তালাক এবং শিক্ষকের আত্মাহুতি

সাবিনা শারমিন: একজন মানুষ নিজেকে হত্যা করার আগে অন্যের জীবনের প্রতি দায়িত্বশীল হয়ে লিখে গেছেন তাঁর মৃত্যুর জন্যে কেউ দায়ী নন। সন্তানের জীবনের নিরাপত্তার প্রতিও দায়িত্বশীল হয়ে লিখে গেছেন তাঁর সাবেক স্বামীর হেফাজতে যেনো সন্তানকে না দেয়া হয়। সেখানেও তিনি মা হিসেবে সন্তানের নিরাপত্তার বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে দায়িত্ব পালন করতে ভোলেননি।

সুইসাইড নোটে তিনি সন্তানের গলায় ‘ছুরি ধরার’ অভিযোগ এনেছেন সাবেক স্বামীর বিরুদ্ধে। তা সত্ত্বেও ‘কেউ দায়ী নয় উল্লেখ করে তিনি তাঁর সাবেক স্বামীর প্রতি এক ধরনের মানবিক দায়িত্ব পালন করে গেছেন বলেই মনে হচ্ছে। যে মানবিক দায়িত্ব তাঁর অতি কাছের মানুষগুলো তাঁর প্রতি পালন করেননি। যে দায়িত্ব তিনি অবশেষে নিজের প্রতিও নিজে করতে পারেননি, কারণ অসন্মানিত হয়ে জীবনকে বাঁচিয়ে রাখা তাঁর কাছে হয়তো মর্যাদাকর মনে হয়নি। তাই অপমান, অপদস্থ এবং নির্মম প্রতারণার শিকার হয়ে চিরতরে বিদায় নিয়েছেন পৃথিবী থেকে।

jolley
আকতার জাহান জলি

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আবাসিক ভবন থেকে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আকতার জাহান জলির লাশ শুক্রবার বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে জুবেরী ভবন থেকে উদ্ধার করে পুলিশ। উদ্ধারের সময় একটি সুইসাইড নোটও রেখে গেছেন তিনি। নোটের হাতের লেখা অনেকের কাছেই মনে হয়েছে তাঁর নিজের। কিন্তু একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের আত্মাহুতি কিছুতেই যেন তাঁর পেশা ও ব্যক্তিত্বের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ বলে ভাবতে পারছি না।

একজন আত্মনির্ভরশীল উচ্চশিক্ষিত শিক্ষক এভাবে অভিমান ও ক্ষোভ দেখিয়ে নিজের জীবন কেড়ে নেবেন তা মেনে নেয়া কষ্টকর। এ রকম মৃত্যু নির্মম হত্যাকাণ্ডের মতোই যা মেনে নেয়া যায় না। আমরা সাংবাদিকদের মাধ্যমে প্রতিদিন হাজার রকমের খবরে আন্দোলিত,আবেগাপ্লুত হই, হাজারো ধরনের সত্যের সাথে তাঁরা আমাদের প্রতিনিয়তই পরিচিত করান। সেই সাংবাদিকদের একজন শ্রদ্ধেয় শিক্ষকের আত্মহত্যার বিষয়ে আজ ‘আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস’ এ লিখতে হবে তা মেনে নেয়া অত্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক।
আপাত দৃষ্টিতে আত্মহত্যার সম্পূর্ণ পরিস্থিতি গোছানো এবং পরিকল্পিত মনে হলেও কিছু বিষয় যেনো কেমন গোলমেলে লাগছে। মনে হচ্ছে তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের দুর্বলতাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে কেউ আবার তাঁকে হত্যা করেছে কিনা !

একজন বিচক্ষণ শিক্ষক প্রথমে চিরকুটে উল্লেখ করেছেন তাঁর ‘মৃত্যুর’ শব্দটির কথা, কিন্তু আবার পরবর্তীতে লিখেছেন ‘আত্মহত্যা করলাম’। এখানে চিঠিতে তিনি আত্মহত্যা করার চেষ্টা করছি অথবা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, এরকম শব্দ ব্যবহার না করে আত্মহত্যা করার আগেই ‘করলাম’ লিখেছেন। একজন মানুষের লিখে ফেলা আর তা পরিপালন করার মাঝখানে কি কোন সুত্র থাকতে পারে না? আরো দেখা যাচ্ছে, তিনি একদিকে তাঁর সাবেক স্বামীকে বাঁচাতে চেয়েছেন, আবার অন্যদিকে তাঁর সন্তানের জীবনের হুমকির জন্যে দায়ীও করে গেছেন। এ বিষয়টিও স্ববিরোধী।

উদ্ধারের সময়ে তাকে মশারীর ভেতরে এক হাত অন্য হাতের উপর দেয়া শান্ত অবস্থায় পাওয়া গেছে। সিলিং ফ্যানে শ্বাসরোধ করে নয়। আশেপাশের সব কিছু পরিপাটি এবং পাশে একটা গোছানো ব্যাগও ছিল বলেও জানান তাঁর একজন সহকর্মী। তবে মুখে ফেনা ও রক্ত বেরিয়ে আসার মতো কালো দাগ ছিল যা ‘সুইসাইড নোট’ অনুযায়ী কিছুটা ঘোলাটে বলেই মনে হচ্ছে। তাছাড়া একজন মানুষের মৃত্যুর পর তাঁর মৃতদেহ ঢাকায় না নিয়ে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দেওয়ার অনুরোধের বিষয়টি ক্লু হিসেবে অনেক প্রশ্নের উত্তর দেবে বলে মনে হচ্ছে।

আক্তার জাহানের এই অপমৃত্যু ‘আত্মহত্যা’ নাকি ‘পরিকল্পিত হত্যা’ তা ময়নাতদন্ত এবং যথাযথ তদন্তেই প্রমাণিত হবে, যদিও বর্তমান সময়ে ময়নাতদন্ত শব্দটির যথার্থতা নিয়ে মানুষের মধ্যে একটি আস্থাহীনতার সৃষ্টি হয়েছে।
কিছুদিন আগে সাবিরা নামের একজন উঠতি মডেল তাঁর বন্ধুর হঠকারিতা এবং প্রতারণামূলক আচরণে আঘাত পেয়ে প্রতিবাদ হিসেবে ভিডিও আপলোড করে আত্মহত্যা করেছিলেন। প্রশ্ন জাগে একজন স্বাবলম্বী, উন্নত এবং আধুনিক রুচির মানুষের কার প্রতি এই অভিমান? কেন নিজের মেধা, আত্মবিশ্বাসে আস্থা হারিয়ে পুরুষকে এতোটা মাথায় তুলতে হবে? কেন নিজে আত্মনির্ভরশীল হয়েও পুরুষতন্ত্রের দ্বারা ভুলভাবে অপব্যবহৃত হবেন? কেন নারী নিজে নিজে বাঁচতে শেখে না? কেন নারী বোঝে না অন্যের প্রতারণায় ডিভোর্স ছুঁড়ে দেয়ায় নারীর অপমান হয় না। অপমান হয় প্রতারকের প্রতারণায়।

Sabina Sharmin
সাবিনা শারমিন

এর গ্লানি তাঁর নিজের নয়। এই গ্লানি, এই লজ্জা, এই অপমান চরিত্রহীন পুরুষ, সমাজ আর আমাদের প্রথার। সেইসাথে এই লজ্জা লম্পট, লোলুপ, নারী প্রতারকদের, যারা একটি সাজানো গোছানো সংসারকে নিজ স্বার্থে ও কামনায় ব্যবহার করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করে না। আমরা তাঁদের নারী বলবো না। এদেরকে আমরা অন্য এক ঘৃণ্য নামে চিনহিত করে সমাজ থেকে বয়কট করতে চাই।

জানা যায় ব্যক্তিগত জীবনে তিনি সংকট্ময় অসুখী জীবনযাপন করছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের একই বিভাগের শিক্ষক তানভীর আহমদের সঙ্গে দীর্ঘদিন সংসার করার পর ২০১২ সালে তাদের বিচ্ছেদ হয়। গত বছরের শেষদিকে তানভীর আবার বিয়ে করেন। রাবির খুব কাছের এক শিক্ষক বন্ধুর কাছে জানতে পারলাম, তাঁর স্বামী সাংবাদিকতা বিভাগের সভাপতি থাকার সময়ে এক ছাত্রীকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগে সহায়তা করে, পরে তাকেই আবার বিয়ে করেছেন। যে ছাত্রী একই সাথে আকতার জাহানেরও সরাসরি ছাত্রী ছিলেন।

আকতার জাহানের এই ঘটনায় হুমায়ূন আহমেদ এবং গুলতেকিন এর কথা মনে পড়ে গেলো। হুমায়ূন-শাওনের প্রণয় কাব্য ইচ্ছে করলেও গুলতেকিন বাদ দিতে পারেননি। আকতার জাহানও একইভাবে একই কর্মস্থলে সে যাতনা প্রতিনিয়তই তাঁকে বিদ্ধ করেছে। আমরা যারা এই অপমান আর যন্ত্রণার ভুক্তভোগী নই, তাঁরা একজন শিক্ষকের আত্মহত্যাকে কোনভাবেই মেনে নিতে পারি না। কিন্তু সামাজিকভাবে কী অবস্থার মধ্য দিয়ে গেলে একজন শিক্ষক আত্মহননের পথ বেছে নেন তা হয়তো অন্যরা কখনই অনুধাবন করতে পারবেন না।

আমাদের দেশে ডিভোর্স বা তালাক অত্যন্ত নেতিবাচক, অশ্রাব্য একটি শব্দ। ধর্মিয় এবং প্রথাগত দিক থেকেও তালাক, তালাকপ্রাপ্তদের অভিশপ্ত বলে মনে করা হয়। সেই প্রাচীন আমল থেকে এই শব্দটি এখনো আগের মতোই রয়ে গেছে। আধুনিক হয়ে উঠতে পারেনি। আমাদের দেশে নারীরা নিজ মেধা আর গুণে আত্মনির্ভরশীল হলেও সমাজ সংস্কৃতি ধর্ম এবং প্রথা এখনো নারীকে মানসিকভাবে আত্মনির্ভরশীল হয়ে উঠতে দিচ্ছে না। শিক্ষিত হয়ে উচ্চপদে চাকরি করেও সমপদে অথবা নিম্ন অবস্থানের স্বামীর কাছে সে সামাজিকভাবে নীচে অবস্থান করবে এটাই সামাজিক রীতি। তালাকের প্রতি সম্মানজনক ধারণা গড়ে ওঠার সংস্কৃতি এখনো গড়ে ওঠেনি। স্বামী তালাক দিলে শিক্ষিত নারীরাও এখনো চিৎকার করে কাঁদে, আত্মহত্যা করতে পানিতে ঝাঁপ দেয়।

বাংলাদেশের নারীদের মধ্যে এই প্রবণতা আরো প্রকট। এমনকি দীর্ঘদিন উন্নত, সভ্য দেশের নাগরিক হিসাবে থেকেও বাংলাদেশী পশ্চাৎপদ রীতিনীতি থেকে নিজেদের মুক্ত করতে পারছেন না তারা। অথচ উন্নত দেশে ডিভোর্স বিয়ের মতোই খুব স্বাভাবিক একটি বিষয়। এটি তাদের কাছে কাম্য না হলেও জীবনের প্রয়োজনে এটি খুব স্বাভাবিক একটি বিষয়। স্বামী-স্ত্রীর বোঝাপড়ায় খুব বেশি আস্থা না থাকলে পারস্পরিক শ্রদ্ধা অটুট রেখে যার যার পথ নেয়াতে লজ্জা বা গ্লানির কিছু নেই।

তাই সামাজিকভাবে ‘তালাক’ শব্দটির ইতিবাচক গ্রহণযোগ্যতা এখন খুব বেশী প্রয়োজন।
অন্যের অনৈতিক কর্মকাণ্ডের কারণে হাজার হাজার ছাত্রছাত্রী, আর প্রিয় সহকর্মীদের বন্ধন থেকে মুক্ত করে নিজের জীবনকে নিঃশেষ করে দিলেন একজন শিক্ষক। এই পথকেই তিনি শ্রেয় মনে করে পাড়ি দিয়েছেন এক অজানা ভুবনে। আর আমরা ভাবি, প্রাণসংহার করে যে প্রতিবাদ, সে প্রতিবাদ কখনো আলোর মুখ দেখে না। প্ররোচনাকারী, অন্যায়কারীরা আত্মহত্যার ঘটনায় প্রশ্রয় পায়। আত্মহত্যায় অন্যায়কারীদের কোন দুঃখ বা আত্মগ্লানি হয় না, অনুশোচনা হয় না। তাঁরা বেঁচে থাকে ভরপুর অনৈতিক সুখে, কামে ও স্বার্থে। অপরদিকে নিজেকে হত্যা করে একজন শিক্ষক যে প্রতিবাদ এই পৃথিবীতে রেখে গেলেন, সে প্রতিবাদে বিশ্বাসীরা অন্ধকারে আলোর মশাল জ্বালাতে পারে না।

সাবিনা শারমিন
[email protected]

শেয়ার করুন:

সাবিনা শারমিন ছন্দার লেখাগুলি সমাজ সচেতনতার উজ্জ্বল উদাহরণ । এজাতীয় লেখা নারীর অধিকার অর্জনে সহায়ক হবে । পাশাপাশি পুরুষ চরিত্রগুলোকেও পরিশুদ্ধতার দিকে নিয়ে যাবে ।
লেখককে অনেক অভিনন্দনও শুভেচ্ছা