লীনা হাসিনা হক: আমার বন্ধু বলে, এতো ভাঙ্গাভাঙ্গির দরকার কী? যত্তসব সব্বোনেশে কথাবার্তা! তাই তো, কোন খাঁচা ভাঙতে চাই? কেনই বা চাই? আর ভেঙ্গে ফেলা যদিও বা গেলো, তারপরে কি মুক্ত আকাশের হাতছানি? নাকি কবি’র বর্ণনার সেই খাঁচার পাখিটির মতন শেষে গিয়ে হাহাকার, ‘উড়িবার শকতি নাহি মোর!’
আমার এক বন্ধু একলা হয়েছে। সত্যি বলতে কি বন্ধু এবং তার প্রাক্তন স্বামী দুজনেই আমার সহপাঠী। দুজনেই অত্যন্ত চমৎকার মানুষ। সংস্কৃতিপ্রেমী, মুক্তচিন্তা করে, সৌজন্যবোধ অসাধারণ, বন্ধুবৎসল এই দম্পতির বাড়িতে কত যে ছুটির দুপুর-বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়েছে, আড্ডা গড়িয়েছে গভীর রাত অবধি, অত রাতে আর ফিরবো কীভাবে তাই থেকে যাওয়া, সকালের নাশতা সেরে নিজের বাড়ি ফেরা বা সেখান থেকেই অফিস ধরা। অত্যন্ত সংবেদনশীল মানুষ তারা দুজন। একটি ছেলে তাদের।
প্রায় দুই যুগের কাছাকাছি একসাথে বসবাসের পরে কিছুদিন আগে তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছে আলাদা থাকার। মতের মিল আর হচ্ছিলো না। দুইজন তরুণ-তরুণী জীবনের অনেকটা সময় একসাথে কাটিয়ে পরিণত বয়সে এসে যদি উপলব্ধি করে তাদের ভিন্নতা এবং সেই ভিন্নতায় তারা যদি আর থাকতে না চায়, তাহলে আলাদা হবার সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার তাদের আছে।
দুইজন মানুষের আলাদা থাকার সিদ্ধান্তে কারো কোনো অসুবিধা হওয়ার কথা নয়, উচিত নয় এবং এই বিষয়ে না চাইলে কোন মতামত দেওয়ারও অধিকার অন্য কারো নাই বলেই আমি মনে করি।
ব্যাপার সেইখানে নয়, ব্যাপার হলো, আলাদা হয়ে যাওয়ার পরে দুই জনেই শান্তিতে বসবাস করার কথা, কিন্তু বাস্তবে তা হচ্ছে না। দুজনেই সমান তালে দুজনের বিরুদ্ধে নানাবিধ বিরুপ মন্তব্য করে যাচ্ছে। যতোই বুঝবার এবং বুঝাবার চেষ্টা করি যে, মিল হচ্ছিলো না বলেই তো আলাদা হলে, মিল হলে হয়তো একসাথেই থাকতে। তাহলে আলাদা হয়ে যাওয়ার পরেও কেন এই টানাপোড়েন? কেন ছেড়ে দিতে পারছো না?
