মোহছেনা ঝর্ণা: “আমার রক্তের মধ্যে বিচিত্র অভিজ্ঞতা মিশে রয়েছে। এ কথা ঠিক, মাথার বন্দুকের কুদোর গুঁতা আমার শ্বাসনালী চিরে রক্তের ঝলক নামিয়েছে। নারীর অবমাননাকর রক্তপাতের কথাও কিভাবে ভুলি এবং কেন-ই বা ভুলব? কিন্তু আমার রক্তশূন্য পান্ডুর দেহ আবার যে প্রাণে সঞ্জীবিত হয়ে উঠেছে, তা আমি কোথায় পেয়েছিলাম? দোর্দণ্ড শাসকদের অত্যাচারের পাশে পাশে সেবা ভালোবাসার যে হৃদয়গুলো আমাকে ঘিরে রয়েছে,তাদের কথাও যে সমান সত্য। দিনের পর দিন আমার শিরায় বাইরের রক্ত জোগাতে হয়েছে। এ কথাটাও কীভাবে ভুলি, সেই লাল জীবন মুসলমান ভাইদের দেহ থেকে সংগৃহীত হয়েছিল। রক্তের কোনো জাত আছে কি না জানি না,যদি থেকে থাকে তবে আমি অবশ্যই জাতহীন।” – ইলা মিত্র, পূর্ব বাংলা আজও আমার তীর্থভূমি।

ইলা মিত্র। নাচোলের রানী, তেভাগা আন্দোলনের নেত্রী,কৃষক বিদ্রোহের নেত্রী…। মালেকা বেগম রচিত “ইলা মিত্র নাচোলের তেভাগা আন্দোলনের নেত্রী” বইটি পড়ে জায়গায় জায়গায় শিহরিত হয়ে যেতে হয়েছে।
তেভাগা আন্দোলনটা কি? মূলত তেভাগা আন্দোলনের দাবি ছিল বর্গাচাষীদের উতপাদিত ফসলের তিনভাগের দু’ ভাগ পাবে কৃষক বা বর্গাচাষীরা আর একভাগ পাবে জোতদার- জমিদার বা ভূমির মালিকেরা।
কিন্তু শোষক শ্রেণী জোতদাররা কৃষকদের বঞ্চিত করে উৎপাদিত ফসলের দু’ভাগ নিজেদের গোলায় তুলতে চাওয়াকে কেন্দ্র করেই এই কৃষক বিদ্রোহের সূত্রপাত।
১৯৪৯ সালের শেষ সময়ে শুরু হয়ে ১৯৫০ সালের প্রথমকাল অবধি চাঁপাইনবাবগঞ্জ এর নাচোলে তেভাগা আন্দোলন বা কৃষক বিদ্রোহের দাবানল তুঙ্গে উঠেছিল।
এই তেভাগা আন্দোলনে নাচোল ছাড়াও অন্যান্য জেলায় কৃষক পরিবারের নারীরা অংশগ্রহণ করেছিল। ১৯৪৬ সালের ১৪ ডিসেম্বর ঠাকুরগাঁও মহাকুমার আটোয়ারী থানার রামপুর গ্রামের রাজবংশী কৃষাণি দীপেশ্বরীর বীরত্ব তেভাগা আন্দোলনের অন্যান্য কর্মী, আন্দোলনকারীদের অনুপ্রাণিত করেছিল।
কে এই ইলা মিত্র? ১৯২৫ সালের ১৮ অক্টোবর কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন ইলা মিত্র। জন্ম কলকাতায় হলেও তাদের আদি নিবাস ছিল যশোরের ঝিনাইদহের বাগুটিয়া গ্রামে। বাবার চাকরি সুবাদে বেড়ে ওঠা কলকাতাতেই।পড়ালেখা করেছেন বেথুন স্কুলে, বেথুন কলেজে ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। খেলাধুলায় ১৯৩৬ থেকে ১৯৪২ সাল পর্যন্ত ছয় বছর সারা বাংলায় ইলা মিত্রের নাম ছিল প্রথম সারিতে। ১৯৪০ সালে জাপানে অনুষ্ঠিতব্য অলিম্পিকের জন্য (প্রথম বিশ্বযুদ্ধের জন্য সেবার অলিম্পিক হয়নি) প্রথম বাঙালি মেয়ে হিসেবে ভারতীয় দলে নির্বাচিত হয়েছিলেন ইলা মিত্র।সাঁতার, এথলেটিক্স, বাস্কেটবল, ব্যাডমিন্টন সহ সব ধরনের খেলাতেই তিনি ছিলেন পারদর্শী।
শুধু এটুকুর জন্যই তো তিনি সারাজীবন নন্দিত থাকতে পারতেন জমিদার বাড়ির গিন্নী হয়ে। কিন্তু না, ইলা মিত্ররা শুধু নিজের জন্য বাঁচেন না, নিজের জন্য লড়াই করেন না। অন্যদের জন্য লড়াই করেন, অন্যদের নিয়ে বাঁচেন।তাই তো প্রয়োজনে, নিজেকে, নিজের জীবনকে, নিজের জীবনের আনন্দ আয়োজনকে অচেনা অজানা সাঁওতাল কৃষকদের অধিকার আদায়ের জন্য উৎসর্গ করতে দ্বিধা করেন নি।
১৯৪৫ সালে চাঁপাইনবাবগঞ্জ এর রামচন্দ্রপুর এলাকার কমিউনিস্ট নেতা জমিদার বাড়ির ছেলে রমেন মিত্রের সাথে বিয়ের পর থেকেই মূলত নাচোলের তেভাগা আন্দোলনের সাথে জড়িয়ে যায় তার নামটি। মাত্র ১৬ দিন বয়সী পুত্র মোহনকে শাশুড়ির জিম্মায় রেখে ছুটে গেছেন কৃষকদের অধিকার আদায়ের জন্য নাচোলের গ্রামের পর গ্রামে। ইলা মিত্রের শ্বাশুড়িও ছিল অসাম্প্রদায়িক মানসিকতা সম্পন্ন।তাই তো ১৯৪৭ সালে দ্বিজাতিতত্ত্ব ধরে দেশ ভাগ হলে রমেন মিত্রদের বাড়ি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সীমানার মধ্যে পড়ে। তখন এদেশ ছেড়ে ভারতে যাবে কিনা সে প্রশ্নও যখন সামনে চলে এলো তিনি বেশ সাহসিকতার সাথেই বললেন, এদেশে এই মুসলমানদের সাথেই তো এত বছর থেকে এসেছেন, তাই তাদের ছেড়ে তিনি কোথাও যাবেন না। ১৯৫০ থেকে ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত রাজশাহীর কারাগারে বন্দী ছিলেন ইলা মিত্র। কারাবন্দী অবস্থায় তিনি যে নির্মমতার শিকার হন তা তার জবানবন্দী পড়লে মনে হয় চোখের সামনে ভাসছে দু:সহ স্মৃতি হয়ে। ইলা মিত্রের জবানবন্দী’র কিছু অংশ,”সেলের মধ্যে আবার এসআই সেপাইদের চারটে গরম সেদ্ধ ডিম আনার হুকুম দিল এবং বলল,এবার সে কথা বলবে। তারপর চার পাঁচজন সেপাই আমাকে জোরপূর্বক ধরে চিত করে শুইয়ে রাখল এবং একজন আমার যৌনাংগের মধ্যে একটা গরম সিদ্ধ ডিম ঢুকিয়ে দিল। আমার মনে হচ্ছিল আমি যেন আগুনে পুড়ে যাচ্ছিলাম। এরপর আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ি।
০৯-০১-৫০ তারিখ সকালে যখন আমার জ্ঞান ফিরল,তখন উপরিউক্ত এসআই ও সেপাই আমার সেলে এসে তাদের বুট দিয়ে আমার পেটে লাথি মারতে শুরু করল। এরপর আমার ডান পায়ের গোড়ালিতে একটা পেরেক ফুটিয়ে দেয়া হলো। সে সময় আধা অচেতন অবস্থায় পড়ে থেকে আমি এসআইকে বিড়বিড় করে বলতে শুনলাম, আমরা আবার রাতে আসছি এবং তুমি যদি স্বীকার না করো, তাহলে সেপাইরা একে একে তোমাকে ধর্ষণ করবে। গভীর রাতে এসআই ও সেপাইরা ফিরে এল এবং তারা আবার সেই হুমকি দিল। কিন্তু যেহেতু তখনো কিছু বলতে রাজি হলাম না, তখন তিন- চারজন আমাকে ধরে রাখল এবং একজন সেপাই সত্যি সত্যি আমাকে ধর্ষণ করতে শুরু করল। এর অল্পক্ষণ পরেই আমি অজ্ঞান হয়ে পড়লাম। “কি ভয়ংকর নির্মমতার মধ্যে দিয়ে গেছে তার জীবন! কী বীভৎস!
অথচ মালেকা বেগমকে লেখা চিঠিতে তিনিই বলছেন, তিনি যেরকম নির্যাতিত হয়েছিলেন তার সাঁওতাল সাথীরাও তার চেয়ে কম নির্যাতিত হয়নি। নবাবগঞ্জ থানায় গিয়ে তিনি নিজের চোখেই দেখেছেন সাঁওতাল কৃষকদের উপর কি অমানুষিক নির্যাতন চলছে। হারেক নামের একজন কৃষকসহ কয়েকজনকে মারতে মারতে মেরেই ফেলল থানার লোকজন কিন্তু কারো মুখ থেকে তাদের রানি মা ইলা মিত্রের বিরুদ্ধে কোনো কথাই বের করতে পারেনি। রানিমা তাদেরকে পুলিশ খুন করার জন্য বলেছে, শুধু এইটুকু স্বীকার করলে সে যাত্রায় হয়তো তারা প্রাণে বেচে যেত কিন্তু তারা প্রাণ দিয়ে তাদের রানিমা’র ভালোবাসার প্রতি সম্মান দেখিয়ে গেছে।
মানুষ কতখানি উদারতা, কতখানি মহত্ব,কতখানি ভালোবাসা সহযোদ্ধাদের জন্য নিজের মধ্যে লালন করলে এভাবে বলতে পারে, নিজের ভয়াবহ যন্ত্রণাকে পাশকাটিয়ে সহযোদ্ধাদের ত্যাগ আর ভালোবাসাকেই বেশি গুরুত্ব দিতে পারে। ১৯৫৪ সালে চিকিৎসার জন্য তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সরকার ইলা মিত্রকে প্যারোলে মুক্তি দেয়। চিকিৎসার জন্য কলকাতায় গিয়ে দীর্ঘদিন কলকাতায় পর সুস্থ হয়েও তিনি ভারতেই থেকে গেলেন। তার স্বামী রমেন মিত্র ও ১৯৫০ সালে এদেশ ছেড়ে কলকাতায় চলে যায়।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে ১৯৭৪ সালে ইলা মিত্র একবার শিক্ষক সমিতির সম্মেলনে যোগ দিতে বাংলাদেশে আসেন। এরপর ১৯৯৬ সালের ৪ নভেম্বর তেভাগা আন্দোলনের ৫০ তম বার্ষিকী উদযাপনের জাতীয় কমিটি, বাংলাদেশ আয়োজিত অনুষ্ঠানে যোগদানের জন্য ইলা মিত্র ঢাকায় আসেন।
নাচোলের রানীমাকে বন্দী অবস্থায় চরম বর্বরতার মধ্য দিয়ে যেতে হলেও তার রক্তে যে অন্যের জন্য কিছু করার নেশা তা স্পষ্ট হয়ে উঠে তখন। যখন দেখা যায় ১৯৬২ থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত চারবার তিনি পশ্চিমবঙ্গ কমিউনিস্ট পার্টি থেকে বিধান সভার সদস্য হয়েছেন।
১৩ অক্টোবর, ২০০২ সালে ইলা মিত্রের বর্ণাঢ্য জীবনাবসান হয়।
ইলা মিত্র, এই মানুষটার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা। ইলা মিত্রকে নিয়ে লেখা বইয়ের ভূমিকায় লেখক মালেকা বেগম যথার্থই লিখেছেন, “ইলা মিত্রের ইতি নেই। অন্তহীন তার ইতিহাস, ইতিবৃত্ত ও ইতিকথা।”