পায়ের নিচে মাটি নেই, ভয়ের চোরাবালি

শান্তা মারিয়া: পায়ের নিচে আমাদের মাটি নেই, কেবলি চোরাবালি। সর্বক্ষণ ধর্ষণের ভয়, সর্বক্ষণ চাকরি যাবার ভয়, সমাজের চোখে, পরিবারের চোখে হেয় হয়ে যাবার ভয়, ঘর ভাঙার ভয়। সর্বক্ষণ ভয়। কে আমার নামে বদনাম দিল, কে আমার ভিডিও বাজারে ছাড়লো!

কোনো সুন্দর নিরিবিলি এলাকা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি, সন্ধ্যা নামছে, ভয়ে বুক কাঁপে কখন কোন জায়গা থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে ধর্ষক। ভিড়ের মধ্য দিয়ে হাঁটছি। তবুও ভয়। কোন বিকৃত রুচির অমানুষের স্পর্শ কলুষিত করে শরীর। ভোরবেলায় ভয়, সন্ধ্যারাতে ভয়।

Shanta Maria
শান্তা মারিয়া

সমুদ্রসৈকত, পাহাড়ের নির্জনতা, ইতিহাসের স্থাপত্য উপভোগ করার কপাল করে কি আমি জন্মেছি? একা কোথাও যাবার তো প্রশ্নই ওঠে না। সঙ্গে স্বামী (বা প্রভু) নিয়ে গেলেও পুরোপুরি নিশ্চিন্ত হওয়া যাবে না। স্বামীকে বেঁধে রেখে আমার উপর হামলা চালানো হতে পারে।

বন্ধুদের নিয়ে যাবো? বন্ধু যদি ছেলে হয়, তাহলে তার সঙ্গে প্রেম থাকুক বা না থাকুক দুজনকে আটকে রেখে ব্ল্যাকমেইল করা হবে। নির্যাতন তো আছেই। তার উপরও বাড়তি জুটবে অর্থের খেসারত ও গ্লানি।

আর বন্ধু যদি হয় মেয়ে তাহলে দুজনেই হবো নির্যাতনের শিকার। প্রাণও চলে যেতে পারে।

অফিসে কাজ করি আমি? সেখানেও ভয়। সকালে এসে কম্পিউটার খুলি। স্ক্রিনে ভেসে ওঠে অশ্লীল  ছবি। আমারই কোনো সহকর্মীর কাজ। আমাকে বিব্রত করতে তার এ বিপুল আয়োজন। কোনো পুরুষ সহকর্মীর সঙ্গে আমার বোঝাপড়া একটু বেশি? ব্যস, আর কথা নেই। আমাকে নিয়ে রসালো গল্পে মুখর অন্যরা।

ভয় হয় এই গল্পের রেশ ধরে আমার চাকরিটাই না অকালে মৃত্যুবরণ করে।

অফিসের গাড়িতে রাতে চলাচলেও ভয়। চালক যে কখন ওয়্যারউলফ হয়ে উঠবে তার তো ঠিক নেই। যখন-তখন ওয়্যারউলফ হয়ে উঠতে পারে বস বা কোনো সহকর্মীও। প্রতিবাদ করলে চাকরি খোয়াতে হবে আর কোনো লাভ হবে না।

আমি যদি অফিসে বিভাগীয় বস হই, আর আমার অধীনে থাকে কয়েকজন পুরুষ, তাহলেও ভয় কম নয়। আমাকে তারা প্রথমদিকে মানতেই চাইবে না। প্রতি পদে প্রমাণ করার চেষ্টা করবে তারা সবদিক থেকেই আমার চেয়ে বেশি যোগ্য। নেহায়েত আমি মেয়ে বলে সুযোগটা পেয়েছি। সম্ভবত বিগ বসের সঙ্গে আমার রয়েছে অন্য কোনো ধরনের লেনদেন।

আর যদি আমি নিজের যোগ্যতা কোনোভাবে প্রমাণ করেই ফেলি তাহলেও তারা তখন চেষ্টা করবে আমাকে হয়রানি করার। রাস্তাঘাটে, ফেইসবুকে, অফিসের ক্যান্টিনে চুলচেরা বিশ্লেষণ হবে আমার পোশাক, লিপস্টিক এমনকি পারফিউমেরও।

তাদের কাউকে আমি প্রেমের প্রস্তাব দিয়েছি, দিয়ে ব্যর্থ হয়েছি এমন গুঞ্জনে মুখর হবে বিভাগ। আর যদি আমার বয়স তাদের চোখে প্রেমের সীমানা পার হওয়া বলে মনে হয়, তাহলে আমি যৌন জীবনে সুখী না অসুখী ছিলাম সে গবেষণা চলবে। আমার অবিবাহিত কিংবা বিবাহিত জীবন, আমার ডিভোর্সড জীবন, আমার বৈধব্য, আমার প্রেম-অপ্রেম, বন্ধুত্ব, আত্মীয়দের সাথে ঝগড়া-ভাব সবকিছু নিয়ে চলবে রসালো গালগল্প।

তাতেও রেহাই নেই। আমার সন্তানেরও চরিত্র বিশ্লেষণ করা হবে। এইসব চলতে থাকবে আর আমি ভয়ে কাঁপতে থাকবো কখন আমার প্রিয় সন্তানের বদনাম ছড়ায়, কখন বা আমার বদনাম ছড়ায়।

আমি কঠোরভাষী হলে বলা হবে আমি পাগল, আমি মৃদুভাষী হলে বলা হবে ‘মহিলা অযোগ্য, হাসি দিয়ে সব কাভার করতে চায়।’

আমি যদি হাউজওয়াইফ হই, তাহলে তো ভয়ের কোনো সীমা-পরিসীমা নাই। কখন কে আমার স্বামীকে দখল করে। স্বামীর অফিসের কোনো নারীর সম্পর্কে একটু প্রশংসা শুনলেই ভয়ে বুক কাঁপে। স্বামীর স্মার্ট কলিগ, ফেইসবুক ফ্রেন্ড, গর্জিয়াস খালাতো বোন, মেয়ের তরুণী টিউটর, এমনকি নিজের ঘরের কাজের মেয়েটাকে দেখলেও আমি ভয় পাই। ভয় পাই আমার ছোট্ট ঘরটা বেদখল হয়ে যাবে। আমি বুঝতে পারি না, যে ঘর যেকোনো সময় বেদখল হয়ে যেতে পারে, সেটা আদতে আমার ঘরই নয়।

আমি যখন স্কুলে যাই, কলেজে যাই তখন রাস্তাঘাটে যেকোনো বয়সের ছেলেকে দেখলে ভয় পাই। আমি ভয় পাই আমার শিক্ষকদের আর নিজে শিক্ষক হলে ভয় পাই ছাত্রদের।

আমি যখন প্রেম করি তখনও ভয় যায় না। প্রেমিক কখন ড্রাকুলা হয়ে ওঠে, কখন ভিডিও বাজারে ছাড়ে, কখন বন্ধুবান্ধব নিয়ে ধর্ষণ করে, কখন বা ছেড়ে যায়, অস্বীকার করে এই ভয়ে আমি শান্তি পাই না, স্বস্তি পাই না। বৈশাখি মেলায় যাবো? সেখানেও ভয়। হঠাৎ কখন একদল হায়েনা আমাকে ঘিরে ধরে শত লোকের চোখের সামনেই নির্যাতন করে।

Asian Motherখুন হয়ে যাবার পরও ভয় থেকে নিস্তার নেই আমার। মৃত আমাকে নিয়েও টানাহেঁচড়া চলবে। প্রমাণ করার চেষ্টা করা হবে নিজের স্বভাবদোষেই খুন হয়েছি আমি। ‘মরবে মেয়ে উড়বে ছাই, তবে মেয়ের গুণ গাই’। না তখনও গুণ গাওয়া হবে না। আমি যদি বিখ্যাত কেউ হয়ে মরি তাহলে হয়তো মৃত্যুর বহু বছর পরও আমার চরিত্রহনন করা হবে। বলা হবে লেখাগুলো এই নারীর ছিল না। কোনো পুরুষ এটা লিখে দিয়েছিল। আমি সুন্দরী অভিনেত্রী হয়ে থাকলে মৃত্যুর পর একটা কুৎসিত ছবি দেখিয়ে বলা হবে, এই ছিল এই সুন্দরীর প্রকৃত চেহারা।

আমার ভয়ের শুমারি করা সম্ভব না। এই ভয়ের কোনো শেষ নাই। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় ভয় ধর্ষণের। প্রথমে নিজের জন্য ভয়, তারপর মেয়ের জন্য ভয়, তারও পর নাতনির জন্য ভয়।

ভয়ের এই জিন্দেগি থেকে কি আমার মুক্তি নেই?

মুক্তি আছে রে মেয়ে। মুক্তিটা তোরই হাতে, তোদেরই হাতে। ঝেড়ে ফেল সব ভয়। বাইরে আছে হিংস্র- পিশাচ, তাই বলে কি আমরা গর্তে ঢুকে থাকবো? শুধু বৈশাখি মেলা কেন? পূজা মণ্ডপ, ঈদের মেলা, ভিড় হোক কিংবা নিরালা, সব জায়গায় যাবো আমি। যাবো আমরা সবাই।

মেলায় যদি মেয়ের সংখ্যাই হয় বেশি তাহলে হায়েনাদের পিষে মারতে পারবো আমরাই। নববর্ষ উদযাপনে রাজপথে নেমে আসুক সব নারী। বেড়াতে যাবো একা কিংবা দলবেঁধে, দলে দলে, সবাই। বখাটের চোখের দিকে তাকাবো সোজা সব বান্ধবী মিলে। পার্কে যাবো, সিনেমায়, দেশের ভিতরে, বিদেশে। প্রথম প্রথম ভয় লাগবে, একটু একটু বুক কাঁপবে, তারপর সব ঠিক হয়ে যাবে।

আমরা সবাই যদি একসাথে পথে নামি কে কি করতে পারবে তাহলে? সব ভয়কে জয় করেই এগোতে হবে। ভয়ের কালো গুহা থেকে বেরিয়ে সূর্যের আলোয় বিকশিত করবো নিজেকে।

শেয়ার করুন: