কাকলী তালুকদার: আমি যেন কোনদিন অসাধারণ হতে চেষ্টা না করি তার জন্য আমার নিজস্ব একটি কাঠগড়া আছে। যখনই আমার মন অসাধারণ হওয়ার প্রতিযোগিতায় কখনও লোভ করেছে আমি নিজের মন কে কানে ধরে নিজের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দেই। আমি আমার ভিতরের দুটি সত্ত্বাকে মুখোমুখি করে দেই। আমার বিবেককে বিচারক হিসেবে দায়িত্ব দেই। তার উপর আমার পূর্ণ ভরসা আছে।
আমার অনেক খারাপ দিক আছে তবে এই কাঠগড়াটি আমাকে ওইসব অন্যায় থেকে বিরত করতে বাধ্য করে। নয়তো যে শাস্তি আমার বিবেক আমাকে দেয়, সেই শাস্তি আমি সহ্য করতে পারি না।
“অনুশোচনা” একটি অসাধারণ শাস্তি। আমার মতো সাধারণ মানুষের এর চেয়ে বড় শাস্তি আর কিছুই নেই।
প্রতিদিন আমি শিখছি, আমার ইন্দ্রিয়গুলো আমাকে বাধ্য করে শিখতে। আমি তাদের কাছে নিরুপায়। উপায় নাই বলেই আমাকে শিখতে হয় প্রতিদিন। আর এই ইন্দ্রিয়গুলোই আমাকে দেখিয়ে দেয় আমার চারপাশের মানুষজন আমার কাছে কী চায়? আর আমি নিজেও নিজের কাছে কী চাই?
ছোটবেলা থেকেই আমার ইন্দ্রিয়গুলো আমার পরম বন্ধু। সেই সাথে আমার চারপাশের প্রতিটি মানুষসহ প্রকৃতির প্রতিটি সৃষ্টি আমার শিক্ষক।
মা-বাবা ছাড়া হাতে গোনা যে কয়জন মানুষ আমাকে ভালবেসেছে, স্নেহ দিয়েছে, আদর দিয়েছে তারা খুবই সাধারণ শ্রেণীর মানুষ ছিলেন। এই যেমন আমাদের ঘরে সহযোগী হিসেবে যারা কাজ করতো কৃষ্ণ কাকু, আমার মায়ের আদর দিয়ে যিনি আগলে রেখেছিলেন, সেই শেফালী পিসি (কালো কুচকুচে ছিল বলে সবাই কালা পিসি ডাকতো), আরেক পিসির কথা কয়েকদিন আগে লিখেছিলাম, আমার দাদুর সেবা দাসীর মেয়ে। এই মানুষগুলোর ভালোবাসায় কোন খাদ ছিল না। বাচ্চারা আদর বিষয়টি খুব পরখ করতে পারে।
আমার অন্য ঘরের ভাই-বোনদের আদর করার অনেক মানুষ ছিল, তাদের দাদু-ঠাকুমা, দাদু-দিদিমা, পিসিমা-মাসিমারা আদর করে অনেক কিছু কিনে দিতো।
আমি তাদের পাশে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতাম ছোট্ট মাটির কালো কলসিটি আমাকে কেউ কিনে দেয় কিনা। দেয়নি,ছোট্ট বুকে কষ্ট নিয়ে ঘরে ফিরেছি। আমার বাবার যেদিন নয় দিন বয়স, দাদু সেদিন মারা যায়। ঠাকুমা এর পর পরই সিজোফ্রেনিয়ায় আজীবন ভুগে ১৯৯৭ সালে মারা যায়।
আমাদের জন্মের আগেই দিদিমা আর একমাত্র পিসীমাও মরে গেছেন। তাই কাল্পনিক আদরের জায়গাগুলো বাস্তবে ছিল না।
ছোটবেলায় খুব দুঃখ পেতাম, আমার কাকাতো বোনদেরকে তাদের দিদিমা রুপার নূপুর বানিয়ে দিয়েছে, আমাকে কে দিবে? এই দুঃখে মন খারাপ করতাম।
মা-বাবা দিলে হবে না, দিদা-ঠাকুমাই লাগবে। কী হাস্যকর আবদার আমার। তবে সেই যে কালো কলসিটা আমার মতই ছোট্ট ছিল, যাকে আমি কাঁখে করে পুকুর থেকে জল আনবো ভেবেছিলাম, তাকে না পেয়ে মনে মনে ভেবে রেখেছিলাম বড় হলে আমি বাচ্চাদের বেশী আদর করবো।
ফেরিওয়ালা এলে যে বাচ্চারা শুধু লাল-নীল খেলনার দিকে চেয়ে থাকে, আর মনে মনে ভাবে খেলনাটা যদি আমার হতো সেই সকল বাচ্চাদের আমি খেলনা কিনে দিবো।
যারা আমাকে অবহেলা করেছে আমি তাদের কাছ থেকে শিখেছি, আমি চেষ্টা করবো আজীবন কাউকে অবহেলা না করতে। যারা আমাকে অপমান করার চেষ্টা করেছে, তাদের কাছ থেকে শিখেছি, কাউকে অপমান করতে হয় না খুব সহজে। যারা আমার দুর্বলতা কে পুঁজি করে ছোট করার চেষ্টা করে, তাদের কাছ থেকে শিখেছি কারোর দুর্বলতা জানলে তাকে বুঝতে দিতে হয়না যে আমি তার দুর্বলতা জানি।
আমি কার কাছে কৃতজ্ঞ না? ভিক্ষা করতে আসা বৃদ্ধ সুফিয়া যে আমাকে মা বলে ডাকতো, একাত্তরে স্বামী-ছেলেকে হারিয়ে পাগল প্রায় সুফিয়ার ময়মনসিংহ এ ছোট্ট বাসা কেড়ে নিলো তার আত্মীয়-স্বজনরা। আমার সাথে যখন প্রথম দেখা, চোখে ভালো দেখে না, ভিক্ষা করতে আসে আমাদের গুলকিবাড়ি বাসায়।
ভিক্ষা দিতে দিতে বলছিলাম দাঁতে গুল দেন কেন? এটা খুব খারাপ জিনিস, শরীর আরো খারাপ করবে। বৃদ্ধ সুফিয়া হুট করে শিশুর মতো কাঁদতে থাকে, আমাকে বলে, কেউ তো আপনের মতো করে কোনোদিন বলে নাই আমাকে। আর দিতাম না, আপনে আমার মা, আপনার কথা শুনবাম।
আমি যখন অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি, সেই বৃদ্ধ সুফিয়া আমার জন্য রোজা রেখে হাসপাতালে আমাকে খুঁজে বের করে। আমি তাঁকে বলি, সারাবছর তো রোজা রাখেনই, একবেলা, মাঝে মাঝে দুই বেলা খাওয়া জোটে, এতো রোজার মতোই। আবার আজকে আমার জন্য কেন রোজা রাখতে গেলেন?
