অম্লান তাড়নায় ম্লান বৈশাখ

সালেহা ইয়াসমীন লাইলী: স্মৃতিতে পহেলা বৈশাখ আর নানির মুখ একসাথে ঝকঝক করে ওঠে আমার। আবার মেলায় গিয়ে দুইটি ভাই-বোনের হারিয়ে যাওয়ার দৃশ্যটিও বৈশাখ মনে করিয়ে দেয়। নানি চলে গেছেন প্রায় সাত বছর। এতটুকুও মলিন হয়নি তাকে জড়িয়ে আমার বৈশাখের স্মৃতি। আর এখনও এইদিন এলে আমি হারিয়ে যাওয়া শিশু দুটির মাকে লুকিয়ে দেখতে যাই।   

BOISHAKHI 1চৈত্র মাসের মাঝামাঝিতে এলোমেলো বাতাস বইতে শুরু করলে নানি আয়োজন শুরু করে দিতেন বৈশাখ বরণের ও বিগতকে বিদায়ের। চৈত্র সংক্রান্তির দিন পুরোন বাসনকোসন কালি ফেলে পরিস্কার করা হতো। ঘরের কাপড়, বিছানাপত্র রোদে দিয়ে ঘর ভালোভাবে পরিস্কার করতেন। বিষকাটালের গাছ উপড়ে এনে বালতিতে চুবিয়ে রেখে সেই পানি ঘরময় ছিটাতেন। নানি বিশ্বাস করতেন এভাবে করলে ঘরে পোকা-মাকড়, মশা-মাছি কম হয়। এদিন সাত প্রকারের শাক একসাথে মিশিয়ে রান্না করা হতো। ডালের সাথে কাঁচা আম কেটে দিয়ে শুকনা মরিচের বাগার দেয়া হতো। চৈত্র সংক্রান্তির আগে নানি কাঁচা আম খেতে দিতেন না।

তাছাড়া এই দিন সাত প্রকারের শষ্যদানা ভেজে বাড়ির সবাইকে খেতে দেয়া হতো। জঙ্গী কচু তুলে আগুনে পুড়িয়ে শিশুদের মুখে পুরে দিতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন এইদিন কচু খেলে সারা বছর শিশুদের মুখে ঘা হয় না। বড়দের জন্যও তিনি সারা বছরের মুখে ঘা প্রতিরোধের চিকিৎসা দিতেন। চালভাজার সাথে রসুন, আদা, মরিচ, নিমপাতা ও তেতুলপাতা মিশিয়ে উনুনে গুড়ো করে সবাইকে খেতে দিতেন। এসব কাজ নানি জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত নিজ হাতে করে গেছেন। আমার কাছে বাংলা নববর্ষ মানে আমার নানির নানা আচার আয়োজন।

নববর্ষের দিন বিশেষ পোশাক পরা হতো না। সকালে পান্তার খাওয়ার আয়োজন হতো। এই পান্তা আগের রাতের খাবার খাওয়ার পর আবারো ভাত রান্না করে পানি ঢেলে রেখে দিতেন। পান্তার সাথে শুকনো মরিচ পোড়া ও পেঁয়াজের সাথে শুক্তো, শুটকি ভর্তা, ঝুড়ি আলুর ভর্তা থাকতো। দুপুরে বা রাতে বাড়ির পোষা বড় মোরগ বা হাঁস জবাই করা হতো। এই দিন অবশ্য্ই পুকুরে জাল ফেলে ভাগ্য পরীক্ষা করে নিতেন। জালে বড় মাছ উঠলে ধরে নেয়া হতো সারা বছর অনেক বড় মাছ খাওয়া হবে।

Lailiএদিন পাশের গ্রামে ধরলা নদীর পাড়ে দশহরার মেলা বসতো। হিন্দু-মুসলিম সকল ধর্মীয় লোকজন ধরলার পানিতে নেমে স্নান করা দেখতাম। দশহরার মেলা কোন ধর্মের মানুষদের মেলা বোঝা যেতো না। বিকেলে আমরা দলেবলে মেলায় যেতাম। তাই আমার ছোটবেলার নববর্ষ মানে দশহরার মেলা। গ্রামের নিরীহ দু’টি ভা্ই-বোনের হারিয়ে যাওয়া আর তাদের মায়ের গ্রামজুড়ে আহাজারি।

আমি সেবার শেষবারের মতো মেলায় গিয়েছি। আমাদের বাড়িতে নুরজামাল নামে এক কাজের ছেলে ছিল। কিছুদিন আগে তাকে বিয়ে দিয়ে আলিজানকে বউ করে আনা হয়েছিল কাজের মেয়ে হিসেবে। নববর্ষের দিনে দশহরার মেলায় যাওয়ার জন্য এসেছিল সেই বউয়ের ছোট বোন আমার সমবয়সী নবিজান ও ভাই আলম।

ওদের সাথে নিয়ে আমরা সবাই দলবলে মেলায় গিয়েছি। সবাই নিজের মতো ছুটাছুটি, নদীর হাঁটু পানিতে নামা, নাগরদোলায় চড়া, সাপের খেলা, বানর খেলা দেখছি ক্লান্তিহীন। সন্ধ্যার আগে মুড়কি-বাতাসা কিনে দিয়ে আমাদের অভিভাবক ছোট মামা সবাইকে মেলার বাইরে ফাঁকা জায়গায় জড়ো করতে লাগলেন। একে একে সবাই্ জড়ো হলো কিন্তু নাবিজান ও আলম কই? মামা সবাইকে একসাথে দাঁড়িয়ে থাকতে বলে ওদের খুঁজতে গেলেন। কোথাও খুঁজে না পেয়ে মাইকের কাছে গিয়ে জানালেন।

মাইকে ঘোষনা দিচ্ছে অনবরত। সবাই খুঁজতে শুরু করেছে। আমরাও মানুষের সাথে মিশে গিয়ে খুঁজছি। খুঁজতে নদীতে নেমেছে মানুষ। মেলার সকল শিশুকে আলাদা করা হযেছে। এর মধ্যে সন্ধ্যা পেরিযে রাত। হ্যাজাক-হ্যারিকেন ও জোস্নার আলোয় সবাই খুঁজছে। না, নাবিজান-আলম কোথাও নাই। বাড়িতে বাড়িতে খবর গেছে। বাড়ির সবাই মেলায় এসেছে। নুরজামাল আলীজান এসেছে। তাদের মাও এসেছে।

কিন্তু এদিকে আবার মেলা ভাঙ্গতে শুরু করেছে। লোকজন চলে যাচ্ছে। শুধু রাস্তায় দাঁড়িয়ে হাউমাউ করছে শিশু দুটির মা, বোন। মেলায় হ্যাজাকের আলোগুলো একে একে নিভে গেল। আমরা ফিরে আসছি বাড়িতে। নাবিজান ও আলমের মা-বোনকে জোর করে টেনে টেনে কেউ নিয়ে আসছে। তারা চিৎকার করে কাঁদছে। আমরা বাড়িতে এলাম। সারারাত্ পাশের ঘর থেকে থেমে থেমে কান্নার আওয়াজ। ছোট্ট বুকটায় অপরাধ বোধে ঘুমাতে পারলাম না।

পরদিন সকালে তিনটা মাইক ছাড়া হলো তিন গ্রামে। নদীতে নৌকা ছাড়া হলো। তিনদিন একইভাবে চললো। পাওয়া গেল না ওদের। ওরা হারিয়ে গেল।

তারপর থেকে আমার আর দশহরার মেলায় যাওয়া হয়নি। যেতে ইচ্ছে করেনি। কিন্তু বৈশাখ বরণের নানির আয়োজনগুলোতে আমি অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিলাম।

আমার নিজের আয়োজনে নববর্ষ পালনে আমি কখনও নতুন কাপড় পরি না। বছরের অন্য দিনগুলোর মতো ঘরে যা থাকে খাই। পান্তা খাওয়ার কথা মনে হয়, কিন্তু খাওয়া হয় শুধু স্মৃতিতে। অনেক অনুষ্ঠান থাকে। দাওয়াত নিমন্ত্রণ থাকে সারাদিন। ব্যস্ততা ভেদ করে বিকেলে নাবিজান-আলমের বৃদ্ধা মাকে একবার লুকিয়ে দেখতে যাই। যার চোখ দুটোতে ছানি পড়েছে কেঁদে কেঁদে। সন্ধার পর কোথাও ভাওয়াইয়া, কুশান গান, পালাগানের আসর বসলে আমার মন টানে। পুরোন দিনের গানের আসরে বসে ভুলে যেতে চেষ্টা করি পুরোন স্মৃতি। 

লেখক সাংবাদিক

 

শেয়ার করুন: