মেয়েকে দাসী হিসেবে গড়ে তোলা হয় পরিবারেই

তাসলিমা আক্তার: শিরোনামটি চমকে উঠার মতো। কিন্তু চমকাবার কিছু নেই, কথা সত্য। আমাদের পরিবারই মেয়েদেরকে দাসীবৃত্তির উপযোগী করে গড়ে তোলে। একাধারে সেবাদাসী এবং যৌনদাসী।  

একটি শিশুর জন্মের পর থেকেই লৈঙ্গিক পার্থক্যের কারণে প্রতিপালনের বৈষম্যটাও শুরু হয় গোড়া থেকেই। আজো অনেক পরিবারে কন্যা শিশুর জন্মকে অভিশাপ হিসেবেই গ্রহণ করা হয়। তরুণী বধুটি পোয়াতি হবার পর থেকেই পরিবারের পক্ষ থেকে শুরু হয়ে যায় পুত্রলাভের আশা। দুর্ভাগ্যক্রমে তরুণীটি যদি কন্যার জন্ম দিয়েই ফেলে, তো “কী আর করা” টাইপ একটা পরিস্থিতি হয়।

Taslima Akterমেয়ে শিশুর খেলনাগুলোও হয় আলাদা ধরনের। হাড়ি-বাসন। রান্না-বান্না এবং গিন্নিপনার তালিমটা শুরু হয়ে যায়। বারবি ডলের সৌন্দর্য নিজের মধ্যে ধারণ করে নিজেকে লাস্যময়ী করে তোলার তালিমটাও কিন্তু পরিবারই দেয়। মেয়েরা একটু বড় হবার পর থেকে অনিবার্যভাবে গৃহবন্দি করে ফেলা হয়। স্কুলে, টিউশ্যানে কিংবা গানের ক্লাসে সর্বত্রই অন্যের হাতধরে চলাফেরা করতে হয়।

মেয়ে তুমি ছাদে যেও না, ধুপধাপ করে হেঁটোনা, নি:শব্দে চলো-বেড়ালের মতো, কারণ তুমি মেয়ে। রান্নার আগুনের আঁচটা সয়ে নেয়ার  চেষ্টাটা এক্ষুণি শুরু করো। জানালার ওপাশে খেলার মাঠটা তোমার নয়। ওগুলো তোমার ভাইয়ের জন্য। তুমি বরং রোদে দেয়া আচারের বৈয়ামের দিকে খেয়াল রাখো। তোমার মাতা কিংবা মাতামহীর মত সব কষ্ট নিজের মধ্যে ধারণ করে ধুপের মত পুড়ে যাও। ঝিনুক সকল অনাচার নীরবে সয়ে যাও। এই শিক্ষাগুলোও বাবা-মাই দেয়।

পড়াশুনার ক্ষেত্রেও মেয়েদের সাথে বৈষম্য চলে। মধ্য আয়ের কোনো পরিবারে ছেলেটিকে ইংরেজী মাধ্যমে পড়ানোতে আপত্তি থাকে না পরিবারের। কিন্তু মেয়েটির বেলায় তিনবার ভাবা হয়। মেয়ের পিছনে ইনভেস্ট করাটা বোকামি মনে করেন অনেকে। কী লাভ এতো ভালো পড়ে, বিয়ের পরে তো সেই হাঁড়িই ঠেলবে। আমি এক মেয়েকে চিনতাম। আমাদের এপার্টমেন্টেরই একটা ফ্ল্যাটে থাকতো। বেশ ব্রিলিয়ান্ট। নর্থ-সাউথ ইউনিভার্সিটিতে ভালো একটা সাবজেক্টে মেজর ছিলো।  ওরা তারপর ফ্ল্যাট ছেড়ে চলে যায়। আমিও তাকে ভুলে যাই। তিন-চার বছর পর মেয়েটির মা একবার আমাদের বাড়ী বেড়াতে এলো ছোট্ট একটি শিশু কোলে। পরে জানলাম শিশুটি সেই মেয়েটির। আর সে মেয়েটি এখন পুরোদস্তুর গিন্নী। এতো ব্রিলিয়ান্ট একটি মেয়ে, এতো ভালো পড়া শেষে শুধু ঘরকন্না করছে, আমি অবাক হলাম।

মেয়েটির মা বললেন, “বিয়ের পর স্বামী যা চায় তাইতো হবে। আর তাছাড়া বাচ্চা পালার জন্যও তো শিক্ষার দরকার।” দাসবৃত্তিক মতামতে আমি মনে মনে হাসলাম শুধু।

আমাদের দেশের প্রেক্ষিতে “শাবানা”ই হচ্ছে আদর্শ নারী। নায়িকা শাবানার কথা মনে আছে তো? সেই যে, স্বামীর মার খেয়েও যে বলতো, “ওগো আমাকে আরো মারো, তবু আমি এই সংসার ছেড়ে যাবো না। এই ঘর আমার বেহেস্ত।”

আমাদের পুরুষেরা প্রেম কিংবা ক্রাশের সময় ক্যাটরিনা কাইফকে পছন্দ করলেও বিয়ের বেলায় শতভাগ চায় শাবানাকেই, যে কিনা ছায়া হয়ে পাশে থাকবে। যেহেতু মেয়েদের জীবনটাই হচ্ছে ‘বিবাহের তরে’, সেহেতু পরিবার মেয়েটিকে শাবানা করে গড়ে তুলতেই উঠেপড়ে লাগে।

মেয়েটি যদি একটু-আধটু প্রেমের কবিতা লেখে তাহলে কেউ মন্দ বলে না। কিন্তু দুর্ধর্ষ কলাম লিখতে গেলেই পরিবার থেকে আপত্তি উঠে আসে। যৌনতা, পিরিয়ড, স্তন, বীর্য ইত্যাদি শব্দ সঙ্গত কারণে লেখায় এলেই মেয়েটিকে নিয়ে ঢিঁ ঢিঁ পড়ে যায়। লেখালেখির কারণে পরিবার থেকে মানসিক নির্যাতনের শিকার হয় অনেক মেয়ে।

কাজী নজরুলের একটা কবিতা পড়েছিলাম,

“বিশ্ব যখন এগিয়ে চলে আমরা তখন বসে
বিবি তালাকের ফতোয়া খুঁজি ফেকা হাদিস চষে”

উন্নত বিশ্বের মেয়েরা এখন আর এসবের পরোয়া করে না। সেইসব মেয়েরা বিশ্ব ছাড়িয়ে মহাশূন্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কিন্তু আমার দেশ এখনো পরোয়া করে। কেন করে এর নেপথ্য কারণও আমরা জানি। মেয়েটি যেন তালাকের শিকার না হয় সেজন্য আমাদের বাবা মা মেয়েদেরকে দাসীবৃত্তিক মানসিকতায় গড়ে তুলতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন।

বাবা-মা চান, তাদের মেয়েটি স্বামীর ঘর দেখে-শুনে রাখবে আর রাতের বেলা পতিদেবের জন্য রজনীগন্ধা ফুলের মত গন্ধ বিলাবে।

শেয়ার করুন: