ক্যামেরার চোখে ‘পিরিয়ড ট্যাবু’

উইমেন চ্যাপ্টার: নেপালের সিন্ধুলি গ্রামের সাতজন কিশোরী মেয়ের ক্যামেরায় উঠে এসেছে তাদের ‘পিরিয়ডময় কলংকিত’ জীবন। কাঠমান্ডু থেকে ১৩০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বের গ্রাম এই সিন্ধুলি। পিরিয়ডকে ঘিরে যেসব ট্যাবু সেই অঞ্চলে বিদ্যমান সেগুলোকে চ্যালেঞ্জ করা এবং নারী স্বাস্থ্য উন্নয়নে কাজ করার লক্ষ্যে দাতব্য সংস্থা ওয়াটার এইড একটি প্রকল্প হাতে নেয়। তারই অংশ হিসেবে এই সাত কিশোরী তাদের পিরিয়ডের সময় যা যা করা নিষিদ্ধ, তারই ছবি তুলে এনেছে।

nepal 1নেপালের অনেক স্থানে এখনও প্রতি মাসে মাসিকের সময় মেয়েদের পরিবার থেকে আলাদা করে ফেলা হয়, তাদের সূর্য দেখতে দেয়া হয় না, ফল-মূল এবং ফুল স্পর্শ করতে দেয়া হয় না। এমনকি নিজের বাড়িতেও থাকতে পারে না। এসময়টাতে তাদেরকে ‘অস্পৃশ্য’ বা ‘দুষিত’ বলে ধরে নেয়া হয়। এই সিস্টেমকে বলা হয় চৌপদী, পশ্চিমাঞ্চলীয় নেপালি হিন্দু পরিবারগুলোতে এটি বেশ জনপ্রিয় এখনও। ছয় থেকে ১০ দিন পর্যন্ত মেয়েরা পরিবার থেকে অচ্ছুত থাকে। সন্তান জন্মের সময়ও তাই।

দেশটিতে কথিত আছে, এসময় মেয়েরা যদি নিষিদ্ধ কিছু স্পর্শ করে, তবে তা পরিবারের জন্য দুর্ভাগ্য বয়ে আনবে। অথবা রোগবালাই দেখা দিবে সেই পরিবারে। মেয়েদের এসময় মাংস, দুধ, ফলমূল এবং শাকসব্জি খেতে দেয়া হয় না এই ভয়ে যে, মাসিকের সময় এগুলো খেলে এসব পণ্য উৎপাদন ব্যাহত হবে।

শুধুমাত্র ভাত, লবন আর শুকনো ফলমূল খেতে বাধ্য করা হয়। এই অবস্থা মেয়েদের শুধু মানসিকভাবেই পঙ্গু করছে না, লেখাপড়া, মানসিক/শারীরিক স্বাস্থ্যের ক্ষতি হওয়া ছাড়াও কমিউনিটিতে তাদের ভূমিকাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করছে। ২০০৫ সালে দেশটির সুপ্রিম কোর্ট এই ‘চৌপদী’ সিস্টেমকে বেআইনী ঘোষণা করলেও এখনও প্রত্যন্ত গ্রামগুলোতে ব্যাপকভাবে প্রচলিত আছে।

nepal4ওয়াটার এইড এর প্রকল্পটিতে অংশগ্রহণকারী ১৪ বছরের মানিশা বলছিল, প্রথম যখন তার মাসিক হয় তখন সে অন্য একজনের বাড়িতে ছিল, তাকে স্কুলে যেতে দেয়া হয়নি, এমনকি তাকে বইও পড়তে দেয়া হয়নি। এমন বিশ্বাস নাকি ছিল যে, মাসিকের সময় পড়ালেখাও করা যাবে না।

প্রকল্পে অংশ নেয়া কিশোরী মেয়েরা এর আগে কখনই ক্যামেরা হাতে তুলে নেয়নি। মাসিক নিয়ে ট্যাবু ভাঙতে যেসব কাজ তারা করেছে প্রকল্প অনুযায়ী সেগুলো তাদের বন্ধুবান্ধব এবং পরিবারের লোকজনকে দেখানোর সুযোগ করে দেয়া হয়েছিল। আর এ থেকেই সূত্রপাত হয় আলোচনার। যে দেশে শতকরা ৫৮ ভাগ নারী অশিক্ষিত সেখানে মেয়েদের কথা বলার সুযোগ সৃষ্টির জন্যই এই প্রকল্প নেয়া হয়েছিল।

ওয়াটার এইড এর প্রধান নির্বাহি, বারবারা ফ্রস্ট বলছিলেন, মাসিককে ঘিরে যে নীরবতা এবং কলংক লেপে রাখা হয়েছে তা মেয়েদের প্রতিদিনের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলছে। আরও বলতে গেলে স্কুলগুলোতে মেয়েদের জন্য নিরাপদ আলাদা টয়লেট নেই, মাসিকের সময় এমনিতেই মেয়েরা স্কুল কামাই করে অথবা এমনও হয় যে, ঋতুমতী হওয়ার পর আপনাআপনিই ঝরে যায় স্কুল থেকে। স্যানিটারি প্যাড পরিস্কারের কোনো ব্যবস্থা না থাকায় নারী ও মেয়েরা খুবই অস্বাস্থ্যকর দিন কাটায়। তাঁর ভাষায়,

“Being able to deal with periods in a hygienic and dignified way is crucial to women’s wellbeing. It helps women feel that they are able to play a full role in society, no matter what time of the month.”

Nepal 2সুষমা দিয়ালি নামের একটি মেয়ের ছবিতে একটি আয়না এবং একটি চিরুনি ছিল। সে জানায়, এগুলো সে বাড়িতে ব্যবহার করে। তার সমাজে মেয়েদের মাসিক হলে আয়নায় মুখ দেখা বা চুল আঁচড়ানো বারণ। তবে সৌভাগ্য যে, তার পরিবারে এই চল নেই। তার মতে, আয়না এবং চিরুনি হচ্ছে পরিচ্ছন্নতার প্রতীক। তার বন্ধুরাও যদি তার মতোন পরিবেশ পেতো এবং মাসিকের সময় পরিবারের সহায়তা পেতো, তাহলে সে অনেক খুশি হতো। সুষমা তাদের স্কুলের টয়লেটের ছবি তুলে এটাও জানায় যে, স্কুলে টয়লেটের সংখ্যা কম হওয়াতে তাদের দীর্ঘ লাইন দিতে হয়, ভিতরের ছিটকিনিও কাজ করে না। ফলে বাইরে থেকে অন্য একজনকে দরজা চেপে ধরে রাখতে হয়। একে সে খুবই হয়রানিমূলক বলে বর্ণনা করেছে।

nepal3মানিশা কাকরি একটি ঝর্ণাধারার ছবি তুলেছে। যেখানে সে বলেছে, এই জলেই সে স্নান করে এবং মাসিকের সময় ব্যবহৃত কাপড় ধোয়। কিন্তু এরকম খোলামেলা পরিবেশে মাসিকের কাপড় ধোয়া তার জন্য খুবই অস্বস্তিকর।

রাবিনা নামের একটি মেয়ে জানায়, তার যখন প্রথম মাসিক হয়, সে জানতোই না, মাসিক কী জিনিস, কেন তার রক্ত ঝরছে। সে ভয় পেয়ে গিয়েছিল। এমন কাউকেই সে পায়নি সাহায্য করার মতো। নিজের ভেতরে তখন যে পরিবর্তনগুলো হয়েছিল তার সাথে খাপখাইয়ে নিতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে বলে জানালো মানিশা।

বন্দনা খাদকা তার মায়ের একটি ছবি তুলেছে, যেখানে মা ছোট বোনকে খাইয়ে দিচ্ছে। এটা দিয়ে বন্দনা বলছে, সেও এরকম আদরের ছিল। কিন্তু মাসিক শুরুর পর তাকে আলাদা করে দেয়া হয়, আলাদা খেতে হয়, কেউ তাকে ছোঁয় না, নিজেকে ভালবাসাহীন, অস্পৃশ্য বলে মনে হতে থাকে তার।

nepal6বিশেষ্ঠা ভান্ডারি নামের ১৫ বছরের এক কিশোরী জানায়, মাসিকের সময় নিজের বাড়িতে থাকা খুবই জরুরি এবং নিরাপদ। অথচ তাদের থাকতে হয় অন্য জায়গায়, যেখানে সে মোটেও নিরাপদ ভাবে না নিজেকে। এসময় বাড়তি যত্ন এবং বাবা-মায়ের সহায়তার প্রয়োজনীয়তার কথাও সে জানায়।

সাবিনা গৌতম নামের একটি মেয়ে মায়ের পেঁপে কাটার ছবি তুলে বলতে চেয়েছে, মাসিকের সময় তাদের পেঁপে খেতে বারণ করা হয়। অথচ সে খুবই পছন্দ করে এই ফলটি। তাছাড়া ফলটি পুষ্টিকরও। কিন্তু তাদের শুধু যে খেতে না করা হয়েছে, তাই নয়, ছুঁতেও বারণ করা হয়েছে মাসিকের সময়টাতে।

28th May is International Menstrual Hygiene day, which aims to challenge stigma around periods across the globe and raise awareness for menstrual hygiene. This project was part of a Uk aid programme WaterAid are running across Nepal, to improve girls’ ability to manage their periods. For more information visit:www.wateraid.org

 

শেয়ার করুন: