বর্বরতার চূড়ান্ত নাম কি পুরুষতান্ত্রিকতা!

ফারজানা নীলা: আপনি পুরুষ, আপনাকে বলা হলো আপনি থাকবেন ঘরের ভেতর, পারতপক্ষে বাইরে যাবেন না। গেলেও যেতে হবে আপনার অভিভাবকের সাথে। আপনাকে পরতে হবে অতিরিক্ত পোশাক, যেন আপনার শরীরের কোনও কিছু দেখা বা বুঝা না যায়। আপনার শরীর দেখে কেউ যেন উত্তেজিত না হয়।

Farzana Nila
ফারজানা নীলা

আপনি কী কাজ করবেন, কী করবেন না, কী পরবেন, কী পরবেন না, কী পড়বেন,  কী পড়বেন না, সেটি নির্ধারণ করে দিবে অন্য কেউ। আপনাকে তুলনা করা হবে অশুচি নোংরা সকল খারাপের উৎস হিসেবে। আপনাকে থাকতে হবে কারো না কারো অধীনে, বিয়ের আগে অভিভাবক লাগবে, বিয়ের পরও লাগবে, অভিভাবক ছাড়া আপনি নিরাপত্তাহীন।

আপনি রাস্তা ঘাটে চলতে ফিরতে খারাপ মন্তব্য শুনবেন, শুনে প্রতিবাদ করলে উল্টো আশেপাশের মানুষ আপনাকে খারাপ বলবে। আপনাকে ধর্ষণ করা হলে লোকে আপনাকে নষ্ট বলবে। আপনার শরীরে আপনার চেয়ে অন্যদের অধিকার থাকবে বেশি, কতটুকু দেখাবেন, কতটুকু দেখাবেন না সেটি নির্ধারণ করবে অন্যরা। কার সাথে সঙ্গম করবেন, কার সাথে করবেন না, সেটিও ঠিক করে দিবে অন্যরা। সঙ্গমেও আপনাকে নজর দিতে হবে অন্যের তৃপ্তির উপর, নিজের দিকে নয়। আপনার মূল কাজ সন্তান জন্মদান, লালন পালন, সংসার সেবা। সন্তান যদি দিতে না পারেন তবে আপনার জন্ম বৃথা, শারীরিক মানসিক অত্যাচার চলবে এই অক্ষমতার জন্য। আপনি করতে পারবেন একটি বিয়ে, অন্যরা পারবে বহু বিয়ে, রাখতে পারবে দাসী। প্রেম করলে আপনি খারাপ, পরিবারের অনিচ্ছায় বিয়ে করলে আপনি খারাপ, বিয়ে ছাড়া শারীরিক সম্পর্ক করলে খারাপ।

যদি  মিডিয়াতে কাজ করেন, মডেল হন তবে আপনার চরিত্র খারাপ। এতো এতো খারাপের জন্য আপনার শাস্তিও নির্ধারণ করা থাকবে। হয় আপনাকে প্রকাশ্যে পাথর ছুঁড়ে মারবে, নয় গোপনে হত্যা করবে।
ভাবুন তো আপনার জীবনটা কেমন হবে? হাসি পাচ্ছে শুনে? এসব কীভাবে পুরুষের জন্য প্রযোজ্য হয়? এগুলো পুরুষদের জন্য প্রযোজ্য না, কিন্তু পুরুষরাই এসব প্রযোজ্য করেছে নারীদের জন্য। যে নিয়ম পুরুষদের জন্য হাস্যকর লাগে, তাকে বৈধ করা হয়েছে নারীদের জন্য।

honor kill 2বৈধতার সীমা এই পর্যায়ে গেছে যে সে যদি এসব নিয়ম অগ্রাহ্য করে তাকে  সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড দিতেও পুরুষের বাধে না। মৃত্যুদণ্ডের নাম দাও “অনার কিলিং”। হত্যা শব্দের আগে সম্মান যোগ করে এই মৃত্যুকে বৈধতা দান করো তোমরা।

যে সমস্ত কারণে অনার কিলিং হয় সেটি কোনটাই সামাজিকভাবে অন্যায় নয়, অবৈধ নয়। আর যদি অন্যায় হয়েও থাকে সেটির জন্য রাষ্ট্রীয় আইন অনুযায়ী বিচার হবে।

কিন্তু মডেলিং করার জন্য হত্যা, কারো সাথে শারীরিক সম্পর্কের জন্য হত্যা কীভাবে বৈধ হয়!
এখন যদি কোন পুরুষকে মডেলিং করার দায়ে হত্যা করে বলা হয় সম্মান রক্ষার্থে খুন করা হয়েছে; সমগ্র পুরুষ জাতির কাছে কেমন লাগবে? সমগ্র মানব জাতির কাছে কেমন লাগবে? কারো সাথে শারীরিকভাবে জড়িয়েছেন বলে আপনাকে পাথর ছুঁড়ে হত্যা করলে কেমন লাগবে পুরুষ মহাশয়?

না এমন কেউ করবে না আপনার সাথে। কারণ আপনি পুরুষ! আপনি তো  ব্যভিচার করতে পারেন না। আপনি ইচ্ছেমতো মডেলিং করতে পারেন, শরীর দেখাতে পারেন, উত্তেজনাকর ছবি তুলতে পারেন, কিন্তু আপনার কোনো অপরাধ হবে না। কোনও ফতোয়া জারি হবে না। এবং এসব করার অধিকার একচেটিয়া আপনিই রাখতে পারেন, নারী কোনভাবেই এই অধিকারের আওতায় পড়ে না।

honor kill 2পাকিস্তানে  অনার কিলিং, মধ্যপ্রাচ্যে পাথর ছুঁড়ে হত্যা দুটোই একই স্বেচ্ছাচারিতার নামান্তর। আরবে ব্যভিচারের দায়ে প্রকাশ্যে পাথর ছুঁড়ে, দোবরা মেরে হত্যা করা হয় মেয়েদের। যদিও বলে বেড়ায় পাথর ছুঁড়ে বা দোবরা মারা ছেলেমেয়ে উভয়ের জন্য প্রযোজ্য। যেই ব্যভিচার করবে তাকে এই শাস্তি পেতে হবে। কিন্তু বাস্তবে দেখি শুধু নারীদের উপরই এই বর্বরতা চালানো হয়। তাকে জোর করে কেউ ধর্ষণ করলো, বাধ্য করলো শারীরিক সম্পর্ক করতে, দোষ হয়ে যাবে মেয়ের। নিশ্চয়ই  মেয়ের পোশাক ঠিক ছিল না, নিশ্চয়ই মেয়ে এমন কিছু করেছে যার জন্য ছেলে মাথা ঠিক রাখতে পারেনি। সুতরাং দোষ অবশ্যই মেয়ের, মারো তাকে প্রকাশ্যে পাথর, দোররা।

একজন নারীর জীবনযাপনে তোমরা হাজারও নিয়ম প্রথা আরোপ করে তাকে  বন্দী করে রাখতে চাও। সে অমান্য করলেই তাকে চেপে ধরে মেরে ফেলতেও তোমাদের এতোটুকু বাধে না। কেন? সে কী করবে, কী করবে না, কী পরবে, কী পরবে না, কার সাথে মিশবে কী মিশবে না, নিজ শরীর নিয়ে কী করবে, কী করবে না , পুরুষ কে তা নির্ধারণ করার?

তোমার বেলায় যদি একই প্রতিবন্ধকতা আরোপ করে তখন তোমার কেমন লাগবে? যেমন অসহনীয় অকল্পনীয় অবিশ্বাস্য লাগবে ব্যাপারটা, তেমনই নারীদেরও লাগে। তারা শতাব্দী ধরে মুখ বন্ধ রেখে সয়ে গেছে, মৃত্যু ভয়ে। যে জীবনের কথা তোমরা পুরুষরা একদিনের জন্য কল্পনাও করতে পারো না সে জীবন তারা যাপন করে চলেছে বছরের পর বছর।

মধ্যপ্রাচ্যের পাথর ছুঁড়ে প্রকাশ্যে হত্যাকে বর্তমানে অন্য সমাজে “অনার কিলিং” নাম দিয়ে এই হত্যাকে ভদ্র বানানোর চেষ্টা চলছে; এতে প্রমাণ হয় তোমরা পুরুষ কতটা অমানবিক-অমানুষ। শব্দটা ভারী মনে হলেও এটি বর্বরতা আর নির্মমতার নাম। আশেপাশে মানুষের অভাব নেই যারা এই অনার কিলিং এর পক্ষে ইনিয়ে বিনিয়ে সাফাই গাইবে। “মুসলিম পরিবারে জন্ম নিয়ে এসব করতে গেছে কেন” “পরিবার যখন চায় না তখন না করলেই পারতো”।
আর কত ভুলে থাকবেন যে নারী যেখানেই জন্ম নিক সেমানুষ, পরিবারের ইচ্ছে মানেই তার ইচ্ছে না। আপনার ইচ্ছে অনিচ্ছায় চলার জন্য সে বাধ্য না। পুরুষ না হয়ে মানুষের মতো ভাবতে শিখুন।

শেয়ার করুন:

পুুরুষতান্ত্রিকতা, মানব সমাজে ভয়ংকর এক রোগের নাম। যা নারীদের ধমিয়ে রাখতে বদ্ধপরিকর।

আপনার লেখা নারীদের জাগতে সহায়ক হবে।
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।