ছেলের মা হিসেবে আমার ভাবনা, আমার সংগ্রাম

অর্পণা ঘোষ: কয়েকটা চিন্তা আমি লালন করছি দীর্ঘ নয় বছর ধরে, এটাকে বরং বলা চলে আগামী প্রজন্মকে তৈরি করে যাবার প্রত্যয়। আমার স্বপ্নের শুরু হয়েছিল অনেকটা হঠাৎ করেই। চিকিৎসা সংক্রান্ত জটিলতা ও সীমাবদ্ধতায় আমাদের প্রথম সন্তান পৃথিবীর আলো দেখেনি। তাই পরিবারের অন্য সবার চেয়ে আমিই ছিলাম সবচে’ বেশি বিপর্যস্ত।

Arponaসে সময় উন্নয়নকর্মী হবার সূত্রে কমিউনিটির সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের মাঝে যখন আমি নিজ সন্তানের মুখটা চিন্তা করতাম, ঠিক এমনি সময় আমি অনুভব করলাম আমার ভেতরে আরেকটি প্রাণের অস্তিত্ব। কিন্তু এবারও কঠিনতর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হলো আমাকে। গর্ভাবস্থতার প্রথম পর্যায়ে হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে একাকি আমি যখন সহকর্মীদের সহযোগিতার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছিলাম, ঠিক এমনি মুহূর্তে গর্ভের সন্তানটি বেঁচে আছে, এমন সংবাদ আমাকে খুব অল্প সময়ের জন্য আনন্দ দিয়ে মহুূর্তেই মিলিয়ে যায়, যখন আমি জানলাম আমার অতি প্রত্যাশিত সন্তানটি ’ছেলে’। হয়তো আমার অবচেতন মন একটি ’মেয়ে’ শিশুর স্বপ্ন দেখছিল।

আমার হুঁশ হলো টেলিফোনের ওপার থেকে  ভেসে আসা আমার শিশুটির বাবার আশ্বাসে ও নতুন স্বপ্ন জাগানিয়া কথায়, ‘হয়তো এটাই তোমার বড় সুযোগ পৃথিবীতে আরেকটি নারী-বান্ধব পুরুষকে গড়ে তোলার’।

আমার খুুব মনে পড়ে, ছেলে সন্তানটি জন্মের পর শুভাকাঙ্খী বেশিরভাগ মেয়ের মা-ই বলতেন, আমি খুব ভাগ্যবান, কেননা আমাকে তাদের মতো মেয়ে শিশুদের যৌন নিপীড়ন বা ধর্ষণের মতো ভয়াবহ ঘটনা নিয়ে খুব বেশি চিন্তা করতে হবে না। শুভাকাঙ্খীদের এমন মতামত আমাকে আরো বেশি সাবধানী হতে সাহায্য করেছে, আরো বেশি সচেতন করেছে, যাতে আমার ছেলে বা ছেলেরা মানুষ হয়, যাতে তারা নারীদের সম্মান করতে শেখে।

এর পর দ্বিতীয় ছেলের জন্ম আমাকে আরো বেশি দায়িত্বের মধ্যে ফেলে।

কিন্তু আামার বা আমাদের এ পথচলায় প্রায়ই বাধা হয়ে ওঠে বিদ্যালয়, গণমাধ্যম, খেলার মাঠ কিংবা পরিজনসহ আরো অনেক কিছু। খুব ছোট বয়সেই কীভাবে যেন প্রিয় বিদ্যালয়টি তাদের মধ্যে ছেলে ও মেয়ে বন্ধুতে ভাগ করে দিচেছ, প্রাণবন্ত উচ্ছলতার বদলে তারা নিজেদের মধ্যে গণ্ডি টেনে আনছে। টেলিভিশনে দেখানো বেশির ভাগ বিদেশি কার্টুনগুলো নারীদের জন্য অসম্মানজনক তথ্য হাস্যরসের  মধ্যে তুলে ধরছে।

আর মসলার বিজ্ঞাপন, প্রসাধনী, কাপড় কাচার সাবান বা ডিটারজেন্ট, কিংবা যদি নাটক সিনেমার কথা ধরি তাতে রান্নার কাজ করে মা বা মেয়ে, সে কাঁদে, সে হাসতে হাসতে সংসারের সব কষ্ট সহ্য করে নেয়। তা-ই আমার ছেলেরা ধরে নেয় বাস্তব জীবনেও মা-বাবার কাজের গণ্ডি আলাদা। তারা যদি এমন ধারণা নিয়ে বেড়ে ওঠে অফিসের পরও ঘর-সংসার সামলানোর সব দায়িত্ব মায়ের, বাবার ভূমিকা এখানে গৌণ-তাহলে এমন ভ্রান্ত ধারণা তৈরির জন্য গণমাধ্যমকেও দায়ী করতে হবে।

খেলার মাঠেও আমরা তৈরি করছি মেয়ে ও ছেলে শিশুদের জন্য আলাদা জায়গা, আলাদা খেলার ধরন। আমার আশংকা এ বিভাজন বড় হয়েও ছেলে-মেয়েতে পারস্পরিক বোঝাপড়ায় দূরত্ব তৈরি করবে। যা কোনো সংসার বা সমাজের জন্য কাম্য হবে না। আর পুতুল, টেডি বিয়ার, হাঁড়ি পাতিল, পোষা পশুপাখি বা মাটি কাদা নিয়ে কটা ছেলে শিশু খেলার সুযোগ পায়? এগুলো বড্ড বেশি মেয়েলি বলে, তাদের হাতে আমরা অনেকেই খেলনা হিসেবে বন্দুক তুলে দেই। একবারও ভেবে দেখি না, এ খেলনা দিয়ে বন্ধুকে ‘হত্যা হত্যা খেলা‘ ভবিষ্যতে তাদের আবেগি বিকাশকে নষ্ট করে দিতে পারে, তাদের মধ্যে হয়তো হিংস্রতার জন্ম দিতে পারে।

আরো মজার ব্যাপার হচেছ এই বাণিজ্যিক যুগে রংয়ের বিভাজন। গোলাপীর মতো উজ্জ্বল রংগুলো সব মেয়ে শিশুদের জন্য, আর ছেলেদের জন্য রয়েছে নীল বা আকাশি। তাই টিফিন বাটি, পেন্সিল বক্স, ছাতা, কলম, ব্যাগ সবই যেন লিঙ্গ নিয়ে জন্মাচেছ! এই চতুরতা মিশ্রিত বাণিজ্যিক বিভাজনও দেয়াল তুলে দিচেছ ছেলে ও মেয়ে শিশুদের মধ্যে। তারা বুঝতে শিখছে, এগুলো ছেলেদের, ওগুলো মেয়েদের। মানে ছেলে বা মেয়ে  ভিন্ন জাতের, ভিন্ন গ্রহের প্রাণী। গল্প বা উপন্যাসই বা কম কিসে? ঠাকুরমার ঝুলির অধিকাংশই দুষ্টু পেত্নী, যারা মেয়ে। কিংবা সিনডারালার গল্পের সৎ মা, সৎ বোন তারা যেন চিরন্তনভাবেই নারীকে খারাপ চরিত্রে ফুটিয়ে তোলে।   

তাই সংবাদমাধ্যমে যখন কোনো ওঠতি বয়সী ছেলেকে ধর্ষক বা সন্ত্রাসীর ভূমিকায় দেখি তখন কেন যেন বার বার মনে হয় এ দায় তার একার নয়। কেননা কোনো শিশুই অপরাধী হয়ে জন্মায় না, সে বড় হয় পরিবারে, সমাজে, বিদ্যালয়ে, পাড়া প্রতিবেশি বা আত্মীয় স্বজনদের মাঝে। তা-ই তাকে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে  তোলার দায়িত্ব মা-বাবার একার নয়, সবার।

কিন্তু আমরা এ ব্যাপারে কতটা যত্ন দেই? আমরা তাকে বেশিরভাগ সময়ই একাকী বইয়ের গণ্ডিতে বেঁধে রাখতে ব্যস্ত, সময় ও সুযোগ কোথায় তার সঙ্গীদের সঙ্গে খেলার, নীল আকাশ দেখা, খোলা জায়গায় বেড়ানো কিংবা পশুপাখি বা মানুষজনের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তোলার! তাই সন্তানদের পড়াশোনায় ভালো করার ওপর যতটা জোর দেই আমি, তারচে’ বেশি জোর দিতে চাই তার ভেতরকার আবেগকে বিকশিত করতে, তাকে একজন সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে।    

 

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.