আদিউস কমরেড মিতিল আপা

সুপ্রীতি ধর: না, মিতিল আপা, তোমাকে এভাবে চলে যেতে দিতে চাইনি। তোমার যাওয়ার সময়ও হয়নি। যদিও বিশ্ব এখন যেসময় পার করছে, তাতে কে যে কখন, কীভাবে চলে যায়, কেউ বলতে পারে না। দৈবপাকে আমরা জীবিতরা বেঁচে আছি এখনও, এই বেশি। তারপরও কারও কারও চলে যাওয়া নিয়ে কিছু কথা তো থেকেই যায়, দু:খ থাকে, কষ্ট থাকে, শূন্যতার সৃষ্টি হয়। মনে হয়, আর কটা দিন হাতটা মাথার ওপরে ধরে রাখলে কীইবা এমন ক্ষতি হতো। আপা, তুমি যে তাদেরই একজন, যে কেবলই ভালবাসা নিংড়ে দেয়।

কী এমন অসুখ ছিল তোমার, জানাওনি তো কখনও। দেখা হলেই জড়িয়ে ধরে বলতে, ‘লড়াইটা চালিয়ে যাও মেয়ে’। আমি নাহয় লড়াই চালিয়ে যাবো আপা, কিন্তু তুমি? খুব কি ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলে লড়াই করতে করতে? আজকের তোমার লড়াই কি একাত্তরের চেয়েও ভয়াবহ ছিল আপা? ‘কেমন আছো’ জিজ্ঞাসা করতেই মুখটা তোমার বিবর্ণ হয়ে যেত। ঠোঁটের কোণে একচিলতে হাসি টেনে এনে বলতে, ভাল আছিরে। তো, এই তোমার ভালো থাকা?   

Mitil apaবলতে, একাত্তরে শত্রু-মিত্র চেনা সহজ ছিল, এখন দিন দিন সেই কাজটাই কঠিন হয়ে পড়ছে। তুমি ছিলে আপাদমস্তক একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা। ছিলে বলছি কেন? তুমি কি নেই? আছো তো তুমি সবার মাঝে। মুক্তিযোদ্ধাদের মৃত্যু নেই আপা। যেমন মৃত্যু হয়নি তোমার আদর্শেরও। গত ৪৫ বছরে কত মুক্তিযোদ্ধা তাদের ভোল পাল্টালো, সুবিধাবাদী হয়ে উঠলো, আদর্শচ্যুত হলো। কই, তুমি তো সেই একই রয়ে গেলে আজীবন। ছোট ছোট চুল, সাদামাটা শাড়ি, বাহুল্য নেই, ভারীক্কি ভাব নেই, আকাশের মতোন এমন উদার মানুষ কমই হয় জীবনে। আমাদের দেখা মানুষের ভিড়ে এই সংখ্যা আরও কম, বলা চলে একেবারেই নেই। তুমি এমনই একজন।

রাত আড়াইটায় যখন আমাদের বন্ধু আইরিন আপা আমাকে কিছু একটা ট্যাগ করলো, আধাখোলা চোখে বিষয়বস্তুটা দেখেই মনটা বিষন্নতায় ছেয়ে গেল। সাথে সাথেই সবাই তোমাকে স্মরণ করে লেখা শুরু করে দিয়েছে ফেসবুকে। মনের ভিতরে হাতড়েও একটা লাইনও তুলে আনতে পারিনি আপা। আমার প্রফেশনালিজমও মার খেয়ে গেল আবেগের কাছে, শূন্যতার কাছে। জোর করে চোখ চেপে রাখলাম, যেন চোখ বন্ধ থাকলেই ‘তুমি নেই’ কথাটা মিথ্যে হয়ে যাবে। কিন্তু তাই কী হয়? যে চলে যায়, তাকে কি আর ফেরানো যায় হাজারও কান্নায়?

বড় এক আপা কানিজ আকলিমা সুলতানা লিখেছেন, ২০০৮ এর ২৬ ডিসেম্বর সংসদ ভবনের সামনে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে মানববন্ধনে মুক্তিযোদ্ধা শিরিন বানু মিতিলের হাত ধরে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ছিলাম। তীব্র আবেগে কাঁপছিলেন আপা। এরপর কত কতবার কত কত অন্যায়ের প্রতিবাদে একসাথে রাস্তায় দাঁড়িয়েছি। একাত্তরের সেই আবেগটা পারদের একই উচ্চতায় আজীবন ধরে রেখেছিলেন মিতিল আপা। আজ চলে গেলেন না ফেরার দেশে।

সাংবাদিকতার সূত্রে তোমার সাথে পরিচয় আগেই হয়েছিল। পরে একটা প্রোগ্রামে জানতে পারি, তুমিও সোভিয়েত ফেরত। সেই অনুষ্ঠানেই তুমি তোমার একাত্তরের জীবনের গল্প বলেছিলে। সেই থেকে তুমি যে আপন থেকে আপনতর হয়ে গিয়েছিলে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তোমার সাদামাটা জীবন, তোমার বাহুল্যবর্জিত চলাফেরা এসবই একটা আদর্শকে সবসময় সমুন্নত রাখতো। শেষদিন পর্যন্ত তুমি তা ঊর্ধ্বে তুলে ধরে গেছো, এখানেই তোমার মাহাত্ম্য, এখানেই সাফল্য।

