ফাহরিয়া ফেরদৌস: আকতার জাহান জলি, যিনি একজন শিক্ষক, যাকে আমি চিনি না, কিন্তু শেষ কয়দিন যাবত তাকে নিয়ে মানুষের গবেষণা, ভালোবাসা দেখে আমি আবেগে আপ্লুত হয়ে যাচ্ছি। জানলাম, তিনি আত্মহত্যা করেছেন। একটি “সুইসাইড নোট”ও রেখে গেছেন। তাতে লিখেছেন, তার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নন। তবে সারাংশ থেকে বোঝা যায়, তার এই মৃত্যুর জন্য তার বিবাহিত জীবন এবং তার প্রাক্তন স্বামী দায়ী!
আমি বলবো, না, জলির এটি আত্মহত্যা নয়, এটি হত্যা, এবং এই মৃত্যুর জন্য আমরা সকলে ও আমাদের ভালোমানুষি সাজার মনমানসিকতাই দায়ী। জলিকে নিয়ে আসলে আমরা কেউ লিখছি না, আমরা লিখছি আমাদের মেধা দেখানোর জন্য, মিডিয়া লিখছে তার পাবলিসিটির জন্য। আসলে আমরা কেউ জলিকে নিয়ে ভাবছি না, আবার এই বিষয়টি নিয়েও ভাবছি না যে, আর কোনো জলি যেন এভাবে নিজেকে শেষ করে না দেন।
জলিকে আমি চিনি না, তবে জলি কেন নিজেকে এমনভাবে শেষ করে দেবার কথা ভাবতে পারলো, বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় তাকে নিয়ে তার কাছের মানুষদের লেখা দেখে, সেটি একটু হলেও বুঝতে পারি।
অন্য কারো উদাহরণ আমি নেবো না, নিজের জীবনের ঘটনা ও অভিজ্ঞতা দিয়েই বিষয়টি বলতে চাই। এটি একটিমাত্র দিক। একা থাকা নারীদের শত শত দিক সামাল দিতে হয়। সেখানে কেউ জয়ী হয়, কেউবা হেরে যায় জলির মতোন।
‘বিয়ে’ শব্দটি এখন আমার কাছে একটা আতংকের নাম। অনেকটা ‘শেকল’ এর মতো!! বিয়ে এবং বিয়ে পরবর্তী বাচ্চা পয়দা করা ছাড়া বাঙ্গালী বিশেষ করে বাঙ্গালী মেয়েদের জীবনে কি আর কিছুই করার নেই! নিজেই মানুষ হতে পারিনি, সেখানে সন্তান জন্ম দিয়ে তারে মানুষ করবো, এখনো আমার সেই যোগ্যতা হয়নি।
আমার চাচাতো ভাই, যে আমার চেয়ে বছর চারেক এর ছোট। লেখাপড়া শেষ করে সে এখন আইন পেশাতেই আছে। কেউ তাকে বিয়ে করার কথা বলে না। অথচ আমার যখন অনার্স শেষের দিকে তখন থেকেই সবাই বিয়ের জন্য মাথা নষ্ট করে ফেলেছে, আর আমার যেহেতু একটি “প্রেম” ছিল তাই বিয়ে করাটা ফরয ছিল, তাই শেষ সেমিস্টারের ফাইনাল পরীক্ষা দেবার পর আংটি পরানোর কথা থাকলেও ছেলের বাবা ও ছেলের পরামর্শে সাতদিনের নোটিশে আমার বিয়ে হয়ে গেলো রেজাল্ট হবার আগেই। কিন্তু বলা হলো যে, তাদের প্রিপারেশন দরকার, তাই এখন বিয়েটা হয়ে থাক, পরে তুলে নেবো । রিলেশানটায় আমি সৎ ছিলাম ঠিকই, কিন্তু সেই মুহূর্তে বিয়ের অতটা ইচ্ছা আমার ছিল না।
জলির সাথে কিন্তু আমার অনেক জায়গায় মিল, মিলটা কতখানি সেটা বুঝেছি উইমেন চ্যাপ্টারে অধ্যাপক কাবেরী গায়েনের লেখা পড়ে। জলির মতো আমারও বিয়ে হয়েছিলো একই পেশার মানুষের সাথে, অর্থাৎ আমরা উভয়ই আইনজীবী এবং এখনো দুজনই বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টে স্ব স্ব অবস্থানে থেকে নিজেদের পেশা চালিয়ে যাচ্ছি।
জলির মতো আমারও প্রাক্তন “শাশুড়ি আম্মা” কখনো সরাসরি না বললেও, ফোন করে কখনও জিজ্ঞাসা করেননি যে, আমি কেমন আছি, ফোনে ঊনার প্রথম বাক্য ছিল “তোমার স্বাস্থ্য কি কমেছে?” বিয়ের পর ঊনি নানা বাহানায় আমাকে কোনদিনও তাদের কোন পারিবারিক অনুষ্ঠানে নিয়ে যাননি। প্রথম প্রথম আমার প্রাক্তন স্বামী আমাকে কোথাও নিয়ে যেতে চাইলেও পরে আর নিতে চাইতেন না, তাকে নিয়ে নাকি তার বন্ধুরা হাসাহাসি করতো মোটা বউয়ের কারণে!
বিয়ে শেষ হয়ে যাবার পরও শেষ যেবার কথা হলো, সেদিনও সে আমাকে বলেছিল, তার সাথে নাকি আমাকে মানায় না! অথচ আমাদের প্রেমের সম্পর্ক ছিল ২০০৫ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত! বিয়ের পর আমিও কোনদিন তার থেকে কোনো উপহার পাইনি। যদিও বিষয়টি উপহারের নয়, বিষয়টি ছিল ভাব প্রকাশের। বউয়ের সাথে ডাক্তারের কাছে যেতে তার সময় হতো না, তার নাকি ভয় লাগতো, পয়সা দেয়া তো দূরে থাকুক! তাই জলির মাঝে আমি নিজেকেই খুঁজে পাই।
এখন জলির জন্য তার সহকর্মিরা বা বন্ধুরা যে মায়া কান্না দেখাচ্ছেন, কেন? জলির এখন আর আপনাদের এই দেখানো কান্নার প্রয়োজন নেই।
যখন হঠাৎ করে আমার প্রাক্তন স্বামী অস্বাভাবিক আচরণ শুরু করলো, তখন কিন্তু আমি অনেকের কাছে সাহায্য চেয়েছি, কেউ হাত বাড়ায়নি। যাদের আমি কাছের ভেবেছিলাম তাদের কাছে সাহায্য চাইলেও তারা কেউ এগিয়ে আসেনি।
আমরা দুজনেই একই বিশ্ববিদ্যালয়ের, একই বিষয়ের ছাত্র-ছাত্রী এবং একই পেশায় থাকায়, আমাদের দুইজনের কমন অনেক পরিচিতজন আছেন, যারা চেষ্টা করলেই হয়তো বিষয়টি অন্যভাবে শেষ হতে পারতো।
বিয়েটা শেষ হয়ে যাবার পরপর কিন্তু আমাদের দুজনের পরিচিত অনেক মানুষ আমাকে জিজ্ঞাসা করলো, “তোমাদের বিয়েটি নেই, কী বলো, কীভাবে, কেন বলনি, ঘটনা কী?”

অথচ আগে কেউ সাহায্যের হাতটি বাড়ায়নি, বরং বলে গেছে একজনের কথা শুনে তো আর কিছু বলা যায় না! আবার সে যখন দ্বিতীয় বিয়ে করে হানিমুনে গেল, বেশ কয়েকজন সহকর্মী আমাকে ফোন করে উপহাস করতো, আমাকে তাদের বিয়ের ছবি পাঠাতো।
আমাদের এক কমন বন্ধু আছে, যাকে মানা করার পরও আমাকে দেখলেই বলতো “ঐ যে তোমার জামাইকে দেখলাম”, ততদিনে আমাদের ডিভোর্স হয়ে গেছে অনেক বছর। এই যে ক্রমাগত বিরক্ত করা, এটি কি আত্মহ্যার প্ররোচনার মাঝে পড়ে না? বিয়ে পরবর্তিতে বিয়ে ভাঙার বিষয়ে মানুষের যে প্রশ্নপর্ব, মাঝে মাঝে মনে হতো, কোথায় আছি আমি! যেহেতু আমার বিয়েটি বেশ কয়েক বছর টিকে ছিল, তাই সবার প্রথম প্রশ্ন, বাচ্চা নেওনি কেন? ভাবটা এমন, বাচ্চা নিলেই বিয়েটা ভাঙতো না। আবার আমি মোটা হওয়ায় অধিকাংশের ধারণা, আমার কোন শারীরিক অক্ষমতার কারণেই বিয়েটি ভেঙ্গে গেছে। নারীপুরুষ সকলেই কিন্তু এই প্রশ্ন করতো, অত্যন্ত লজ্জা লাগতো!
আবার বিয়ে ভাঙা মেয়েরা যেন গণিমতের মাল। আশপাশের অনেকেই তখন আমাকে বিরক্ত করেছে। কারও সামনে হয়তো আমার সাথে কথা বলে না, কিন্তু ঠিকই আমার ফোন নাম্বারটি তার মোবাইলে সেভ করা। বউয়ের অনুপস্থিতিতে রাতে ফোন দিয়ে বলেছে, সে আমাকে বিয়ে করতে চায়। আমার শরীরের বর্ণনা তার মুখ থেকে শুনে নিজের প্রতি ঘেন্না লেগেছে!
আপনারা কেউ কী বলতে পারেন যে, জলির কাছেও এমন কোনো ফোন আসেনি? একা একটি মেয়েকে রাত-বিরেতে যন্ত্রণা করেনি? বিয়ের আশ্বাস দেয়নি? হাত ধরার চেষ্টা করেনি? পরিবারের সাথে থাকার পরও আমি কতোটা একা ছিলাম, আর একাকিত্বের কী যন্ত্রণা তা কেবল আমিই জানি, বাবা-মাকেও বলতে পারিনি এসব উটকো যন্ত্রণার কথা। সেখানে জুবেরীতে একা জলির একাকিত্ব কতটা ভয়ংকর ছিল তা ভাবলেই আমার গা শিউরে উঠে!
জলির মতো আমিও আত্মহত্যা করতে পারতাম, কিন্তু আমার যে নিজের প্রতি ভালোবাসা বেশি, আমি যে জীবন নিয়ে লোভী! আমাকেও হয়তো একসময় চরম ডিপ্রেশনে যেতে হতো যদি আমার কিছু ভালো নারীবাদী বন্ধু না থাকতো, যদিও তাদের সাথে যখন আমার পরিচয়, তখন আমার একাকিত্বের অনেকটা পথই আমি পেরিয়ে এসেছি। তারপরও তারা যখন থেকে আমার হাত ধরেছে, আমি ধীরে ধীরে রিকভার করেছি, নিজেকে এখন একাকিত্বে পাই না।
বিয়ে ভাঙ্গার পর, আমার আত্মীয়রা-বন্ধুরা লজ্জা পেয়েছে মানুষকে বলতে যে, আমার ডিভোর্স হয়েছে। বিয়ে ভেঙ্গে যাওয়া অযোগ্যতা!
আমার এক বন্ধু বহু বছর তার স্বামীকে বলেনি যে আমার বিয়েটি ভেঙ্গে গেছে, কারণ আমারটা শুনে তার স্বামী যদি উৎসাহিত হয়! এদিকে প্রথম বিয়েটা ভাঙ্গতে না ভাঙ্গতেই, সবাই দ্বিতীয় বিয়ের কথা ভাবা শুরু করে দিল! সবার জন্য বিষয়টি ছিল কেবল বিয়েটি ভেঙ্গে যাওয়া, কিন্তু আমার জন্য ছিল অনেকগুলো বিষয়!! সবচেয়ে অবাক লেগেছে, আমার আশপাশের মানুষগুলোর শিক্ষার কতো অভাব যে, তারা একবারও আমার মানসিক অবস্থার কথা ভাবলো না। সবাই উপদেশ দিতে লাগলো, যে চিন্তা করো না, এখন কত এমন হচ্ছে, একটা বিয়ে ভাঙতে না ভাঙতেই আরেকটি বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। খুব ভালো কথা, তাদের একটি বিয়ে শেষ হতে না হতেই আরেক পিঁড়িতে বসছে। কিন্তু আমি তো চাইনি তখন আবার বিয়ে করতে।
প্রথম বিয়ের ট্রমা থেকে বের হয়ে আসতেই আমার কয়েক বছর লেগেছে।
ওকালতি এমন একটা পেশা, যে পেশায় প্রথমে কোন ইনকাম থাকে না, তাই প্রথম কয়েক বছর এখানে টিকে থাকাটা একটা চ্যালেঞ্জ। আমার বাবার বাড়িতে থাকতাম আর থাকা খাওয়ার কোন পয়সা লাগতো না আমাদের দুজনেরই, তাই অভাব জিনিসটা বোঝা যায়নি। ছোটবেলা থেকে পড়াশোনা, নিজের বাবার বাড়ির অধীনে চলা; তারপর পড়াশোনা শেষ না হতেই বিয়ে, বিয়ের পর স্বামীর মন ও সাথে তার মায়ের মন; নিজের পেশার মানুষজনের মন জুগিয়ে চলতে গিয়ে নিজের মনের খোঁজ নেয়া হয়নি।
জীবনযুদ্ধে টিকে থাকার রেসে এখন নিজেকে ক্লান্ত লাগে। বিশেষ করে দেশের মানুষের ফ্রি পরামর্শগুলোতে, “তাড়াতাড়ি বিয়ে করে বাচ্চা নিয়ে নাও”। পৃথিবীর সবচেয়ে সস্তা ও অকার্যকর পরামর্শ। নারী হিসেবে বিয়ে করা ও বাচ্চা জন্ম দেয়া ছাড়াও আমাদের অনেক কাজ আছে; যে বিয়ে করে বাচ্চা জন্ম দিতে চাচ্ছে সে দিক; আপনার দরকার কী আমি কী করবো, আর কী করবো না, তা নিয়ে ভাববার! প্রত্যেকটা মানুষেরই একটা সময় দরকার, যেখানে সে ভাববার সুযোগ পাবে যে, সে আসলে কি চায়! নিজের জন্য আমাদের সময় বের করার সুযোগ দিন। বিপদের দিনে পাশে দাঁড়ান বন্ধুর, যদি না পারেন তবে দয়া করে মায়া কান্না আর সো কল্ড ভালোমানুষি সাজা বন্ধ করুন।
আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।
আপনার লেখাটির জন্য ধন্যবাদ। শুধু একটি বিষয়ে আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি- ‘বিয়ে ভাঙা মেয়েরা যেন গণিমাতের মাল’। ইসলাম ধর্মে ‘বিয়ে ভাঙা মেয়ে’ এবং ‘গণিমাতের মাল’ কোন ক্ষেত্রেই অবিচার বা অন্যায্যতার কোন সুযোগ নেই।