নারীর মাতৃত্বকাল এবং পুরুষতন্ত্রের আক্রোশ

আফরোজা চৈতী: নারীর অধিকার, নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে আমরা সরকার, মিডিয়া, নারী নেত্রীগণ, করপোরেট, এনজিও সব ফাটাই ফেলতেছি! অথচ গর্ভাবস্থায় কয়জন নারী তার সহকর্মী অথবা ঊর্ধ্বতন কতৃপক্ষের কাছে সঠিক আচরণ পান?এমনও অনেককে কি শুনতে হয় না যে, তার এই পেশাতেই আসা উচিৎ হয়নি, অথবা তার জন্য ব্যাংক বা সরকারি চাকরি অথবা শিক্ষকতাই ভালো!

mother-1কেন? কারণ সে গর্ভধারণ করে, তার মাতৃত্বের এক অসাধারণ ক্ষমতা আছে, এটা তার অযোগ্যতা! সরকার মাতৃত্বকালীন যে ছুটি ঘোষণা করেছে, সেটা সব প্রতিষ্ঠানে কেনও এখনও মানা হবে না? কেনও এখনও অনেক নারীকেই তার মাতৃত্বকালীন ন্যুনতম ভাতা থেকে বঞ্চিত করা হয়? কেনও আমার গর্ভবতী একজন সহকর্মীর প্রতি আমি সহানুভূতির হাত বাড়িয়ে দিতে পারি না? যে অবস্থানটা সে তিল তিল করে বছরের পর বছর শ্রম দিয়ে তৈরি করে, সেটা শুধুমাত্র সন্তানধারণের অপরাধে তাকে ছেড়ে দিতে হবে? তাকে শুনতে হবে, আপনি পারবেন না অথবা কী দরকার এতো চাপ নেয়ার? কে বইলছিলো এই পেশায় আইসতে, ওর এখন চাকরী ছাইড়ে দেয়াই উচিত!

একটা কাজ কি শুধুই পয়সা উপার্জনের জন্য করে একজন নারী বা পুরুষ? বরং সেই পেশার সাথে থাকে সেই মানুষটির নিজস্ব একটি অস্তিত্ব, একটি পরিচয়। সে কারো মা, কারো বাড়ীর বৌ, কারো বোন, কারো স্ত্রী, কারো আদরের আহ্লাদী মেয়ে, এই পরিচয়গুলো যেমন বহন করে, তেমনি সে একজন প্রফেশনাল, সেই পরিচয়টাকেও সযত্নে লালন করে।

আপনার কোলে খেলা করা আপনার স্নেহের কন্যাটিও একদিন এই বিশেষ সময়টি পার করবে, তখন তার জন্যও কি অপেক্ষা করছে একই বৈষম্য আর চোখের জল? আমরা সব জেনে বুঝেও দিনের পর দিন অন্যায়টাকেই ন্যায়ের পোশাক পরিয়ে মেনে নিই, আর যারা মানি না তাদেরও প্রতিনিয়ত লড়াইটা চালিয়ে যেতে হয় স্রোতের বিপরীতে। অথচ বিশেষ ঐ সময়টা বিশেষ ঐ একজনকে বিশেষ একটু সহযোগিতা যদি আমরা সহকর্মীরাও সবাই মিলে করি, সেটাও তার জন্য অনেক স্বস্তির, অনেক সম্মানের। দিনশেষে যারা এই পৃথিবীতে আসছেন, নিঃশ্বাস নিচ্ছেন, চলে-ফিরে খাচ্ছেন, তারাও তো নারীর এই বিশেষ গুণটির কারণেই পৃথিবীর মুখ দর্শন করেছিলেন, তাই না?

সুতরাং মায়ের সম্মান রক্ষার্থে হলেও তো এই বিশেষ সময়টা তাকে অবশ্যই বিশেষ যত্নটা দেয়া উচিৎ। সেটা কী কর্মক্ষেত্রে, কী পরিবারে, কী সমাজে! অথচ ঘটছে তার উল্টো। সে গর্ভবতী, সুতরাং তাকে দিয়ে তো কোনও কাজই হবে না! আহা! কী দরকার এখন চাকরির! এই পেশায় তাহলে কেন এলো? অদ্ভুত ,অদ্ভুত সব যুক্তি আর উপদেশে বেচারীর নাজেহাল অবস্থা! এতো গেলো মা হওয়ার আগে, মা হওয়ার পরও তাকে নিয়ে সকলের অভিযোগের শেষ থাকে না। প্রাপ্য সম্মান বা সম্মানীও জোটে না অনেক প্রতিষ্ঠানেই। আর ছয়মাস মাতৃত্বকালীন ছুটি সেতো গুটিকয় সরকারি, আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ছাড়া সোনার পাথরবাটি।

যে কর্মীটা তার শ্রম, আর একাগ্রতায় প্রতিষ্ঠানের কাছে আদরণীয় থাকে, আবার সেই কর্মীটিকেই আর কাজে লাগছে না বলে ছুঁড়ে ফেলে দিতেও একমুহূর্ত সময়ক্ষেপন করেন না তারা!

সত্যি বড় অদ্ভুত এই কর্পোরেট সংস্কৃতি! আর আমরাও হাওয়া যেদিকে যায়, নিজেরাও সেদিকেই দৌঁড়াই! ন্যায় বা অন্যায় সেখানে মুখ্য নয়, হাওয়াটাই মুখ্য।
সুতরাং হাওয়া বদলের খেলায় আমার প্রিয় সহকর্মী যদি বলী হয় হোক না, আমার কী!

chaity-afroza
আফরোজা চৈতী

এ এক অদ্ভুত সংস্কৃতির বিপরীতমুখিতায় প্রতিনিয়ত আমাদের বেড়ে উঠা, মুখে বলি নারীর ক্ষমতায়ন, নারীবান্ধব কর্মপরিবেশ, আবার এই নারী সহকর্মীই যখন তার সংসার, বাচ্চা সব সামলে প্রাণান্তকর চেষ্টা চালিয়ে যান তার কাজের জায়গাটা ঠিকঠাক রাখতে, সেখানেও অন্যদের চোখে বা মুখে ফুটে উঠে, আরে ও পারবে না, অথবা না ওরে দিয়ে হবে না! তখন জন্মগতভাবেই পিছিয়ে পড়া মেয়েটির আত্মবিশ্বাসটাও যেন আরো নড়বড়ে হয়ে যায়। সে ভাবতে শুরু করে তার ভেতরের প্রাণটি যেন আলাদা কোনও বোঝা!

আমারই এক সহকর্মী বলেছে, আপু ওকে এই পৃথিবীতে না আনলেই বুঝি ভালো হতো! চোখভর্তি জল নিয়ে ওর মুখ চেপে বলি, ছিঃ, এমন কথা বলতে নেই, যেন গণমাধ্যমে বা যেকোনো চ্যালেঞ্জিং কাজেরই পূর্বশর্ত সংসার, বাচ্চা এই সমস্ত না থাকা!

বহু মেয়েকে চোখের জল নিয়ে তার প্রিয় কর্মক্ষেত্র থেকে বিদায় নিতে হয় শুধুমাত্র একটু সহযোগিতা আর কর্তৃপক্ষের বিরুপ মনোভাবের কারণে। সবাই জানেন, মেয়েটির অক্ষমতা সে যুদ্ধে জয়ী হতে পারেনি, আর তাই হেরে গিয়ে মাঠ থেকেই বিদায় নিয়েছে! চাপা পড়ে যায় অভিমন্যু বধের অন্যায় গাঁথা।

শেয়ার করুন: