আত্মহত্যা মহাপাপ ও  সিগারেটের প্যাকেট….

কাকলী তালুকদার: সিগারেটের গায়ে সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ ‘ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর’। যারা সিগারেট খায় তারা এই ছোট্ট লেখাটি নিয়ে চিন্তিত নন, তাই সিগারেটের প্যাকেটের দাম বাড়ছে দিন দিন। যারা সিগারেটকে নেশা মনে করেন তাদের কাছে ‘ক্ষতিকর’ শব্দটি তুচ্ছ। আর যারা ব্যবসা করছেন তারা তাদের দায় এড়াতে চান সে ছোট্ট সতর্কীকরণ লেখাটি দিয়ে। লাভ বিষয়টি খুব ব্যবসায়িক, এখানে আবেগ অনুভূতি মার খেয়ে যায়। তাই ব্যবসায়ী দ্বারা সমাজের অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব হলেও সমাজের নৈতিকতা গঠন সম্ভব  নয়।

baba n meye 1সবার মতামত ভিন্ন হতে পারে, আমি আমার মতামত বললাম। আমি যখন মাঝে মাঝে বই এর স্টল থেকে বুটিক্সের প্রতিনিধিত্ব করেছি সেই সময়গুলো মুনাফা ছিল আমার মূল চিন্তা। সেই অভিজ্ঞতা থেকেই এই মতামত।
আমাদের ধর্ম শিক্ষা থেকে জেনেছি, আত্মহত্যা মহাপাপ। জ্ঞানীরা যখন মুখ ভারী করে এই বাক্যটি আমাদের বলেন তখন শুনতে বেশ লাগে।

কিন্তু মানুষ কেন আত্মহত্যা করে? কী কারণে এই অসম্ভব কাজটিকে সম্ভব করে তোলে? আমাদের তো সবারই নিজের জীবনটি খুব প্রিয়। কী এমন বিষয়গুলোর জন্য নিজের জীবনকে তুচ্ছ মনে হয়? অনেক কারণে মানুষ আত্মহত্যা করে কিন্তু বিষয়টি ঘুরে ফিরে আবেগের। স্বার্থপর এবং বাস্তবতায় আস্থার মানুষ কখনও আত্মহত্যা করতে পারে না। সে নিজেকে মোকাবেলা করে বেঁচে থাকে সমাজে।

যারা আত্মহত্যা করে তারা ভীতু? অনেকেই তাই বলেন, এটা হেরে যাওয়া, সত্যিই তাই, এটা হেরে যাওয়া। কিন্তু তারা ভীতু নয়, একজন ভীতু মানুষ নিজেকে হত্যা করতে পারে না কখনই।
হাজার যন্ত্রণা নিয়ে আমরা প্রতিদিন বেঁচে থাকি। জীবন বা বেঁচে থাকাটা একটা চলমান সংগ্রাম, আমি তাই অনুভব করি। তাই সুখ-দুঃখ, রাগ-অভিমান, যন্ত্রণা-বিষাদ, ভালবাসা- হতাশা বিষয়গুলো আমাদের জীবনের অংশ।

কিন্তু আমরা ঠিক কতজন ‘সুখ’ ‘আনন্দ’ ‘ভালোবাসা’ ছাড়া অন্য  অনুভূতিগুলোর মূল্যায়ন করি? সবাই সুখের পিছনে ছুটি কিন্তু দুঃখ বিষয়টির অমর্যাদা করি।
সুখ কি কোন বস্তু? নাকি একটি অনুভূতির নাম?
মিষ্টি, তিতা, টক, ঝাল, একেকটা স্বাদের নাম। প্রতিটা স্বাদের ভিন্নতা রয়েছে।

Baba 1আমাদের সমাজে কি কোথাও এই সকল অনুভূতির গুরুত্ব শেখানো হয়? পরিবারে কিছুটা হয় সত্য,তবে সেটা আমাদের মানসিক গঠনে যথেষ্ট ভূমিকা কি রাখছে? সব পরিবারে কি এই অনুভূতির মূল্যায়ন নিয়ে  সিরিয়াসলি কেউ ভাবছেন?
সাবিরা মেয়েটির আত্মহত্যার খবর আমি ফেইসবুকে দেখেছি। না, আমি এখনও তার মৃত্যু যন্ত্রণার ভিডিও দেখিনি, দেখার আগ্রহ বোধও করছি না। শুধু ভাবছি, মেয়েটিকে যদি একটু নির্ভরতা দিতে পারতাম, তবে হয়তো একটি আত্মহত্যার সংখ্যা কম হতো।

কয়েকদিন আগে সাতক্ষীরার একটি স্কুল অথবা কলেজ পড়ুয়া ছেলে আত্মহত্যা করেছে। একই কারণ, সম্পর্ক বিষয়ক। আমি কোনো মৃত্যুই সহ্য করতে পারি না, তার মধ্যে আত্মহত্যা সে তো আরো না।
সাবিরা বা অর্ণব তারা কি নির্ভরতা খুঁজেছিল সম্পর্কে? তাই আবেগগুলো সামলাতে পারছিল না? সন্তানদের আবেগের জায়গাগুলো আমরা কয়জন মূল্যায়ন করি?
পেটের চাহিদার সাথে শরীর এবং মনের চাহিদাগুলোও একটা বয়সে তৈরি হয় খুব স্বাভাবিক নিয়মে। যার ফলাফল আমরা প্রতিটি মানুষ এবং আমাদের আবেগ অনুভূতিগুলোর বহি:প্রকাশ। নারী-পুরুষের পারস্পরিক আকর্ষণ তৈরি না হলে কি মানুষের সৃষ্টি হতো?
পৃথিবীর সকল জীবের ক্ষুধা এবং সেক্স এই দুই ধরনের চাহিদা প্রাকৃতিক। বংশবৃদ্ধি বা বেঁচে থাকার আকর্ষণই প্রকৃতির ধর্ম। নিজেকে বড় প্রমাণ করার চেষ্টা বা শক্তি চর্চার বিষয়টিও জীবের সাধারণ বৈশিষ্ট্য।  এখানেই মানুষের সাথে অন্যান্য জীবের পার্থক্য।
সভ্যতাকে প্রতিষ্ঠিত করতে বিচার-বিবেচনাকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। বিচার-বিবেচনার মানদণ্ডও  অনেক সময় মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়!
আজ সাবিরারা যখন মরে যায় তার মৃত্যুটিকে জায়েজ করতে অনেক মানুষ উঠে পড়ে লাগে। যেন বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়াটাই শ্রেয়!
এই যে আমাদের চিন্তার দৈন্যতা, এর মূল কোথায়?
দিনের পর দিন গলা কেটে হত্যার বৈধতা দিতে গিয়ে সরকার যেভাবে ধর্মের দোহাই দিচ্ছে, সেই দৈন্যতা কি একেই সূতোয় গাঁথা?
মার্ক টোয়েনের একটা ছোট গল্পের বিষয় আমার মনে গেঁথে আছে আজও। এক মধ্য বয়স্কা নারীকে ডাক্তার বলে দিয়েছে মরে যাবে। সে জানালায় দাঁড়িয়ে প্রকৃতি দেখে প্রতিদিন। পাশের বাড়ির জানালায় একটি সবুজ পাতা বাহারের গাছ দেয়াল বেয়ে উপরে উঠে গেছে। সে যখন থেকে আগাম মৃত্যুর খবর জেনেছে সেই সবুজ পাতার গাছটির পাতাগুলোও একটি একটি করে ঝরে যাচ্ছিল।  একাকীত্বে থাকা সেই নারী ঝরে যাওয়া পাতাগুলো প্রতিদিন গুনতে লাগলো আর ভাবতে লাগলো এই গাছটিতে যেদিন শেষ পাতাটি ঝরে যাবে, সেদিন তারও মৃত্যু হবে। গাছটি যে বাসার দেয়ালে সেখানে এক চিত্রশিল্পী বাস করেন। সেই মধ্য বয়স্কা নারীর গাছ নিয়ে ভাবনার বিষয়টি চিত্রশিল্পী আরেকজনের মাধ্যমে জেনে যায়। এরপর থেকে জানালায় দাঁড়িয়ে থাকা নারী এবং তাঁর নিজের দেয়ালে সবুজ পাতার গাছটি তারও পর্যবেক্ষণের বিষয় হয়ে দাঁড়ালো।
একদিন খুব বৃষ্টির দিনে সেই নারীর জানালা বন্ধ দেখে সেই চিত্রশিল্পী গাছের ছবিটি দেয়ালে কয়েকটি পাতাসহ এঁকে দিলেন। দূর থেকে মনে হয় গাছটি আরও সুন্দর হয়ে বেঁচে আছে। মূল গাছটির পাতা সব ঝরে গিয়েছিল সেদিন।
টানা দুদিন বৃষ্টির পর সে নারী যখন জানালা খুললো অবাক হয়ে দেখলো গাছের পাতা আরও সবুজ হয়েছে। সেই নারী নিজের জীবন নিয়ে খুব ইতিবাচক ভাবনা ভাবতে থাকলো। কিন্তু কদিন পরই পাশের বাড়ির সেই চিত্রশিল্পীর মৃত্যু সংবাদ শুনতে পায় সেই নারী। বৃষ্টিতে ভিজে ছবি আঁকতে গিয়েই অসুখে পড়ে শিল্পীর মৃত্যু হয়।

kakoli
কাকলী তালুকদার

মানুষের দায়িত্ববোধ একদিকে যেমন সমাজকে সুন্দর করে, ঠিক দায়িত্বহীনতা সমাজকে ধ্বংস করে দেয়।
সমাজ রক্ষায় আমাদের নীতি-নির্ধারণীগুলো অনেক সময় আমাদের মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়। সাবিরা বা অর্ণবের আত্মহত্যার দায় আমাদের সকলের। আজ তাদের ব্যর্থতার গল্পগুলো বলে নিজেদের দায়িত্বহীনতাকে আড়াল করার যে অপচেষ্টা তা আমাদের দৈন্যতার বহি:প্রকাশ।
সাবিরার আত্মহত্যা বা দামী মডেলের সেক্স ভিডিও দেখছেন স্বামী-স্ত্রী মিলে। জাগিয়ে তুলছেন নিজেদের যৌন মনকে। সামনে এসে তাদের মুখে থুথু দিচ্ছেন নিজের ভাল চরিত্র হাসিল করতে।
মাঝে মাঝে সিগারেট কোম্পানির মতো, ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর আর ‘ আত্মহত্যা মহাপাপ’ বলে নিজের দায় এড়াচ্ছেন!
তবে তো সিগারেট কোম্পানির মতো মুনাফালোভীর চরিত্রটির সাথে আমাদের সমাজপতিদের কোন তফাৎ থাকলো না।
বিপদে মানুষকে উপহাস না করে পাশে দাঁড়ানোর চর্চাটা আমাদের করতে হবে। নয়তো উপহাসকে মৃত্যুর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ মনে হতে পারে কারো কারো। তার বিনিময়ে নিজের জীবনকে নিমিষেই শেষ করে দিচ্ছে কেউ কেউ। আর সেই সংখ্যাটা নারীদের ক্ষেত্রে বেশি।

কেন? নিজেকে সভ্য দাবি করার আগে ভেবে দেখেছেন কি আমাদের ভুলগুলো বা বৈষম্যগুলো ঠিক কোথায়? আত্মহত্যা মহাপাপ বলার আগে চলুন আত্মহত্যার কারণগুলো খুঁজি।
সিগারেটের প্যাকেটের গায়ে ‘ধূমপান মৃত্যুর কারণ’ লেখার চেয়ে চলুন সিগারেট কোম্পানির বিরুদ্ধে দাঁড়াই।

 

শেয়ার করুন: