নারীর আসলেই কোনো বাড়ি নেই

সুপ্রীতি ধর: ২০১০ সালের কথা। দিনটি ছিল শুক্রবার, রাতভর কালবৈশাখী ঝড় হয়ে গেছে। সকাল সাড়ে ৯টা নাগাদ একটা ফোন এলো আমার বড় দাদার ছেলের কাছ থেকে। মেয়েকে বললাম, দাদাভাই এর ফোন, ধরো। সে কী বললো জানি না, ফোনটা আমাকে দিয়ে বললো, তোমাকেই চাইছে। আমি তখন চূলায় কী যেন রান্নার চেষ্টা করছিলাম। এককানে ফোনটা ধরে আরেক হাতে ফ্রাইয়িং প্যানে নাড়ছি।

বললাম, বলো……….সে শুধু বললো, চক্কন (আমার মা, যাকে সে আদর করে চক্কন ডাকতো) মারা গেছে।

ma 2
১৯৮৮ সালে হাওয়াইতে তোলা

ফোনটা হাত থেকে পড়ে গেল, আমি ধপাস করে বসে পড়লাম মা বলে চিৎকার দিয়ে। বাচ্চারা যা বোঝার বুঝে নিলো। খালা এসে আমাকে তুলে নিয়ে বিছানায় বসালো।

মায়ের মুখটা কেবলই ভাসছে আমার, গেল শনিবারেই দেখে এসেছি। শেষ সময়টা থাকতে চেয়েছিলাম মায়ের কাছে, হয়নি, অনুমতি মিললেও অনেক বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছিল আমার এবং বাচ্চাদের চলাফেরায় যে, মেয়েই আমাকে জোর করে নিয়ে এলো, ছেলের তখন ১০৪ জ্বর। রাত ১১টায় তিনজন এক রিকশায় করে কোনরকমে নিজের ছোট্ট গরীব বাসার ততোধিক আরামের বিছানায় চলে এলাম।

মা তখন আর কথা বলতে পারতো না, শুধু ইশারায় ডাকতো, আমি গেলে বাচ্চাদের মতো খুশি হয়ে উঠতো। আসার সময় মায়ের নীরব চাহনি দেখে প্রচণ্ড রাগ করে বলেছিলাম, ‘চলেই তো যাচ্ছো, মাঝখানে আমাকে ‘অপমান’ করার আরও অনেক অনুষঙ্গ করে দিয়ে যাচ্ছো’। কী বুঝেছিল জানি না, আদৌ শুনেছিল কিনা, তাও জানি না। পরের পাঁচদিন আর যাইনি রাগ করে।

মাকে যে মধ্যবয়সী নারীটি দেখাশোনা করতেন, তিনি বলেছিলেন, ‘আপনি তো আসলেন না, আপনার মা আপনাকে খুঁজতো, বার বার দরজার দিকে তাকিয়ে দেখতো, এই বুঝি আপনি এলেন’।

না, মায়ের সাথে আমার শেষ দেখা আর হয়নি। কেন হয়নি, এগুলো ভাবলে নিজের শরীরে নিজেই আগুন লাগাতে ইচ্ছে করে।

Maa er Shmashan
এই চিহ্নটুকুও আজ নেই কোথাও

যেমন কিছুদিন আগে দেখলাম, মায়ের শ্মশানটা বাঁধাই করার কথা থাকলেও গত ছয় বছরে তা হয়ে উঠেনি। একটা তুলসী গাছ ছিল সেখানে, ছাগল মনে হয়ে খেয়ে নিয়েছে, সেখানে এখন ঝরা শুকনো পাতার সমাহার। চিহ্নটুকুও নেই।

অথচ এই বাড়ির ‘বউ’ ছিল আমার মা, যে কিনা এই বাড়িতে রীতিমতোন বিপ্লব ঘটিয়েছিল। যা আর কোনো বউই করতে পারেনি। মায়ের সন্তান বলেই আজ দুটো লাইন আমি লিখতে পারি, দুই পায়ের ওপর দাঁড়িয়ে আছি এখনও অন্যায়ের সাথে আপোস না করেই। কিন্তু সেই বড়বাড়ির বউ এর চিহ্নটুকুও এখন আর নেই। এটা দেখে আমার বুকের ভিতরটা দুমড়ে-মুচড়ে গেছে। আমি সেটা জানিয়েছি সংশ্লিষ্ট মহলে। যদিও জানি তারা এটাকে আমার স্বভাবজাত বালখিল্যই ধরে নেবে। তা নিক।

মা সারাজীবন এই বাড়িটি আগলে রেখেছিল, এই বাড়ির মান-মর্যাদা সব ধরে রেখেছিল, সব শাশুড়ির চোখের মনি ছিল আমার মা, অথচ সেই মা-ই আজ কোথাও নেই। ছবিতে আছে। কিন্তু আমার সাথে মায়ের জড়িয়ে ধরা একটা ছবি ছিল, যেটা মা বেঁচে থাকতে বিছানার কাছে রেখে দিতো, সেটা এখন কোনো এক আলনার নিচে জুতার পাশে ঠাঁই পেয়েছে, কারণ সেই বাড়ির মেয়ে হলেও আমার কোনো অধিকার নেই আজ। আমারও কোনো বাড়ি নেই। মায়ের সাথে কথা বলতে চাওয়াটাও রীতিমতো যুদ্ধ ছিল একসময়, তখন মা গৌরীপুরে, অসুস্থ। একবার মা দিবসে একটা মোবাইলে কিনে দেই মাকে, যাতে যখন-তখন কথা বলতে পারি। মা সেই ফোনটাকে সারাদিন মুঠোয় ধরে থাকতো। বলতো, ‘এটা তো তুই, এটা ধরে থাকা মানে তোকেই ধরে রাখা’। মা এতোদিন হয়ে গেল কাকে এখন ধরে রাখে, বড়বেশি জানতে ইচ্ছে করে।

ক্ষুব্ধ আমি, প্রতিবাদী এই আমি, জীবনকে মোকাবিলা করার মতো সমস্ত সাহস কিন্তু আমার এই মা থেকেই পাওয়া। আমার মা বিপ্লবী ছিল, সুভাষ বোসের আজাদ হিন্দ ফৌজের সদস্য ছিল, বিয়েও করেছিল আন্দোলনের সাথীকেই। মায়ের বাবা দেশছেড়ে চলে গেলেও মেয়েকে কিছু সম্পত্তি দিয়ে গিয়েছিলেন। আমার কপালে তাও জোটেনি, আমার যে বাবা নেই, একাত্তরেই তো হাপিস হয়ে গেছে বাবা। সুতরাং আমার কোনো বাবার বাড়িও নেই।

একাত্তর পরবর্তী জীবনটা আমার/আমাদের অনেক চড়াই-উৎরাইয়ের ভিতর দিয়ে গেছে। ছোটবেলাতেই বাসায় নানান আত্মীয়-স্বজনের আনাগোণা দেখেছি, কেউ দূর গ্রামাঞ্চল থেকে পরীক্ষা দিতে এসেছে, কেউ বা পড়তে এসেছে। মা তার উদয়াস্ত চাকরি নিয়ে ব্যস্তভ ভোট চারটায় ট্রেন ধরে, সন্ধ্যায় ফিরে রান্না করে আমাদের জন্য। সারাদিন বাসায় কী হয়, তা তার জানা হয় না। আমার খাবার বরাদ্দ থাকে পাশের বাড়িতে, রোজ দুধ দিয়ে যেত এক লোক সাথের পিসীমার বাড়িতে, মা চাল দিয়ে যেত। সেই দুধভাতই আমার দুপুরের খাবার।

স্কুলে যাই, স্কুল শেষে টই টই করে ঘুরে বেড়াই, দস্যিপনা করি, পুকুরে লাফাই, প্রতিদিন বিচার আসে আমার নামে। অনেকদিন মা সহ্য করতে না পেরে আমাকে মারে, আমি কষ্ট পাই তাতে শারীরিক-মানসিক দুটোই। কারণ যে বাসাটাতে আমি থাকি, মায়ের অবর্তমানে সেই বাসায় আসে বড় দাদার বন্ধুরা তাদের বান্ধবীদের নিয়ে। আমার আর জায়গা হয় না বাসায়।

ছোট্ট মফস্বল শহরে বড় হতে থাকি আমি। নজরে পড়ি অনেকের। বেশিরভাগই কুনজর। কাউকে বলার নেই আমার। মনে মনে নির্ভরশীল কোন রাজপুত্রকে খুঁজি। একসময় যাকে পাই, শেষপর্যন্ত বিদেশ-বিভুঁই ঘুরে এসে তাকে বিয়ে করলেও সে রাজপুত্র হয় না আমার। ফলে সেখানেও আমার ঘর হয় না।

দেশে দেশে ঘুরি একটা বাসা, নেহায়েত একটা ঘরের খোঁজে। ভুল করি আবারও। সংসারের স্বপ্ন একেবারেই শেষ হয়ে যায় আমার মৃত্যুশয্যায় শোয়া আমার মায়ের চোখের সামনেই। মা বলেন, ‘এই বিশাল সংসার সমুদ্র তুই পাড়ি দিবি কী করে’? আমি পাল্টা জিজ্ঞ্যেস করে, ‘তুমি কীভাবে দিয়েছো?’

মা বলে, ‘আমার তো ঘরবাড়ি ছিল, শাশুড়িরা ছিলেন, জমিজমা ছিল, সম্পত্তি ছিল, অর্থওয়ালা সন্তান আছে, কিন্তু তোর?’

আমার জবাব উঠে না ঠোঁটে, কীই বা জবাব দেবো, এগুলোর তো কিছুই না। উপরন্তু আছে, একলা চলার গঞ্জণা-অপমান, পদে পদে বিরোধিতা, চাকরি নাই হয়ে যাওয়া, চাকরিতে সুযোগ না পাওয়া। আমার প্রতিবাদী মন এতে আরও ক্ষুব্ধ হয়। সবাই বলে, এই রয়ে-সয়ে চলো। আমি যে নিজের সাথে বিরোধিতা করতে পারি না।

ma 3কাল আবার ১৬ই এপ্রিল, আমার মায়ের চলে যাওয়ার দিন। প্রতিদিন একবার না একবার এই ভাবনাটা আসেই আমার, ‘মা, কেন তুমি আমাকে একা ফেলে গেলে, কেন নিয়ে গেলে না, যে শুকনো মুখটা দেখে তুমি বুঝতে সব, সেই মুখটার দিকে একবার তাকাও তো মা, কোনো সমূহ বিপদ কী দেখতে পাও সেখানে?’

এখনও রাতে-মধ্যরাতে চিৎকার করে কাঁদি মায়ের জন্য, আমার মা-বাবার জন্য, একটা বাবার বাড়ির জন্য, ভাই-বোনের একটু আদরের জন্য, আমার শিউলী ফুলগাছটার জন্য। হয় না, মেলে না। আমার অপারেশনের সময় সব বন্ধুরা ছিল পাশে, কিন্তু মাতৃসম দিদি আসেনি। তাদের অনেক সংস্কার আমার কাছে আসতে গেলে। আমি নিশ্চিত জানি, মা থাকলে ঠিকই আসতো।

এখানে আমি থাকবো না, চলে যাবো। একটা দেশের খোঁজে, একটা বাড়ির খোঁজে আমি একদিন না একদিন নিরুদ্দেশ হবোই। হয়তো মাকেও পাবো সেখানেই আমার জন্য অপেক্ষায়। মা আমার, ভালো থেকো। তোমার চিহ্ন মাটিতে নেই তো কী হয়েছে, আমার মাঝে তো আছে। তুমি আছো সর্বভূতে মা।  

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.