অযথা অনুভূতির জঞ্জাল দূর হোক

জিনাত হাসিবা স্বর্ণা: আমাকে দেখে কারো যৌনানুভূতি জাগছে? সমস্যা তো তার! আমি কেন এতো চিন্তিত আর ব্যতিব্যস্ত এ নিয়ে? কারো দৃষ্টিতে আমি স্পষ্ট যৌন আনন্দ দেখতে পেলাম? কেউ অযথাই ছুঁয়ে দিয়ে চলে গেলো অবলীলায়? কিংবা হালকা স্বরে কিছু অসহ্য শব্দ রেখে গেলো কানে?

Zinat
জিনাত হাসিবা স্বর্ণা

কেন আমি মরমে মরে যাবো? কেন আমার পা থেকে মাথা পর্যন্ত বিভিন্ন রকমের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া হতে থাকবে- রাগ, অপমান, ঘৃণা, ক্ষোভ, লজ্জা, আর একই সাথে অসহায়ত্ব এবং প্রচণ্ড রকমের ক্রোধের মিশেল এই অনুভূতির বোঝা!

গ্লানি? কীসের গ্লানি?? সয়ে যাওয়ার? না পারার? নাকি আরো অন্য কিছু? যে প্রতিক্রিয়া পরিস্থিতির কোনো উন্নতি না ঘটিয়ে আমাকে কষ্ট দিচ্ছে নিরন্তর, সে প্রতিক্রিয়ায় কী এসে যায়! পারলে এমন কিছু করি যাতে একটা কিছু পরিবর্তন আসে। তা না পারলে অন্তত নিজের ক্ষতিটুকু না করি।

আমার এক সহকর্মী একদিন এরকম কোনো একটা সময়ে ছিলেন আশেপাশে। দেখেছেন এক মুহূর্তের ছোট্ট একটা আচরণ আমার উপর কতখানি ছাপ রেখে গিয়েছিলো অনেক্ষণ সময়ের জন্য। খুব বিনয়ের সাথে সেই সহকর্মী  জানতে চেয়েছিলো – “আসলে অনুভূতিটা ঠিক কেমন”? কাছের মানুষ, জানি নেহায়েত মজা করার জন্য বলেননি। কিন্তু বোঝাতে চাইলে নিজেরো বুঝা চাই। ভেবে দেখলাম। খেয়াল করলাম কত ধরনের অনুভূতি পথে ঘাটে এই যৌন হয়রানি হলে হতে থাকে মুহূর্তের মধ্যে। বেশীরভাগ অনুভূতি অপ্রয়োজনীয়। অর্থহীন। লজ্জায় কুকড়ে যাওয়া তাতে প্রথম।

কিসের লজ্জা? অন্যায় করে গেলো আরেকজন, লজ্জায় মরমে মরে যাচ্ছি আমি! বিশ্রী চাহনীতে তাকিয়ে আছে সে, গায়ে হাত দিয়ে নোংরা মনের পরিচয় দিলো সে, অদ্ভুত এক বিকৃত যৌন আনন্দ নিয়ে নিজেকে নির্লজ্জ প্রমাণ করলো সে- আর লজ্জা পেলাম আমি! লজ্জা পেলাম কারণ আমি বিশ্বাস করি আমার এই শরীরটা আমার বিরাট সম্পদ যাতে কেউ হাত ছোঁয়ালে তা আমার জন্য লজ্জাস্কর। লজ্জা পেলাম কারণ আমি শিখেছি যেকোনো যৌন বিষয় লজ্জার। এইজন্যে লজ্জা পেলাম যে আমি আমার মহামূল্যবান সম্পদ রক্ষা করতে সফল হইনি।

দ্বিতীয়ত, অপমান। আমাকে ‘যেমন তেমন মেয়ে ভেবেছে’!

‘কেমন কেমন’ মেয়ে?

‘খারাপ মেয়ে’।

কারা ‘খারাপ মেয়ে’?

যাকে চাইলেই ছোঁয়া যায়।

NY 1তো, চাইলেই ছোঁয়া যায় এমন মানুষ আছে এ ধারণা আসে কোথা থেকে আমাদের? চাইলেই ছোঁয়া যায় না তো কাউকেই! আমি যে-ই হই। যা-ই করি। অনুমতি নেওয়া লাগে। বিনা অনুমতিতে কারো গায়ে যৌন আনন্দ লাভের জন্য স্পর্শ করা যায় না। না, একজন যৌনকর্মীরও না। আর আমি আমার শরীর ‘যত্নে তুলে রেখেছি’ বলে আমি খুব ‘ভালো’ মানুষ, আর সে তা করেনি বলে সে একটা ‘খারাপ’ মানুষ ভাবার অধিকারটাই বা কে দিলো আমাকে? চূলায় যাক এমন অপমানবোধ!

আরেক ধরনের অপমানবোধ হয়। ‘আমি মেয়ে বলে ও ধরে নিলো আমার শরীরটা হাতের নাগালে পেলেই ও ধরতে পারে’। তো এতে অপমানিত হয়ে বসে থেকে তো কাজ নেই। অপমান থেকে রাগ হচ্ছে তো? সেই রাগটাও তো নিরর্থক যদি উপযুক্ত ব্যবস্থাটা নিতে না পারি। স্পষ্ট করে বোঝাতে হবে তো যে এটা করতে পারে না কেউ আমার সাথে!

তবে হ্যা, বোঝানোর ভাষা কী হবে সেটা পরিস্থিতি অনুযায়ী ঠিক করা চাই- কারো জন্য স্পষ্ট দৃষ্টিই যথেষ্ট, কারো জন্য দরকার অল্প কয়েকটা স্পষ্ট কথা, কারো ক্ষেত্রে চড়-থাপ্পরের বিকল্প নাই, আর কাউকে আইনের হাতেই তুলে দেওয়া চাই।

সবচেয়ে অপ্রয়োজনীয় অনুভূতিটা হলো ঘেন্না। যে করলো তার প্রতি, এবং তার চেয়েও আশ্চর্যজনক, নিজের প্রতি! ওকে ঘেন্না করে কাজ নেই। কারণ ও যা করছে তার সাথে ওর বড় হয়ে ওঠা এবং আমাদের পুরো সমাজ, যা আমি-আপনি-আমরা দিয়েই তৈরী, সবাই জড়িত। আমরা সবাই মিলে তৈরী করেছি, তৈরী হতে দিয়েছি ওকে এই মানসিকতা নিয়ে। এখন ওকে হয় শিক্ষা দিতে হবে, নতুবা শাস্তি। ঘেন্না বোঝার সাধ্য ওর নেই। ঘেন্না এখানে নিষ্ফল।

এখন আসি নিজের প্রতি ঘেন্নায়। নিজের প্রতি? কেন? ঐ যে প্রথমে লিখেছিলাম, মহামূল্যবান সম্পদ এই শরীর! কেন মহামূল্যবান? কারণ এর সাথে ‘আমার পবিত্রতা’ সম্পর্কিত! অনাকাঙ্ক্ষিত কেউ শরীর ছুঁয়ে দিলে আমার শরীর ‘অপবিত্র’ হয়ে যায় এমন একটা শিক্ষা আমরা আমাদের আশপাশের পরিবেশ এবং গল্প-কবিতা-নাটক থেকে ‘অর্জন’ করেছি। তাই ছুঁলে তো ‘অপবিত্র’ হবোই! আর যদি শারীরিক কিংবা যৌন সম্পর্ক হয়ে যায় (বিবাহপূর্ব কিংবা জোরপূর্বক, এও আরেক অদ্ভুত; একটা কাগজ থাকলে ‘সবই’ শুদ্ধ!), তাহলে তো এই জীবনই রাখা অর্থহীন! এতো ‘অপবিত্র’ শরীর নিয়ে বেঁচে থাকার কী মানে!

Enoughসিরিয়াসলি? এমন ননসেন্স একটা চিন্তা আমরা এতো গুরুত্বের সাথে লালন করছি? কখনো ভেবে দেখেছি, কত অর্থহীন সব রীতিনীতির কাছে সমর্পণ করে রেখেছি নিজের সত্ত্বাকে? শরীরটাই কি আমি?? এর চেয়ে বরং ভাবতে শিখি- এই শরীরটা আমার! তবু কিছু কাজে দিবে। আমার ইচ্ছে-অনিচ্ছে-পছন্দ-অপছন্দের তোয়াক্কা না করে আমার এই শরীরটাকে কতভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে আমি বাদে সবাই, সেই বোধটা অন্তত হবে!

পরিবর্তন আনতে হলে সবার আগে নিজের ভেতরের এই অযথা অনুভূতিগুলিকে ঝেড়ে ফেলা চাই। যাকে রুখবো তার সাধ্য নেই আমার ততখানি ক্ষতি করে যতখানি ক্ষতি আমি নিজে করছি। তাছাড়া আমার ‘অতি সতর্কতা’ যদি আঙুল তোলে নিরীহ কারো দিকে, নিঃসন্দেহে তা শক্তি যোগাবে তাঁদের, যারা সর্বক্ষণ ওঁত পেতে আছে এটা প্রমাণ করতে যে ‘মেয়েরা হয় বুঝে না কিংবা বেশী বুঝে’। নিজের ভেতরের বাধাটা ভাঙা সবচেয়ে কঠিন, কিন্তু খুব জরুরি। রুখে দাঁড়ানোতে ঝঞ্ঝাট আছে, কিন্তু এভাবে আর কতদিন? একটু একটু করে হোক, কিংবা হঠাৎ বিস্ফোরণে, তবু তো তুলি মাথাটা!

শেয়ার করুন:

অসাধারণ একটি লেখা। এই অযাথা অনুভূতির জঞ্জালগুলোকে ডাস্টবিনে ফেলে দিতে হলে এই লেখাটির চিন্তাকে ছড়িয়ে দিতে হবে সবার মাঝে। সাংস্কৃতিক কিছু অনুশীলন/ গদবাধা রীতি/নীতি কিভাবে এই অযাথা অনুভূতির জঞ্জালগুলোকে পুষে রেখেছে লেখাটির মধ্যে চমৎকার ভাবে তা ফুটে উঠেছে।
জিনাত আপনি লেখালেখি চালিয়ে যাবেন। অপেক্ষায় থাকলাম আপনার নতুন কোন লেখা পড়ার জন্য। ধন্যবাদ আপনাকে।