জিনাত হাসিবা স্বর্ণা: বাংলাদেশের শিক্ষার্থী আন্দোলন বলি কিংবা নারী আন্দোলন- কেন যেন ২০০২ সালের ২৩শে জুলাইটাই বাদ পড়ে যায়। অথচ ঘোরতর অন্যায়ের প্রতিবাদে মুখর হয়েছিলো সেদিন বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গন।
আমি তখনো কলেজ পেরোইনি। কিন্তু ২৩শে জুলাইয়ের মুহূর্তগুলো ভাসে আমার চোখে। গায়ে কাঁটা দেয় যখনই মনে পড়ে!
আমার দুইবোন তখন ‘শামসুন্নাহার হলে থাকে। টিভিতে খবরে আন্দোলনকারীদের ভীড়ে বোনদের দেখে আমরা যেমন গর্বিত, তেমনি উদ্বিগ্ন ওদের থানার আশেপাশে দেখে। মোবাইলের যুগ তখনো আমাদের স্পর্শ করেনি। বার বার নিচ তলায় খোঁজ নিই – আমাদের কোনো ফোন এসেছিল? মাঝে মাঝে ফোন করলে দৌড়ে তিন তলা থেকে নিচ তলা- “ছোটাপু ঠিক আছো তোমরা? থানায় কেন”? লাবনী আপুর জন্য শুনে একই সাথে স্বস্তি, আরেক দফা গর্ব, ও দুশ্চিন্তা!
লাবনী আপু, পদ্ম আপু, রনি আপুর কথা মনে পড়ে। লাবনী আপুর পায়ের গোড়ালি থেঁতলে দিয়েছিল পুলিশ। ছোটাপু গিয়েছিল থানা থেকে ছাড়িয়ে আনতে। পদ্ম আপুকে মেরেছিল খুব। প্রতিটি জয়েন্টে। আপুর চাচাকে ফোন করে থানা থেকে ছাড়িয়ে নিতে বলায় চাচার খুব প্রেস্টিজে লেগেছিল – যে মেয়েকে পুলিশে গ্রেপ্তার করে তেমন মেয়ের সাথে সম্পর্ক স্বীকার করে নিজের মান সম্মান নষ্ট করার কোন মানেই হয় না!
পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরই শিক্ষার্থী হয়ে আমিও ছিলাম শামসুন্নাহার হলেই। কোন বারান্দায় সেজাপু পড়ে গিয়েছিল, কোন বেড়ার কাঁটায় রনি আপুকে ছয়জন পুলিশ মিলে পিটিয়েছিল- সব আমার চোখে ভাসতো। আমি হলে থাকতেই পরে জেনেছি সেই বহিরাগত মেয়েগুলি আর হলেরই কয়েকজন, যাদেরকে পুলিশ প্রোটেকশন দিয়েছিল (যারা ছিল ভিসির চ্যালা, এর চেয়ে ভদ্র ভাষা এলো না মুখে), তারা কত ভালো অবস্থানে আছে। কেউ বোধ হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই শিক্ষকতা (!) শুরু করেছিল। আর কেউ ২৩শে জুলাই স্মরণে প্রদীপ প্রজ্জ্বলনে সামনের সারিতে, আয়োজকের ভূমিকায়!
বছর দুয়েক আগে আড়ং এ দেখা হয়েছিল রনি আপুর সাথে। ঊনার কণ্ঠ কানে বাজে আমার- “কিচ্ছু ভুলি নাই আমি। সব মনে আছে। ছাড়বো না। একদিন না একদিন শোধ তুলবো”।
আমি অবাক হয়ে তাকিয়েছিলাম -কীভাবে? কবে? কার প্রতি শোধ তুলবে? কিন্তু আমি অবিশ্বাস করিনি একটুও। ঐ দৃষ্টি, ঐ কণ্ঠের দৃঢ়তা, অবিশ্বাস করা যায় না!
বিভিষীকাময় সেই মানসিক যন্ত্রণা, শারীরিক পীড়ন, অকথ্য গালাগালের ভার আর যন্ত্রণা এখনো বয়ে বেড়াচ্ছে মেয়েগুলি। কে খোঁজ রাখে? শাস্তি হয়েছে কারো? প্রতি বছর একটা করে খবর আসে ‘শামসুন্নাহার হল ট্রাজেডি দিবস’ উদযাপনের। মাঝে দুই একটা ‘ছবি প্রদর্শনী’ও হয়েছে বোধহয়। ব্যস।
মাঝে গতবছর শুনলাম ‘অধ্যাপক’ নামের কলংক আনোয়ারুল্লাহর নামে ট্রাস্ট গঠন হচ্ছে, তার নামে স্বর্ণ পদক ঝুলবে কোন শিক্ষার্থীর গলায় – গা গুলিয়ে বমি পেয়েছিলো।
২৩শে জুলাই ২০০২। সেদিন বিশ্ববিদ্যালয় জুড়ে সাড়া পড়েছিলো। রোদ বৃষ্টি উপেক্ষা করে দিনের পর দিন শিক্ষার্থীরা রাস্তায় অবস্থান নিয়েছে মাঝরাতে ছাত্রী হলে ঢুকে ছাত্রীদের উপর পুলিশের অকথ্য অত্যাচারের প্রতিবাদে। উপাচার্য্যের পদত্যাগ আর অন্যায়ের বিচারের দাবিতে। তদন্ত হয়েছে, কতো কতো শিক্ষার্থী সাক্ষী দিয়েছে নির্দ্বিধায়। অতঃপর যা হয়, তথাকথিত ‘রাজনীতির’ হাতে আন্দোলন সমর্পণ।
সেই তদন্ত কোন অতল গহ্বরে পড়েছে কে বলবে?
২৩ জুলাই, ২০১৬