এই যে ছেড়ে দেবার সংস্কৃতি, এটা আসলে আমাদের পরিবারে, সমাজে নাই। আমরা ছাড়তে পারি না। খুব হাস্যকর একটা উদাহরণ মনে এলো, প্রতি মাসের শেষে দেখা যায় বাসা বদলের প্রক্রিয়ায় ভ্যান গাড়িতে করে জিনিসপত্র স্থানান্তরের দৃশ্য। খাট টেবিল, চেয়ার, আয়না, ফ্রিজ, টিভির সাথে সাথে ব্যবহৃত বা অব্যবহৃত কৌটা শিশি-বোতল, এমনকি খানিকটা পুরনো ঝাড়ু ইত্যাদিও বয়ে নিয়ে যাওয়া হয় নতুন বাসায়। আমরা কোনো কিছু ছেড়ে আসতে পারি না।
আমরা সম্পর্ক ছিন্ন করি কাগজে, কিন্তু সম্পর্কের টানাপোড়েন সাথে বয়ে নিয়ে চলি সারাজীবন। কটু কথা বলার বিন্দুমাত্র সুযোগ ছাড়ি না ছিন্ন সম্পর্কের বিষয়ে।
আমার বন্ধুটি আমার কাছে আফসোস করে বলছিল, তার প্রাক্তন স্বামীর নানাবিধ নেতিবাচক দিকের কথা। বন্ধুর ছেলেটিও এসেছিল মায়ের সাথে, টিভি দেখছিল সে, কিন্তু আসলে সে মায়ের কথা কান পেতে শুনছিল।
এক পর্যায়ে টিনএজ ছেলেটি উঠে এসে মায়ের সামনে দাঁড়িয়ে বললো, ‘এসব আমার আর ভালো লাগে না। তোমরা একসাথে থাকছো না, কিন্তু কেউ কাউকে ছাড়ছোও না। যে চ্যাপ্টার বন্ধ করেছো, সেই পাতা বারে বারে খুলে দেখার দরকার কি? বাবার সাথে থাকি যখন, তখনও এইসব শুনতে হয়। কেন তোমরা তোমাদের নেয়া সিদ্ধান্তকে সম্মান করতে পারছো না? একসাথেই তো ছিলে বহু বছর, সেটা তোমাদের ইনফরমড চয়েস ছিলো, নিজেদের সেই ইচ্ছেকে কেন সম্মান করতে পারো না? আমার ইচ্ছে করে কোথাও চলে যেতে!”
সদ্য কৈশোর পেরুনো এই ছেলেটির চোখে রাগ, দুঃখ, ক্ষোভ, হতাশা, বেদনা চিক চিক করছিলো। তার গভীর জীবনবোধ আমাকে চমকে দিলো।
জীবনের প্রায় কিছুই না দেখা এই ছেলেটি আসলে যেন আমাদের সামাজিক শিক্ষাকেই একটি চপেটাঘাত করলো।
তাইতো কেন আমরা পরস্পরকে সম্মান করতে পারি না? নারী-পুরুষের সম্পর্ক নানা কারণে ভেঙ্গে যেতে পারে, তাই বলে সেই সম্পর্কে কাটানো সুন্দর সময়টুকুরও কি কোন মূল্য নেই? সবকিছুই কি অবনিবনার তিক্ততায় ঢেকে যায়? না কি আমরা আমাদের চোখ ফিরিয়ে রাখি, মনকে চোখ রাঙাই এই বলে যে, ভেঙ্গে যাওয়া সম্পর্কে ভালো, সুন্দর, সম্মান কিছুই থাকতে নেই!
ভেঙ্গে যাওয়া সম্পর্কে সব থেকে ভুক্তভোগী সন্তানরা। মা যখন বাবার সম্পর্কে কটু কথা বলে তাদের হৃদয় বাবার জন্য কাঁদে, বাবা যখন মায়ের সম্পর্কে নোংরা কথা বলেন মায়ের জন্য তাদের হৃদয়ে রক্তপাত হয়। কেন তাদেরকে কোনো পক্ষ নিতে হবে! মা-বাবার সম্পর্ক তৈরি বা ভাঙ্গায় তাদের তো কোনো ভূমিকা থাকে না, অথচ কষ্টটা সন্তানদেরকেই ভুগতে হয়। অনেকটা রাজায় রাজায় যুদ্ধ উলু খাগড়ার প্রাণ যায় আর কী!
