শাশ্বতী বিপ্লব: সহকর্মীদের আলোচনা রত্নার অসহ্য লাগতে থাকে -কে কেমন শাড়ি কিনেছে, সাথে কেমন চুড়ি পড়বে, লাল বড় টিপ। রত্না এই আড্ডায় যোগ না দিলেও পাশ থেকে ভেসে আসা কথাগুলো ওর মাথায় পিন ফুটাতে থাকে যেনো। জ্বর জ্বর অনুভুতিটা ফিরে আসে।
পহেলা বৈশাখের সাথে এইবার সাপ্তাহিক ছুটি পড়ায় রবিবারে সবাইকে আবার অফিসে সেই শাড়ি পরে আসতে হবে। কেন বাবা? যার ইচ্ছা পরবে, যার ইচ্ছা পরবে না। এতো জোরাজুরি কিসের!! কিন্তু তা হবে না, তাহমিনা আপা বলে দিয়েছেন, সবাইকেই পরতে হবে। তাহমিনা আপা এইবার তিনটা বৈশাখের শাড়ি পেয়েছেন। একটা নিজে কিনেছেন, বাকি দুইটা গিফট। রত্না একবার ভাবলো বলে, একটা আমাকে একদিনের জন্য ধার দেন আপা, অফিসে পরে আসি। কিন্তু সেটা বলা যায় না, অফিসের সহকর্মীকে নিজের সুখ বা অসুখ জানানোর একটা সীমারেখা থাকে। সব বলতে নেই।
রত্নার সব রাগ গিয়ে পরে সামনে দাঁড়ানো জয়নবের উপর। তখন থেকে টেবিলের গা ঘেঁষে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে, বসতে বললেও বসছে না। সামনে পাতা বেঞ্চ দুটোয় আরো পাঁচজন বসে আছে – কেউ স্বামী পরিত্যক্তা, কারো স্বামী ভরণপোষন দেয় না, কারো স্বামী রোজ মারধর করে, কারো স্বামী আবার দ্বিতীয় বিয়ে করেছে। রত্নার অফিস এইসব নারীদের আইনী সহায়তা দেয়, অনেক সময় স্বামী-স্ত্রী দুই পক্ষকে নিয়ে বসে আলোচনা করে মিমাংসা করে দেয়। রত্না মাঝে মাঝে ভাবে এই চাকরিটা ছেড়ে দেয়; সারাক্ষণ এইসব অভিযোগ শুনতে শুনতে ওর ভিতরটাও কেমন অসুস্থ হয়ে উঠে, শরীরটা খারাপ লাগে।
রত্না জয়নবকে বলে, বসতে বললামনা, দাঁড়ায়া আছো ক্যান? জয়নব উত্তর দেয় না, সে বসবে না। সে পালাতে চাইছে, কেন যে এসেছিলো সেই জন্যে নিজেকে মনে মনে গালি দিতে থাকে।
রত্না বলতে থাকে, “শোন জয়নব, এই তোমাদের মত বউদের জন্যেই পুরুষগুলা এতো বাড়াবাড়ি করার সাহস পায়, বুঝলা। এমন স্বামী না থাকলে কি হয়!! মারতে মারতে পুরা মাইরা ফেললেও তোমার সেই স্বামীর ঘর করা লাগবে, আশ্চর্য!’
জয়নব মৃদু স্বরে বলে, “পোলাডা বাপের জন্যে কান্দে…”
“পোলাপান মানুষ, বুঝেনা তাই কান্নাকাটি করে। বড় হলে বুঝতে শিখবে, তখন কাঁনবে না।”
“মাইয়াডা বড় হইতাসে, অহনই মাইনসে নজর দেয়। বাপ না থাকলে…বিয়াও তো দিতে হইবো। বাপ ছাড়া….”
রত্না অধৈর্য হয়ে ওঠে, জয়নবের মুখের কথা কেড়ে নেয়, “রাখো, আজকাল এইসব কেউ মানে নাকি? মেয়েরা কতকিছু করতেসে একা একা…” রত্না থেমে যায়।
কখন যেন বেখেয়ালে রত্নার গা থেকে অতি সতর্কতার সাথে টেনে রাখা আঁচলটা সরে গেছে। জয়নব অবাক চোখে তাকিয়ে আছে সেদিকে। কাল রাতের মারের কালসিটে দাগগুলো দিনের আলোয় চৈত্রের শেষ দিনের রোদ মেখে নিতে চাইছে যেনো।ফিসফিসিয়ে বলে চলেছে, তোমার আমার জীবনের মাঝে শুধু এক টেবিল দূরত্ব জয়নব….