আজকের দিনে তুমি যখন ‘নাই’ হয়ে গেলে, মনে হলো, তোমার স্নেহের হাতটা সরে গেল মাথার ওপর থেকে। ছিলে যখন, উপলব্ধি করিনি তোমার শূন্যতা, চলে যাবার পর মনে হচ্ছে, সত্যিই ছিলে তুমি। খুব বেশিভাবেই ছিলে আমার জীবনে, লড়াইয়ে, সংগ্রামে। একটা মতাদর্শকে উপজীব্য করে কীভাবে জীবন চলা যায়, তুমি ছাড়া আর কেইবা তা শেখাতে পেরেছে বলো। তোমার মতোন একজনকে আমি কাছে পেয়েছি, ধরে দেখেছি, বুকে জড়িয়েছি, তোমার আশীর্বাদ পেয়েছি, জীবনে আর কতটুকুই বা লাগে। একজন মুক্তিযাদ্ধা তুমি, এই দেশটাকে স্বাধীন করেছো তুমি মিতিল আপা, এমন সৌভাগ্য কজনার হয় বলতে পারো?

মিতিল আপা, তাই বলছি কী, তোমাকে বিদায় জানাবো না, শুধু বলবো, আবার দেখা হবে। এইদেশের প্রতিটি ভালো কাজে, ভালো সংবাদে তুমি থাকবে। ভালো থেকো তুমি।

সংক্ষেপে শিরিন বানু মিতিলের জীবনী: (সিলেটটুডে থেকে নেয়া) মুক্তিযোদ্ধা শিরিন বানু পাবনা জেলা ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি ও বামপন্থী নেতা ছিলেন।

মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদান রাখা এই নারীর জন্ম ১৯৫১ সালের ২ সেপ্টেম্বর পাবনা জেলায়। বাবা খোন্দকার শাহজাহান মোহাম্মদ ও মা সেলিনা বানু। বাবা ছাত্রজীবনে ও ১৯৫২ সাল পর্যন্ত কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। মা পাবনা জেলার ন্যাপ সভানেত্রী এবং ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট সরকারের এমপি ছিলেন। রাজনৈতিক পরিবারে জন্ম হওয়ায় নিজেও ছিলেন রাজনীতি সচেতন।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তিনি পাবনা এডওয়ার্ড কলেজের বাংলা বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্রী ছিলেন। এছাড়াও ১৯৭০-১৯৭৩ সাল পর্যন্ত পাবনা জেলা ছাত্র ইউনিয়নের সভানেত্রী এবং কিছু সময়ের জন্য পাবনা জেলা মহিলা পরিষদের যুগ্ম সম্পাদক ছিলেন।

২৫ মার্চ, ১৯৭১ সালে দেশের অন্যান্য স্থানের মতো পাবনা জেলাতে পাক হানাদাররা আক্রমণ করে। সাধারণ মানুষের উপর নেমে আসে অবর্ণনীয় অত্যাচার। ২৭ মার্চ পাবনার মুক্তিযোদ্ধারা পাল্টা আক্রমণ চালায়। ২৭ মার্চ পাবনা পুলিশ লাইনে যে যুদ্ধ সংগঠিত হয় সেখানে সর্বস্তরের মানুষ অংশ নেয়। নারী হয়েও শত প্রতিকূলতার মধ্যে তিনি যুদ্ধে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন। এক আত্মীয়ের কাছে মাত্র ত্রিশ মিনিটে থ্রি নট থ্রি চালানো শিখে ফেলেন।

নারী হিসেবে সে সময়কার সমাজে সম্মুখযুদ্ধে যাওয়া ছিল খুবই কঠিন ব্যাপার। তাই তিনি শহীদ বীরকন্যা প্রীতিলতাকে অনুসরণ করে পুরুষের পোশাক পরে পুরুষবেশে যুদ্ধে যোগ দেন।

২৮ মার্চ টেলিফোন এক্সচেঞ্জে ৩৬ জন পাকসেনার সঙ্গে জনতার এক তুমুল যুদ্ধ হয়। সেই যুদ্ধে তিনি ছিলেন একমাত্র নারী যোদ্ধা। এই যুদ্ধে ৩৬ জন পাকসেনা নিহত এবং দুইজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। এছাড়াও ৩১ মার্চ পাবনার পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটে একটি কন্ট্রোল রুম স্থাপিত হয়। ৯ এপ্রিল নগরবাড়িতে এক প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। সে সময় কন্ট্রোল রুমের পুরো দায়িত্বে ছিলেন তিনি।

এরপর ভারতের স্টেটসম্যান পত্রিকার সাংবাদিক মানব ঘোষ তার ছবিসহ পুরুষ সেজে যুদ্ধ করার খবরটি পত্রিকায় প্রকাশ করে দিলে তার পক্ষে আর পুরুষ সেজে যুদ্ধ করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু তার যুদ্ধ থেমে থাকেনি। পরবর্তীতে পাবনা শহর পাকবাহিনী দখল করলে তিনি ২০ এপ্রিল সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে যান। সেখানে বাংলাদেশ সরকার পরিচালিত একমাত্র নারীদের প্রশিক্ষণ ক্যাম্প গোবরা ক্যাম্পে যোগ দেন। পরবর্তীতে মেজর জলিলের নেতৃত্বে পরিচালিত ৯ নং সেক্টরে যোগ দেন।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.