ভেঙ্গে যাওয়া সম্পর্কে নারী-পুরুষ দুই জনই দুজনের জন্য প্রাক্তন হয়ে যান, কিন্তু সন্তানদের জন্য তো মা-বাবা প্রাক্তন হন না।
আমরা এই সামান্য বিষয়টা কেন যে বুঝতে চাই না। পরস্পরের প্রতি এই কটুকাটব্যে আমাদের সন্তানরা যে সম্পর্ককে মূল্য দিতে শিখে না, সম্মান করতে শিখে না বা এইসব অসম্মানমূলক কথা তাদের মধ্যে যে এক ধরনের হীনমন্যতাবোধ তৈরি করে, তা কি মা-বাবারা বুঝার চেষ্টা করি কখনো? মনে হয় না।
এই ধরনের কথাবার্তা আমাদের সন্তানদের ভবিষ্যৎ জীবনে এক ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
যতই প্রিয় বন্ধুকে বোঝাবার চেষ্টা করি, এসব আর মনে রেখো না। ছাড়ো, ছেড়ে দিয়ে শ্বাস ফেলে বাঁচো, অন্যজনকেও বাঁচতে দাও। আমার বন্ধুটি আরো রেগে দ্রুত শ্বাস ফেলতে ফেলতে বলে, ‘কিসের ছাড়? মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ছাড়বো না! আমায় দেয়া প্রতিটি কষ্টের জন্য ওকে ভুগতে হবে! সবাইকে জানাবো এসব কথা!’
টেলিফোনে বন্ধুর প্রাক্তন স্বামী, আমার সব সময়ের বন্ধু, আমার শান্তি প্রস্তাবে বলে, ‘কীসের ছাড়ের কথা বলো তুমি? যে পরিমাণ অশান্তি আমার জীবনে সে করেছে, তা থেকে এতো দ্রুত মুক্তি? কখনোই না!”
অপর প্রান্তে তার দাঁতে দাঁত ঘষার শব্দ পাই!
এর মধ্যে ঢোলে বাড়ি দেন দুই পক্ষের পরিবার। পুরুষটির বোনের সাথে নারীটির ভাইয়ের দেখা হয়তো কোথাও, আহ, সারা দুনিয়ার মানুষের জানতে বাকি থাকে না কিভাবে কে কার জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছিলো। কে কার থেকে কতটা দেবতুল্য। কেহ কারে নাহি জিনে সমানে সমান।
কে কাকে বুঝাবে জগতের সকল প্রাণীর সুখী হবার অধিকার আছে, কিন্তু তা অন্যের অসুখের বিনিময়ে নয়। অন্যকে অসম্মান করে নয়। ছেড়ে আসা সম্পর্কে কিছু ছেড়েই যদি আসতে হয় তিক্ততাটুকুই ছেড়ে আসা উচিত, সুন্দর সময়টুকুর মূল্য দেয়া খুব জরুরি। সুন্দর সময়টা তো মিথ্যে নয়। সেই সময়টাকে স্বীকার করবার সততাটুকু বড্ড দরকার।
বন্ধু দুজনই আমাকে সমানভাবে দোষারোপ করে, ‘সত্যি করে বলোতো তুমি কেন ওর পক্ষ নিচ্ছো? ও, নিজে নারী বলে নারীকে সমর্থন করছো, এমনকি অন্যায় ব্যাপারেও?”
প্রিয় বন্ধু সরাসরি জিজ্ঞ্যেস করে, ‘ঘুষ খেয়েছিস? ও, আচ্ছা, পুরুষতান্ত্রিক সমাজে পুরুষের পক্ষই নিবি, এ আর নতুন কী!”
কিভাবে বুঝাই, কারো পক্ষ নিচ্ছি না, বরং যাবতীয় অসম্মানজনক কথাবার্তা যা সন্তানের জন্য অহেতুক বেদনা বয়ে আনে, তার বিপক্ষে আমি। বন্ধুদের ছেলেটি আমাকে বলে, আমি বুঝি না আমার মা-বাবাকে, আমি বুঝি না তারা কী চায়, আমার শুধু এই সব পাল্টা-পালটি থেকে সরে যেতে ইচ্ছে করে কোথাও।“
আমি কেবলই ভাবি, এ খাঁচা ভাঙবো আমি কেমন করে!