প্রিয়দর্শিনী অভি: আমার বন্ধু সোমা। ভাল নাম মাহফুজা রহমান। স্কুলে আমার খুব হাতে গোনা কিছু মেয়ের সাথে সখ্যতা ছিল। তাদের মধ্যে সে ছিল অন্যতম। আমরা ক্লাস সিক্স থেকে টেন পর্যন্ত একসাথে পড়েছি। প্রাইভেটও পড়তাম দুজন একই টিচারের কাছে। পরবর্তীতে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন এ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজে ভর্তি হই আর ও ভর্তি হয় রসায়ন বিভাগে। ভীষণ মেধাবী ছিল ও। আমার সেই মেধাবী বন্ধুটির ফার্স্ট ইয়ারে পড়া অবস্থায় হঠাৎ বিয়ে হয়ে গেল। পাত্র প্রবাসী। বিয়ের পর ওকে দেশের বাইরে নিয়ে যাবে। ওর বাবা- মা’র হয়তো মনে হয়েছিল এতো ভাল পাত্র হাত ছাড়া করলে ওর আর কোনদিনও বিয়ে হবে না।
অত:পর অন্যান্য আর দশটা সাধারণ মেয়ের মতোই সতের না পেরুতেই ওর মধ্যবয়সী এক লোকের সাথে বিয়ে হয়ে গেল। যথারীতি বিয়ের এক বছরের মধ্যেই এক সন্তানের মা। কিন্তু সোমা তো হার মানাদের দলে ছিল না। তাই সে প্রবাসে গিয়ে আবার নতুন করে পড়ালেখা শুরু করলো। নার্সিং এর উপর চার বছরের কোর্স শেষ করে সে নিউইয়র্কের বেলভিউ হাসপাতালে নার্স হিসেবে চাকরি নিল। আমার সেই বন্ধু হঠাৎ করে নিখোঁজ। তাকে এই বিশ্ব চরাঞ্চলের কোথাও আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তার স্বামীর ক্রমাগত সবার কাছে মিথ্যে বলা, পালিয়ে বেড়ানো থেকে সহজেই অনুমেয় যে এই নিখোঁজ হওয়ার পেছনে অনেক বড় কোন সত্যি লুকিয়ে আছে। যে সত্যি অনেক বেশি ভয়াবহ এবং অনেক বেশি নির্মম।
নিউইয়র্কের পুলিশ দাবি করেছে যে, সোমা নিখোঁজ হওয়ার দুইদিন পর নাকি তার স্বামী লাশ কাটার যন্ত্র কিনেছে। ওদের বাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে পুলিশ সেই রশিদ উদ্ধার করেছে।
এই ঘটনাটা পনের দিন আগের। এখনো সোমা নিখোঁজ এবং তার স্বামী পলাতক । পত্রিকায় দুইদিন লেখালেখি হলেও এখন সবকিছুই শেষ। পত্রিকাওয়ালাদেরই বা কী দোষ! প্রতিদিন যে পরিমাণ মেয়ে ধর্ষিত বা খুন হচ্ছে. তাতে কি তাদের সময় আছে একজনকে নিয়ে দুইদিনের বেশি মাতামাতি করার?
ঘটনা ২
কুমিল্লা সেনানীবাসের ভেতরে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের ছাত্রীকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে। মেয়েটির নাম সোহাগী। অনেক সোহাগ করেই হয়তো বাবা- মা এই নামটি রেখেছিলেন। ইতিহাস বিভাগে অনার্সের ছাত্রী। মেয়েটিকে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনিনা। তবে পত্রিকায় তার ঐ চাপা হাসির ছবিটা আজকে সারাদিন আমার চোখে ভাসলো। সেনানিবাসের ভেতরে আমাদের মেয়েরা ধর্ষিত হচ্ছে, খুন হচ্ছে আর আমরা নির্লিপ্ত থাকছি। কিভাবে সম্ভব?
পহেলা বৈশাখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন হয়রানির ঘটনায় অনেকে মেয়েদের পোশাক (শাড়ি!) এর দোষ ধরেছেন। কিন্তু এই মেয়েতো রীতিমতো হিজাব করে, তবে সে কেন ধর্ষিত হলো? মেয়েরা, তোমরা এই দফায় ভাল করে দেখে রাখো, হিজাব কিন্তু তোমাদের সম্মান বাঁচাবে না, তোমাদেরকে নিরাপত্তা দিবে না।
অনার্সের একটা কোর্সে পড়েছিলাম, কোন দেশের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নতি বোঝা যায় সেই দেশের মেয়েদের দেখে। আমরা দাবীতো করি, বাংলাদেশ উন্নয়নের জোয়ারে ভাসছে কিন্তু পত্রিকা খুলে দেশের মেয়েদের অবস্থা দেখলে সেই উন্নয়নের জোয়ার তো দূরে থাক তার আর কোন চিহ্ন খুঁজে পাওয়া ভার। মূলত বিচারহীনতা আমাদেরকে আশ্বস্ত করছে নির্বিঘ্নে অপরাধ করার জন্য। আমরা এখন কারো চোখ উপড়ে নিতে ভয় পাইনা, কারো হাত পা’র রগ কেটে দিতে আমাদের একটুকুও খারাপ লাগেনা, খুন করতে হাত কাঁপেনা। আর ধর্ষণ? সেটাতো বিনোদন।
তোমরা যারা তাসকিন বা সানির জন্য কেঁদে বুক ভাসাচ্ছো, ক্রিকেটের নামে দেশপ্রেম উজাড় করে দিচ্ছো তারা একটিবার ঐ মেয়েটার কথা চিন্তা কর যে কিনা এরকম পাশবিক নির্যাতনের স্বীকার হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে। একটাবার আমার বন্ধু সোমার পাশে দাঁড়াও যার লাশটা পর্যন্ত স্বামী কেটে টুকরো টুকরো করেছে। মরার সময় বেচারী হয়তো এক ফোঁটা পানির জন্য ছটফট করেছে। আর নয়তো বা সেই সুযোগটাও পায়নি। ইদানীং নিজেকে একজন উন্নয়ন কর্মী হিসেবে পরিচয় দিতে লজ্জা লাগে। মনে হয় আমি কি সব উন্নয়নের কথা বলি কিংবা নারী ক্ষমতায়নের স্বপ্ন দেখি যে কিনা এত নৃশংসতার পরেও নির্লিপ্ত থাকি।
তোমরা ছেলেরা, আজকে যারা এসব নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছো না, রুখে দাঁড়াচ্ছো না, তৈরি থেকো রাক্ষসের করাল গ্রাস থেকে কিন্তু তোমাদেরও নিস্তার নেই। তোমরাও এর ভয়ঙ্কর থাবা থেকে রেহাই পাবে না। যখন তোমাদের মায়েদের পুড়িয়ে মারা হবে, বোনেরা নিখোঁজ হবে, কন্যার লাশ কাঁধে বয়ে বেড়াতে হবে, সেইদিন কিন্তু তোমাদের পাশে দাঁড়ানোর মতো আর কেউ থাকবে না। তোমাদের কান্না আর কাউকে ছোঁবে না সেদিন।