বঞ্চনাময় পথ চলাই একমাত্র সত্য নয়

উপমা মাহবুব: কিছুদিন আগে একটা ব্লগ পড়ছিলামপ্রবাসে উচ্চতর ডিগ্রী নেওয়া একজন বিদুষী নারী তার জীবন সংগ্রামের কথা লিখেছেন

তিনি কৃষক পরিবারের মেয়েঢাকার একটি অত্যন্ত স্বনামধন্য বিদ্যালয়ে পড়ার জন্য এক আত্মীয়ের (সম্ভবত খালা) বাসায় থাকতেনসেই বাড়ির ছেলে (সম্পর্কে ভাই) তাকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করেতিনি ঘটনাটি গোপন করে স্বাভাবিক জীবন-যাপন করার চেষ্টা করেন

Upomaশারীরিক ও মানসিক ট্রমা থেকে একদিন ক্লাস চলাকালিন অবস্থায় জ্ঞান হারালে স্কুল কর্তৃপক্ষ তাকে ডাক্তার দেখায় এবং বিষয়টি বুঝতে পারেনএরপর স্কুল কর্তৃপক্ষই নিজ উদ্যোগে তাকে চিকিৎসা, কাউন্সেলিং-এর ব্যবস্থা করা, এমনকি দোষী ব্যক্তিকে আইনের আওতায় এনে শাস্তিরও ব্যবস্থা করেনঘটনাটি পড়ে আমি খুবই অবাক হইবাংলাদেশে এরকম স্কুলও আছে! আমরা তো সবসময় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রীরা লাঞ্ছিত হলে কর্তৃপক্ষ তা গোপন করতে কতটা ব্যস্ত থাকে সে ঘটনা শুনতেই অভ্যস্তএ ধরনের পরিস্থিতিতে কোনো ছাত্রী সহায়তা পাচ্ছে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তার পাশে এসে দাঁড়াচ্ছে এ ধরনের খবরের সাথে আমরা মোটেও পরিচিত নই

ফেসবুকে পড়া আরেকটি ঘটনা উল্লেখ করতে চাইদরিদ্র পরিবারের অল্পশিক্ষিত এক মেয়ে একটি কোম্পানির বড় কর্মকর্তার ব্যক্তিগত সহকারি হিসেবে চাকরি পায়কিছুদিনের মধ্যেই সে বুঝতে পারে যে ঐ কর্মকর্তা বিভিন্ন রকম ইঙ্গিত দিচ্ছেনটানাটানির সংসারের কথা ভেবে মেয়েটি মুখ বুঁজে সহ্য করে

একদিন ঐ কর্মকর্তা মেয়েটিকে সানি লিওনের সিনেমা দেখার প্রস্তাব করেন এবং তার হাত ধরে টানাটানি করেনমেয়েটি কোনমতে পালিয়ে বাঁচেপরের দিন মেয়েটি অফিসে গিয়ে দেখে যে ঐ ভদ্রলোকের স্ত্রী অফিসে এসেছেনসে সাহস করে ঐ ভদ্রমহিলাকে সরাসরি জিজ্ঞেস করে যে, স্যার তার সাথে সানি লিওনের সিনেমা দেখতে চায়, সে রাজি হবে কিনাঐ চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে মেয়েটি এখন গার্মেন্টেস-এ অনেক কম বেতনে চাকরি করছেকিন্তু সে মানসিকভাবে শান্তিতে আছে

প্রতিদিন অসংখ্য মেয়ে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন ও লাঞ্ছনার শিকার হচ্ছেএসব ঘটনা খুব সহজেই আমাদের কাছে পৌঁছে যায়কিন্তু যারা সাহসিকতার পরিচয় দেন, সেই গল্পগুলো আমরা জানতে পারি না

একটি মেয়ে শারীরিক বা মানসিকভাবে নির্যাতিত, লাঞ্ছিত অথবা অপদস্থ হলে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান মেয়েটির সহায়তায় এগিয়ে এসেছে এ ধরনের ঘটনা আমাদের কান পর্যন্ত আসে নাখারাপ খবরের এই আধিক্য আমাদের মনোজগতে প্রভাব বিস্তার করছেনারীরা ধরে নিতে বাধ্য হচ্ছি যে পুরুষ মাত্রই খারাপযেসব পুরুষ নারীদের প্রতি সংবেদনশীল এবং যারা তা নয় সবাইকে একই ক্যাটাগরিতে বিবেচনা করছিফলে সমাজে নারী বনাম পুরুষ এরকম একটা পরিস্থিতি সৃষ্টির সম্ভাবনা দেখা দিচ্ছে

অন্যায়, নির্যাতন মুখ বুঁজে সহ্য না করে নারীদের প্রতিবাদ করতে হবে, নারীকে অপদস্থ বা লাঞ্ছিত করা হলে আশেপাশের মানুষকে তার পাশে এসে দাঁড়াতে হবে – দেশব্যাপী বিভিন্ন সচেতনতামূলক কার্যক্রমের ফলে জনগোষ্ঠীর বড় অংশই এই কথাগুলোর সাথে পরিচিত

কিন্তু এ বিষয়ক ভাল উদাহরণ আমাদের জানার সুযোগ হয় নাতাই আমরা কোন বিশেষ পরিস্থিতিতে সাহস দেখানোর অথবা কোন নারীর সংকটের সময়ে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে উৎসাহিত বোধ করি না

একবার একটি বাসে উঠার সময় বাসের কন্ডাক্টর অযাচিতভাবে আমার হাত ধরে টান দেয়আমি অত্যন্ত অপমানিত বোধ করি এবং ভীষণভাবে তাকে বকাঝকা করিকন্ডাক্টর সেসব শুনতে শুনতে এমন মুখ করে নিজের কাজ করতে থাকে যেন আমার কোন অস্তিত্বই নেইপুরো বাসের একজন যাত্রীও আমার পক্ষ হয়ে প্রতিবাদ করেনি

মানুষ যে কখনোই এ ধরনের পরিস্থিতিতে নারীর সহায়তায় এগিয়ে আসে না ঘটনাটিকে আমি তার একটি উদাহরণ বলেই ধরে নিয়েছিলামকিন্তু এখন আমি ঘটনাটিকে একটু অন্যভাবে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করিঐ বাসে আমার সহযাত্রী যারা ছিলেন তাদের বড় অংশ নিশ্চয়ই নিয়মিত বাসে আসা-যাওয়া করেনকিন্তু আমার মনে হয় না তারা তাদের দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় কখনো কোনো মানুষকে এ ধরনের ঘটনায় প্রতিবাদ করতে দেখেছেন অথবা শুনেছেন

অতএব, এরকম পরিস্থিতিতে কিছু করার আছে বলে তারা মনে করেন নাএই ঘটনাটি আমি যখন ফেসবুকে শেয়ার করেছিলাম তখন কিন্তু আমার অনেক পুরুষ বন্ধু বিভিন্ন পরিস্থিতিতে নারী সহযাত্রীকে তারা কিভাবে সহায়তা করেছেন সেইসব ঘটনা তুলে ধরেছেন

অর্থাৎ পজিটিভ ঘটনা ঠিকই ঘটছেকিন্তু সেগুলো বাসে নিয়মিত আসা-যাওয়া করা মানুষদের কান পর্যন্ত পৌঁছায় নাতারা প্রতিবাদ না করাকে, সহায়তার হাত না বাড়ানোকেই স্বাভাবিক বলে মনে করেন!

আমি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথমবর্ষে পড়িআমাদের সিনিয়র-জুনিয়র মেলানো একটা গ্রুপ ছিলসবাই মিলে ঠিক করলাম সিনেমা দেখতে যাবো

এক বড় ভাই আর আমার দায়িত্ব পড়লো টিকেট কাটারআমি মহাআনন্দে সেই ভাইয়ের সাথে মধুমিতায় গেলাম, টিকেট কাটলামসব কাজ শেষে সেই বড় ভাই হলের সামনে আমাকে নামিয়ে দিয়ে বললেন, ‘তুমি যে আমার সাথে যেতে রাজি হলে, তোমাকে যদি আমি কোনো খারাপ উদ্দেশ্যে অন্য কোথাও নিয়ে যেতাম, তুমি কি কিছু করতে পারতে?’ ‘কখনো কোনো ছেলের সাথে কোথাও যাবার আগে ভাল করে চিন্তা করবে, হুট করে রাজি হয়ে যেও না’

ঘটনাটি থেকে যে ম্যাসেজ আমি পেয়েছিলাম সবসময়ের জন্য তা আমার মনে গেঁথে আছেঅতএব শুধুমাত্র নেগেটিভ ঘটনায় ভরা, বঞ্চনাময় পথচলাই নারী জীবনের একমাত্র সত্য নয়অনেক সাহসী নারী প্রতিদিন অন্যায়ের শিকল ভাঙছেন, অনেক পজেটিভ চিন্তার মানুষ নারীকে এগিয়ে নিতে ভূমিকা রাখছেন

নারীর প্রতি সহিংস এই সমাজে যেসব পজিটিভ ঘটনা ঘটছে সেগুলো আরো বেশি করে জানা এবং অন্যকে জানানো প্রয়োজনএগুলো মানুষকে তার দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন করবেনারীদেরকেও প্রয়োজনীয় মুহূর্তে সাহসী উদ্যোগ নিতে উৎসাহিত করবেএর ফলে নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনাগুলো কমে গিয়ে পুরো সমাজই সামগ্রিকভাবে উপকৃত হবে

উপমা মাহবুব, ম্যানেজার, গ্লোবাল অ্যাডভোকেসি, ব্র্যাক

 

শেয়ার করুন: