রিসোর্ট মানেই যখন উন্নয়ন

সুরঞ্জনা চৌধুরী: ঢাকার একদিকে গাজীপুর, শ্রীপুর, অন্যদিকে সাভার সয়লাব হয়ে যাচ্ছে রিসোর্টের পর রিসোর্টে। এগুলো উন্নয়ন। পাহাড় কেটে ধ্বংস করেও উন্নয়নের জোয়ার অব্যাহত আছে। উন্নয়নের নামে বিলিয়ন বিলিয়ন টাকা চলে যাচ্ছে টাঁকশাল থেকে। সামান্য রেল তৈরি করতেও কোটি টাকার বায়না, সামান্য রাস্তা পুননির্মাণেও কোটি টাকার নিচে কথা নেই।

Gazipur 2রিসোর্টগুলোর কথা বলছিলাম। বিত্তশালীরা সেখানে প্রমোদবিহার তৈরি করে চলেছেন নিজেদের মনোরঞ্জনের জন্যই শুধু নয়, সেইসাথে অন্যদের মনোরঞ্জনও করছেন টাকার বিনিময়ে। শোনা যায়, প্রতি সপ্তাহান্তে সেখানে মেয়েদের নিয়ে অবকাশ যাপনে যান অনেকে। দৌলতদিয়ার উন্নত সংস্করণ আর কী! অথবা আগেকার দিনে রাজা-বাদশারা যেমন উপপত্নী রাখতেন, তাদের নিয়ে প্রমোদ বিহারে যেতেন, অনেকটা সেরকমই।

আমাদের মতোন সাধারণ, অথচ কিছুটা অর্থকড়ি সম্পন্ন লোকজনও আজকাল ভ্রমণে যায়, গাছ-গাছালির নিচে থাকে, সুইমিং পুলের স্বচ্ছ জলে সাঁতার কেটে নিজেদের শ্যাওলা-ঢাকা পুকুরের কথা মনে করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে, আর মনে মনে জীবনের এই পরিবর্তনকে ধন্যবাদ দেয়, ভাবে, শরীরে তো এখন আর শ্যাওলার গন্ধ অন্তত নেই। সুইমিং কস্টিউম পরে জলে নেমে হাপুস-হুপুস করা ছবি দেন তারা ফেসবুকের পাতায়, নিজেদের আলাদা করে প্রকাশ করতে খুব বেশি পছন্দ করেন এই জাতীয় লোকজন। বৃহস্পতিবার হলেই ঢাকাতে তাদের আর মন টেকে না। এক কাপ চা খেতেও তারা আজকাল হবিগঞ্জ রিসোর্টে চলে যেতে পারেন।

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এতো এতো তরল টাকা কোথা থেকে আসলো? দেশটা কি সত্যিই উন্নত হয়ে গেল? নাকি দুর্নীতির মাত্রা বাড়লো? এসব লোকজনকে একটু খেয়াল করলে সহজেই আলাদাও করা যায়।

হালকা চালের কোনো পোস্ট দিন, রম্য করেন, ব্যস, তারাও আসবেন আপনার আসরে। দেশের কোনো সমস্যা নিয়ে কথা বলেন, নেই, তারা নেই কোথাও।

ছোটবেলায় যাদের নাক দিয়ে অনবরত সিকনি পড়তো, তারাই এখন বেশি করে এসব মায়াবী পরিবেশের মাঝে গিয়ে থেকে আসে, আর ফেসবুকে ছবি দিয়ে নিজেদের ‘বর্তমান’ আভিজাত্য বোঝানোর চেষ্টা করে। দেখুন, কী হলুম আমরা!

Gazipur 1কিন্তু একবারও তাদের মনে আসে না, এই যে রিসোর্টে তারা যাচ্ছেন, পানাহার করছেন, তা কিন্তু তৈরি হচ্ছে বিখ্যাত শালবন বিহার ধ্বংস করেই। একেকটি প্রমোদ কারখানার পিছনে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে পরিবেশ-প্রতিবেশ সব। পুরো ইকো সিস্টেমই ভেঙে পড়ছে।

এগুলো নাকি উন্নয়ন! তো, উন্নয়নের নামে শালবন এখন বিলুপ্ত প্রায়। আরও অনেক গাছপালা ছিল, সেইসবও নাই। উন্নয়ন মানেই প্রমোদ ভবন তৈরি, সিলেট জুড়েও তা হচ্ছে। বিদেশিরা এলে তাদের নিয়ে সেখানে কনফারেন্স হয়, তারাও মুগ্ধ হয়ে যায় প্রকৃতি দেখে। আহ, বাংলাদেশ কত সুন্দর! সার্টিফিকেট পেয়ে যাই আমরা। ভাববেন না, এটা পর্যটন। পর্যটনের বিকাশ এতে হয় না।

তিন পার্বত্য জেলাতেও চলছে একইরকম উন্নয়ন। পাহাড়িদের উচ্ছেদ করে প্রথমে সেটেলারদের বসিয়ে এখন সরাসরিই কারও কারও হস্তক্ষেপে সেখানে এসব উন্নয়ন চলছে।

সামনে আসছে সুন্দরবন। এই বন আর বাকি থাকে কেন? এখানেও তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রটা হয়ে গেলেই লোকসমাগম বাড়বে, গড়ে উঠবে সুন্দরবন রিসোর্ট। মানুষ পৃথিবীখ্যাত ম্যানগ্রোভের ছবি দেখবে বইতে, আর রিসোর্টে বসে আনন্দ-বিনোদন করে আসবে। এই তো উন্নয়নের ধারা? চলুক।

অথচ দেশ ছেয়ে যাচ্ছে তরুণ প্রজন্মে। সবচেয়ে শক্তিশালী হতে পারে আমাদের অর্থনীতি এই প্রজন্মকে কাজে লাগিয়েই। একজন মানুষ মানেই দুটি হাত, হাত মানেই কাজ। একটু চিন্তাভাবনা করে এই প্রজন্মকে কাজে লাগিয়ে অর্থনীতিকে অনায়াসে ঢেলে সাজানো যেত। তাহলে মালয়েশিয়ার চেয়েও উন্নত হতে পারতো আমাদের এই দেশটা। কিন্তু কে ভাবে সেকথা? এইদেশে ব্যক্তিস্বার্থের বাইরে কোনো ভাবনা আছে কি?

আমরা যতোই চিৎকার করি না কেন, দিনশেষে আমরা আলুপোড়া খাওয়া জনগণই। বন-বনাঞ্চল, পরিবেশ-প্রতিবেশ, আদিবাসী, সংখ্যালঘু ধ্বংস করে এইদেশ টিকে থাকবে পৃথিবীর বুকে এক ভয়াবহ রকমের দীর্ঘশ্বাস হয়ে।

 

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.