সঙ্গে স্তনের আকৃতি একটু বড় হলে ঝুঁকে হাঁটা তো থাকেই।
কাজেই কন্যারা এবং নারীরা- সচেতন হন। নিজের বুকটিকে অস্বীকার না করেন সোজা হয়ে দাঁড়ান। মেরুদণ্ডটি সোজা রেখে অন্য নারীকে সচেতন করুন। ক্যান্সারের ঝুঁকিমুক্ত থাকুন। কারণ রোগের নাম মুখে নেওয়াতে লজ্জা নেই, লজ্জা রোগ লুকানোতেই!

পুরনো দিনের কমন ডায়ালগ- ‘ক্যান্সার, নো অ্যানসার’ কথাটা ভুলে যান। দৃঢ় গলায় বলুন- স্তন ক্যান্সার? আই হ্যাভ অ্যান অ্যানসার!
তথ্যসূত্রঃ
১। The Guardian
২। New York Times
৩। U.S. Breast Cancer Statistics | Breastcancer.org
৪। Breast cancer statistics | Cancer Research UK
www.cancerresearchuk.org
৫। www.cancer.net
৬। Award Winning CRO – Extensive Oncology Experience – medsource.com