দীপ জ্বেলে গেলো যারা

শামীম রুনা: নারী স্বাধীনতা বা নারী মুক্তি বিষয়টি মানে এই নয় যে নারী অর্থ উপার্জন করছে বা ঘর থেকে বের হয়ে হিল্লী-দিল্লী করছে। নারী স্বাধীনতা মানে এই নয় যে বছরের একটি দিন নারী দিবস হিসাবে পালন করা।

নারী স্বাধীনতা বা নারী মুক্তি শব্দটির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত রয়েছে শিক্ষা, জ্ঞানচর্চা, মূল্যবোধ, আদর্শ, অন্ধ ধর্মীয় বিশ্বাসের পশ্চাদমুখিতা থেকে মুক্তি, বিশ্বাসের যৌক্তিকতা, নিজের মতামত,অধিকার সচেতনতা, আস্থা-ইচ্ছা-অনিচ্ছার প্রতি শ্রদ্ধাবোধসহ নানাবিধ বিষয়।

PicMonkey Collageআর এই অর্জনের জন্য প্রয়োজন কাজ করা এবং নারীর নিজের পথ নিজে তৈরি করা।

‘পাছে লোকে কিছু বলে’ সে ভয়ে ঘরে পর্দা টাঙিয়ে বসে থাকলে নারী স্বাধীনতা বা মুক্তি আসবে না। সমাজে জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিশাল বিশাল সব জ্ঞান চর্চা করবে পুরুষরা-শৈশব থেকে নারীদের এটি জানিয়ে দেওয়া হয়, নতুন নতুন ভাবনা পুরুষরাই করে থাকে; সমাজের ভালো-মন্দ দেখার দায়িত্ব পুরুষদের, সমাজ বদলানোর দায়িত্ব পুরুষদের-এটি যেন পুরুষদের লিঙ্গভিত্তিক এক চেটিয়া অধিকার। নারীরা পুরুষের এই দেখিয়ে দেওয়া পথে হেঁটে যাবে। নারীকে জ্ঞান নিয়ে না ভাবলেও চলবে, সমাজ পাল্টনো নারীর কম্মো নয়, নারীর জন্য বাধা কাজ তো রয়েছেই-অন্দর মহলে।

তারপরও প্রচলিত এইসব ভাবনা থেকে, যুগে যুগে বিভিন্ন সাহসী নারীকে আমরা বেরিয়ে আসতে দেখেছি। তাঁরা সমাজকে বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখিয়ে নিজেদের তৈরি করা পথে হেঁটেছে। পশ্চাদপদতার পিচ্ছিল কাদা থেকে পা উঠিয়ে এসেছেন আলোর পথে। আপোষ করেননি অন্যায়ের কাছে, নিজের ওপর আস্থা রেখেছেন এবং আদর্শের যুক্তিতে স্থির থেকেছেন। মানবিকতা আর মুক্তভাবনাকে স্বাগত জানিয়ে সমাজ পাল্টে দিয়েছেন আপন মশালের আলোয়। আবার এমনও অনেক নারী ছিলেন বা রয়েছেন, তাঁরা হয়ত যুদ্ধটা শেষ পর্যন্ত করে যেতে পারেন নাই। হার মেনেছেন সমাজের প্রচলিত মূল্যবোধ বা বিরুদ্ধ শক্তির কাছে।

আমরা জয়ীদের অনুকরণীয় হিসাবে দেখি, তেমনি কয়েকজন সাহসী সারথীর কথা আজ  বলি:

Rokeyaবেগম রোকেয়া: ‘সুলতানার স্বপ্ন’র মধ্য দিয়ে বেগম রোকেয়া শাখাওয়াত হোসেন বাঙালি মুসলিম নারীদের চোখে যে স্বপ্ন এঁকে দিয়েছিলেন, সে স্বপ্ন আজও আমাদের নারীদের স্বপ্ন দেখায়। তাঁর পাঁচজন ছাত্রী নিয়ে গড়ে তোলা স্কুল আজ কোটি কোটি নারীর স্কুলে পরিণত হয়েছে। তাঁর সম্পর্কে তো বেশি কথা বলার প্রয়োজন নেই, শুধু তাঁর তৈরি করা শিক্ষার পথে দৃষ্টি উন্মুক্ত রেখে চলার প্রত্যয়টুকু রাখতে চাই। আমাদের দৃষ্টির উন্মুক্ততার সাথে সাথে আমাদের বিবেক-বুদ্ধিও যেন জেগে থাকে।

Sufia Kamalসুফিয়া কামাল: ১৯১১ সালের ২০ জুন বরিশালে জন্ম নেন এই কবি, সাহিত্যিক ও মানবাধিকার কর্মী ও রাজনীতিক। পঞ্চাশ এবং ষাটের দশকে বাঙালী জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে প্রভাবশালী সাংস্কৃতিক আইকন ছিলেন তিনি। ১৯৪৭ সালে যখন সাপ্তাহিক বেগম পত্রিকা প্রথম প্রকাশিত হয়, তিনি ছিলেন এর প্রথম সম্পাদক। ১৯৪৭ এ দেশভাগের পর তিনি ঢাকায় ফেরত আসেন কলকাতা থেকে। এর পরের বছর যখন পূর্ব পাকিস্তান মহিলা কমিটি গঠন করা হয়, সুফিয়া কামাল এর চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, ১৯৬১ সালে যখন পাকিস্তান সরকার রবীন্দ্র সঙ্গীত নিষিদ্ধ করে, তিনি সেই আন্দোলনের সাথে ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত হন। ঊনসত্তরে গণঅভ্যুত্থানের সময় তাঁর বলিষ্ঠ ভূমিকা প্রাত:স্মরণীয়। একাত্তরে দেশ স্বাধীনের পরও সুশীল সমাজের গুরুত্বপূর্ণ নেতা ছিলেন। পরবর্তীতে তিনি বাংলাদেশের নারী সংগঠন মহিলা পরিষদের নেতৃত্ব দেন বহু বছর। এর মাঝে গড়ে তোলেন মহিলা সংগ্রাম পরিষদ। ১৯৯৯ সালের ২০ নভেম্বর মারা যান এই বিদূষী নেত্রী।

Pritilataপ্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার: ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রথম বিপ্লবী নারী শহীদ প্রীতিলতা বাংলাদেশের চট্টগ্রামের মেয়ে। বিপ্লবী নেতা মাস্টারদা সূর্যসেনের নেতৃত্বে তিনি স্বাধীনতা আন্দোলনে নির্ভীক চিত্তে বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে অংশ নিয়েছিলেন।পড়াশুনায় অসম্ভব মেধাবী প্রীতিলতা স্কুল জীবন থেকে বিপ্লবের প্রতি আকৃষ্ট ছিলের এবং ইডেন কলেজে আইএ পড়ার সময় নিজেকে বিপ্লবের জন্য প্রস্তুত করে নিয়েছিলেন। ১৯৩২ সালে চট্টগ্রাম পাহাড়তলীতে ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণ করা হয়েছিল প্রীতিলতার নেতৃত্বে। সফল আক্রমণ শেষে গুলিতে আহত প্রীতিলতা সায়ানাইড খেয়ে আত্মহত্যা করেন, তবু ধরা দেননি শত্রুপক্ষের হাতে। প্রীতিলতার মৃত্যুতে তাঁর মা যেমন গর্ব করে বলতেন, ‘আমার মেয়ে দেশের জন্য প্রাণ দিয়েছে’, তেমনি আমরাও পরবর্তীতে দেখতে পাই, তাঁর রেখে যাওয়া গর্বিত পথে অনেক অকুতোভয় বিপ্লবী নারীকে হেঁটে যেতে।

Ila Mitraইলা মিত্র: অবিভক্ত দুই বাংলার সংগ্রামী কমিউনিস্ট নেত্রী এবং কমিউনিস্ট আন্দোলনের পুরোধা ইলা মিত্র। তিনি হয়তো ক্রীড়াবিদ, জমিদার বধু, আরও চাইকি “রাণীমা” হয়ে সমাজসেবা করে নিজের জীবনটা কাটিয়ে দিতে পারতেন। কিন্তু তা তিনি করেননি। নিজেকে জড়িয়ে নিয়েছিলেন লাঞ্ছিত, নিপীড়িত দরিদ্র কৃষকের সাথে, সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর সাথে। হয়ে উঠেন তেভাগা আন্দোলনের পুরোধা। অমানবিক পুলিশি টর্চার সহ্য করেছেন, নিজের আদর্শে অটুট থেকেছেন, ঝুকেঁননি অন্যায়ের সামনে। তাঁর রাজনৈতিক জীবন,দর্শন,আদর্শ,ত্যাগ,কষ্ট সহিষ্ণুতা নারী পুরুষ সব মানুষের জন্যই অনুকরণীয় এবং আমাদের বাঙালি নারীদের জন্য গর্ব এবং অহঙ্কারের।

কিশোরী ইলা মিত্র ছিলেন তুখোড় খেলোয়াড়। ছিলেন জুনিয়র অ্যাথলেটিক চ্যাম্পিয়ন এবং তিনিই প্রথম বাঙালি নারী, যিনি অলিম্পিকের জন্য নির্বাচিত হন। পরে অবশ্য দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের কারণে অলিম্পিক অনুষ্ঠিত না হওয়ায় তাঁর অংশগ্রহণ করা হয়ে ওঠেনি। ইলা মিত্র সারা জীবন নিজের আদর্শে থেকেছেন, লড়াই করেছেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে। ১৯৭১ এর স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তিনি বাংলাদেশের পরম বন্ধু হয়ে কাজ করে গেছেন।Noorjahan

নূরজাহান বেগম: ‘বেগম’ পত্রিকার সম্পাদক নূরজাহান বেগম বাংলাদেশের নারী সাংবাদিকতায় অগ্রজন। তিনি নারীদের সামনে শুধু সাংবাদিকতাকে পেশা হিসাবেই উন্মুক্ত করেননি, বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠিত অনেক নারী লেখক কবি প্রথম ‘বেগম’ পত্রিকায় লিখে নিজের ভেতরে সুপ্ত প্রতিভার আঁচ খুঁজে পেয়েছিলেন। নূরজাহান বেগমের পথ অনুসরণ করে বা তাঁর পত্রিকায় লিখে অনেক নারী কবি, লেখক বা সম্পাদক হয়ে উঠেছেন।  

Jahanara Imamজাহানারা ইমাম: বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলন বা স্বাধীনতার যুদ্ধে অসংখ্য নারী রেখেছেন তাদের সাহসী ভূমিকা। সেইসব নারী যোদ্ধাদের জন্য শ্রদ্ধা। জাহানারা ইমাম স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য যে অবদান রেখেছেন, সেজন্য তাঁকে ‘শহীদ জননী’ বলা হয়। একাত্তরে নিজের সন্তান রুমীকে স্বাধীনতার উদ্দেশ্যে কুরবান করে তিনি এই উপাধি পান যুদ্ধ ফেরত অন্যান্য গেরিলা যোদ্ধাদের কাছ থেকে।

তাঁর লেখা ‘একাত্তরের দিনগুলি’তে আমরা স্বাধীনতার গেরিলা যোদ্ধা রুমী, আজাদসহ আরো অনেক সম্পর্কে জানতে পারি। যুদ্ধের মাঠে না যেয়েও স্বাধীনতা যুদ্ধের তিনি ছিলেন একজন সৈনিক। জাহানারা ইমাম যুদ্ধে শুধু ছেলে রুমীকেই হারাননি, হারিয়ে ছিলেন পুত্র শোকে স্তব্ধ পিতা, তাঁর স্বামী শরীফ ইমামকেও।

পরবর্তী জীবনে জাহানারা ইমাম শোককে শক্তিতে পরিণত করেন এবং ১৯৯২ সালে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি গঠন করেন।‘গণআদালত’ এর মাধ্যমে, ১২ জন বিচারকের বিচারে গোলাম আযমের ১০টি সুনির্দ্দিষ্ট অপরাধের বিচার করা হয় এবং প্রতিটি অপরাধের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড যোগ্য অপরাধ বলে ঘোষণা করা হয়। গোলাম আযমের ফাঁসি কার্যকর করবার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানানো হলে সে সময়ের বিএনপি সরকার জাহানারা ইমামসহ চব্বিশজন বিশিষ্ট নাগরিকের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা করে। তারপরও তিনি দমে জাননি, হাইকোর্ট থেকে জামিন নিয়ে তিনি একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির কাজ চালিয়ে যেতে থাকেন। তাঁর নেতৃত্বে সারা দেশে গণস্বাক্ষর, গণসমাবেশ, মানববন্ধনসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করা হয়। এইসব আন্দোলনের কারণে তাঁকে পুলিশের লাঠিপেটাও খেতে হয়, শহীদ জননীর এই অপমান আমাদের জন্য জাতিগতভাবে খুবই লজ্জাজনক ছিল। তাঁর মুখে ১৯৮২ সাল থেকে ক্যান্সার বাসা বেঁধে ছিল এবং এই সময়টাতে অসুখ বেশ বেড়ে গেলে ১৯৯৪ সালের ২ এপ্রিল তিনি চিকিৎসার জন্য আবার আমেরিকা ফিরে যান এবং ২৬ জুন মারা যান।

জাহানারা ইমাম জীবিত থাকাকালীন একাত্তরের ঘাতক দালালদের বিচার করা হয়নি, কিন্তু বিচারের যে বীজ তিনি রোপন করে গিয়েছিলেন, তারই প্রতিফলন আমরা বর্তমানে যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তি কার্যকরের মধ্য দিয়ে দেখতে পাই। সরকারী বাধা, শারীরিক প্রতিকূলতাকে তুচ্ছ করে আদর্শের জন্য তিনি লড়ে গেছেন। তিরিশ লক্ষ শহীদের রক্তের মর্যাদা দেবার জন্য লড়ে গেছেন। দুই লক্ষ নারীকে তাদের দু:স্বপ্ন থেকে জাগিয়ে তোলার জন্য লড়াই করে গেছেন।

Ferdousi apaফেরদৌসী প্রিয়ভাষিনী: তাঁর কথা বললে বলতে হয় আপাদমস্তক তিনি একজন ভাস্কর। খুব সাধারণ জিনিস দিয়ে তিনি যেমন অসাধারণ ভাষ্কর্য নির্মাণ করেন, তেমনি জীবনের ক্ষতকে পদ্মে রূপান্তরিতও তিনি নিজেও করেছেন। একাত্তরে পাকিস্তানী বাহিনীর হাতে নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়েও, জীবনের দু:স্বপ্নকে মিথ্যার প্রলেপে না ঢেকে তা বরং মেনে নিয়ে অসম্ভব দৃঢ়তায় নিজ পথে হেঁটে চলার প্রতিকৃতি ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিনী। তিনি নারীদের মাথা উঁচু করে বাঁচার প্রেরণা জুগিয়েছেন, এবং জুগিয়ে যাবেন যুগে যুগে। তাঁর উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব আর জীবনকে ভালবাসার প্রবল স্পৃহা দিয়ে নারীদের জন্য আদর্শ হয়ে থাকবেন চিরকাল। স্বাধীনতার প্রতিটি ক্ষণে ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিনীসহ সকল বীরাঙ্গনাকে বাংলাদেশ আজীবন স্মরণ করবে সশ্রদ্ধায়।

Taslima Nasrinতসলিমা নাসরিন: তসলিমা নাসরিন আমাদের দেশের অনেকের ভাষায় বিতর্কিত কবি, গল্পকার, সাহিত্যিক, কলামিস্ট। ডাক্তার হয়েও তিনি ছুরি-কাঁচির পরিবর্তে হাতে তুলে নিয়েছেন কলম। তিনি কী লিখেন বা লিখেন না তার চেয়ে বড়ো কথা তিনি নারীদের জন্য লিখেন। এজন্য তাঁকে ফেমিনিস্ট বলা হয়ে থাকে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের দৈন্যগুলো, নারী নিপীড়ন, শোষণ-বঞ্চনার বিষয়গুলো তার লেখনীতে নির্বিকারভাবে উঠে আসায়, বিশেষ করে ধর্মীয় মৌলবাদের বিরুদ্ধে লিখতে গিয়ে তিনি রোষানলে পড়েন। তাঁকে বের করে দেয়া হয় দেশ থেকে।

যে কথা নারী মুখ ফুটে বলার সাহস করেনি আজীবন অকপটে সে কথা লিখে তসলিমা হয়েছেন বিতর্কিত। তসলিমার গদ্য-পদ্য অনেকের ভাল লাগে অনেকের ভাল লাগে না, আমি সেসব বিষয় নিয়ে লিখছি না। আমি লিখছি; তসলিমা নাসরিন (হয়ত) বাংলা সাহিত্যে প্রথম নারী লেখক যে অসংকোচে নারী মনের ইচ্ছা, নারীদেহ, নারীর অভীপ্সা, নারীর যৌনতা, নারীর স্বাধীনতা, নারীর প্রতি বৈষম্য, ধর্মীয় অনুশাসনের নামে অবরুদ্ধ নারী ইত্যাদি বিষয়ে লিখেছেন।

অন্যের মুখাপেক্ষী হয়ে না বেঁচে বরং নারীর নিজেকে শ্রদ্ধা করতে শেখার কথা বলেছেন। এতে করে অনেক নারীর ভ্রু কুঁচকে উঠলেও উঠতে পারে, কিন্তু সবচেয়ে বেশি আঁতে ঘা লেগেছে  মৌলবাদী আর ধর্মান্ধ পুরুষদের। কেন?

কারণ নারী নিজ অধিকার নিয়ে কথা বলতে শিখবে বলে। হয়েছেও তাই, যে নারী নিজের পিরিয়ড নিয়েও কথা বলতে লজ্জা পেত, সে নারী এখন অর্গাজম নিয়ে কথা বলতে পারে। শরীরের সুখ নিয়ে কথা বলতে চায়, নিজের অধিকার বোধ নিয়ে কথা বলতে চায়, সে ধর্মে হোক কী সমাজে হোক কিংবা পরিবারে। আর তসলিমার পক্ষে-বিপক্ষে কথা বলতে বলতে নারীরা কিন্তু নিজেদের মুখের আগলই ভাঙছে।

তসলিমা নাসরিনের ধারাকে অনুসরণ করে বর্তমানে বাংলার অনেক আধুনিক নারী সাহিত্যকে ফুল-পাতায় আঁটকে না রেখে নিজেদের কণ্ঠ হিসাবে ব্যবহার করছে-নারীদের এই সোচ্চার কণ্ঠের জন্য, নারীদের উত্থানের জন্য তসলিমার অবদান অনস্বীকার্য। আর আগলভাঙা নারীদের জোয়ার মানেই তো নারী স্বাধীনতা! এই আগল ভাঙা নারীকে, মুক্ত বাকসম্পন্ন নারীকে আমরা স্বাগত জানাই।

Bonya 2বন্যা আহমেদ: বন্যা আহমেদ সম্পূর্ণ অন্য রকম এক প্রেক্ষাপটে, নীরবে কাজ করছেন। তিনি কাজ করছেন মৌলবাদের বিরুদ্ধে, মানবতার পক্ষে। তিনি একজন লেখক এবং ব্লগারও (তাঁর মতে ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর শখ)। সারা বিশ্ব তথা আমাদের দেশেও জঙ্গিবাদের, মৌলবাদের, সম্রাজ্যবাদের আগ্রাসন এবং নাস্তিকতা আর আস্তিকতার ধোঁয়া তুলে বিশ্ব জুড়ে যে চলমান সহিংসতা চলছে, তার জন্য গত ২০১৫’ র ফেব্রুয়ারিতে নৃশংসভাবে প্রাণ হারাতে হয় মুক্তমনা লেখক ড.অভিজিৎ রায়কে।

আর সে সময় তাঁর সঙ্গে থাকা স্ত্রী বন্যা আহমেদও গুরুতরভাবে আহত হন। শাহবাগ আন্দোলনের সাথে যুক্ত, আধুনিক বিজ্ঞান, ধর্মীয় কুসংস্কার, দর্শন বা যুক্তিবিদ্যাসহ বিভিন্ন বিষয়ে বিভিন্ন ব্লগে যারা লিখেন তাদের প্রতি মৌলবাদীদের আক্রোশ-আক্রমণ, সরকারের দমননীতি, গ্রেফতারি পরোয়ানা ইত্যাদি কারণে প্রাণ বাঁচাতে লুকিয়ে থাকা ব্লগারদের নিরাপত্তার ব্যাপারে ড.অভিজিৎ রায় কাজ করছিলেন। তাঁর এইসব কাজ আর বিজ্ঞান সম্মত,যুক্তিবাদী সচেতন লেখালেখির কারণে তাঁকে মৌলবাদীদের চাপাতির নিচে পড়তে হয়।

তাঁর মৃত্যুর পর বন্যা আহমেদ ড. অভিজিৎ রায়ের রেখে যাওয়া কাজগুলোকে এগিয়ে নেওয়া, চাপাতিওয়ালাদের চাপাতির হুমকি পাওয়া ব্লগার, রাইটার, পাবলিশার বা অন্য যারা আছেন তাদের পুনর্বাসন এবং নিরাপত্তা সর্বোপরি মানবাধিকারের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। তিনি বাংলা ভাষায় ‘মুক্তান্বেষা’ নামে একটি অনলাইন ডিজিটাল জ্ঞানকোষ করার উদ্যোগ নিয়েছেন। যেটি আগামী ১লা মে থেকে উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে।

তাঁর এই ত্যাগ, সাহসী উদ্যোগ নি:সন্দেহে অনেক মুক্তমনা শুভবুদ্ধির মানুষের জীবনকে নিরাপদ করবে এবং মানুষের মৌলিক ও সৃজনশীল কাজকে উৎসাহিত করবে।

শুধু বন্যা আহমেদ নয়, মৌলবাদীদের চাপাতির কোপ থেকে ব্লগার তথা মুক্তচিন্তার, আধুনিক ভাবনার মানুষদের বাঁচাতে আরও অনেক সাহসী নারী দেশ-বিদেশ থেকে নীরবে এবং আন্তরিকতার সাথে কাজ করে যাচ্ছেন। তাদের এগিয়ে চলার এইসব সাহসী-প্রয়াসী পদক্ষেপ অবশ্যই নতুন পথ তৈরি করবে মানুষের কল্যাণের জন্য, মানবতার কল্যাণের জন্য।

মানুষকে সমাজের অন্ধবিশ্বাস থেকে মুক্ত করবার জন্য, অধিকারবোধ জাগ্রত করবার জন্য, নারীর নিজের ওপর বিশ্বাস রাখবার জন্য যুগে যুগে অসংখ্য নারী নীরবে, কী সরবে আপোষহীন কাজ করে গেছেন। কতজনের নাম বলা যায়?

বিবি রাসেল, তিনি আধুনিক নারীকে স্বপ্ন দেখিয়েছেন সুপার মডেল হয়ে বিশ্ব জয় করবার! বাংলা চলচ্চিত্রের প্রথম যুগে, কনজারভেটিব সমাজের উচ্চ শিক্ষিতা নারী ড. রওশনারা অভিনয় করে নারীদের জন্য রূপালী জগতের দুয়ার খুলে দিয়েছিলেন। সে ধারাবাহিকতায় আমরা শবনম, কবরী থেকে শুরু করে হাল সময়ের জয়া আহ্সান, অপু বিশ্বাসদের পেয়েছি।

খেলার প্রসঙ্গ আসলে, এক সময় আমাদের রাণী হামিদ ছিলেন। এখন আমাদের আছে মাবিয়া আকতার সীমান্ত, মাহ্ফুজা খাতুন শীলার মতো সোনাজয়ী নারীরা। ক্রিকেটে সালমারা যে পথ তৈরি করছেন, তা এক সময় নিশ্চয় এই দেশের নারীদের ক্রিকেটে বিশ্বকাপ জেতাবে।

নিশাত মজুমদার বা ওয়াসফিয়া নাজরীন পৃথিবীর এডভেঞ্চার প্রিয় সকল নারীর আইডল আর আমাদের দেশের নারীর গর্ব। বিশেষ করে ওয়াসফিয়ার সাত মহাদেশের সাতটি সুউচ্চ পর্বত জয় বিশ্বের মানচিত্রে বাংলাদেশকে নতুন করে তুলে ধরেছে।

আমাদের পুরুষ শাসিত সমাজ ব্যবস্থায়, রাস্তায় নারী মাত্রই যেখানে দর্শনীয় বস্তু; সেই রাস্তায় নারীরা এখন মোটর সাইকেল চালাচ্ছে দাপটের সাথে, তারাও সমাজ বদলে দিচ্ছে। তারাও অনেক নারীর পথ প্রদর্শক হয়ে উঠছে নিজ ব্যক্তিত্বে। এছাড়া সারা দেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে অসংখ্য নারী সমাজসেবী, নারী উদ্যোক্তাসহ বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত নারীরা-যারা নিজ নিজ কর্মে শুধু নারী নয়, মানুষের সম্ভাবনার পথকে প্রসারিত করে চলেছেন। যে মা মাটি কেটে সন্তানকে ডাক্তারি পড়াচ্ছেন, সেই মা কোনদিক দিয়ে কম? হাজারও মায়ের অনুপ্রেরণা তিনি আজ।

কর্পোরেট জগতেও নারীর কর্ম-দক্ষতার ওপর আস্থা রাখছে হাজার মানুষ। নারীদের এগিয়ে চলার কথা বললে আমাদের দেশের সরকারি ও বিরোধী দলের দুই নেত্রীর কথা না বললেই নয়। তাঁদের শাসন ব্যবস্থা বা দেশ চালানোর রীতিনীতি কারো পছন্দ হলো কী হলো না তা এখানে মুখ্য নয়, মুখ্য হলো তাঁরা আমাদের রাজনীতির চালিকা শক্তি হয়ে নারীর ক্ষমতার জয়ধ্বনি করছেন।

এই যে পথ তৈরি করা, প্রথম যারা পথ তৈরি করেছেন, তাদের চলার পথ কখনই সহজ-সরল ছিল না, ছিল বন্ধুর। তাঁদের সামনে গতানুগতিক সমাজ ব্যবস্থা, রক্ষণশীল সমাজের প্রাচীনপন্থা, নতুন যুক্তি অবজ্ঞা, অন্ধ ধর্মীয় কুসংস্কার বরাবরই চোখ রাঙিয়ে দাঁড়িয়েছে। মানুষ সহজে নতুন কিছু গ্রহণ করতে চায় না, তাই শোর তুলেছে, ‘জাত গেল জাত গেল’ বলে। কিন্তু তাঁরা পিছপা হোননি। আর হোননি বলেই আজ আমার দেশের নারী মহাকাশ জয়ের জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন।  

 

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.