তার সহজ উত্তর, আমার আম্মার অসুখ, আমি আল্লার কাছে মানত করছি, আমার আম্মা ভালো অইয়া যাইবো। সেদিন থেকেই তো জানি, আমার মৃত্যু সহজে হচ্ছে না। যতদিন ময়মনসিংহ ছিলাম বৃদ্ধ সুফিয়া আমার মেয়ে হিসেবেই আসতো আমার কাছে। নিজে স্টুডেন্ট ছিলাম তখন, নিজের ওখান থেকেই এক চিমটি করে সুফিয়ার জন্য আলাদা করে রাখতাম চাল,ডাল, নুন।
আর সেই যে রিকশাওয়ালা, ঝড়-বাদলের দিনেও সন্ধ্যায় এসে বাসার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতো, আমি টিউশনিতে যাবো ছোটবাজার, যদি রিকশার অভাবে সময়মত না যেতে পারি ছাত্রীর বাসায়!
তার কাছেও শিখেছি, মানুষকে না চিনেও ভালবাসা যায়, অপরিচিত হলেও মানুষের প্রতি দায়িত্বশীল হতে হয়। টিউশনি থেকে ফেরার সময় সে ঠিক রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতো আমাকে বাসায় পৌঁছে দেয়ার জন্য। সে ঝড়-বৃষ্টি যাই থাকুক। তার আবদার তার ছেলের মুসলমানি হবে, আমাকে মুক্তাগাছা তার বাড়িতে যেতেই হবে। আমি না গিয়ে পারলাম না, সে নিজে এসে তার রিকশা করে আমাকে তার বাড়িতে নিয়ে গেলো। তার বাড়িতে গিয়ে আমার জন্য আয়োজন দেখে আমি রীতিমত লজ্জায় পড়ে গিয়েছিলাম।
যতদিন ময়মনসিংহ ছিলাম, সেই রিকশাওয়ালা আমার প্রতি দায়িত্ব পালন করেছে। আমার অকৃতজ্ঞ হওয়ার কোন সুযোগ নেই এই মানুষটার প্রতি।
আমার নিজের কাঠগড়াটি এই মানুষগুলো তৈরী করতে শিখিয়েছে।
আমি যখন ভালো কিছু করতে চাই, তখন আমাকে খারাপ কথা বলে, খুঁচিয়ে রক্তাক্ত করার চেষ্টায় মত্ত হয় কিছু কাছের মানুষ। তাদের কাছ থেকে শিখেছি, প্রিয়জন ভালো কিছু করতে চাইলে তাকে উৎসাহিত করতে হয়। তাদের আনন্দে আনন্দিত হতে হয়।
আমার অসাধারণ হওয়ার সুযোগ নেই। আমি এখনো একটা দামী ড্রেস কিনতে গেলে দশ বার ফিরে আসি না কিনে। এক হাজার টাকার উপরে গেলেই মনে হয় এত দামী ড্রেস কিনবো?
এবার দেশে গিয়ে দেখি সব কিছুর দাম বেড়েছে। অনেক কষ্টে নিজের জন্য একটা দামী শাড়ী কিনেছি ৩৪০০ টাকা দিয়ে। লাল টুকটুকে শাড়ীটা ৫০০০ টাকা দেখে কিনতে চাইনি, বন্ধু আল্পনা জন্মদিনে ৫০০০ টাকা দিয়েই কিনে দিয়েছে।
ওর বেতন কত? কিভাবে চলে আমি জানি, আমি নিতে চাইনি, তবুও আমার জন্মদিনের উপহার নিতেই হলো। জামা বানিয়ে এনেছি দেশ থেকে সব ১৫০০ টাকার মধ্যে। এর উপরে উঠতে পারি না, আমার কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে জানি।
কলাপাতার সবুজ যে শাড়ীটা পাঁচ দিন দেখে ঘুরে চলে এসেছি, দামী বলে আনিনি। সেই শাড়ি কানাডা আসার দুদিন আগে আমার লাগেজে ঢুকিয়ে দিয়েছে আমার বন্ধু আল্পনা। বন্ধুত্ব আমি ওর কাছ থেকে শিখেছি।
আর শিখেছি রেখার কাছ থেকে, ঢাকায় গেলে যার বাসাটি আমার নিজের বলে মনে হয়, সেই রেখা, তার কাছ থেকে শিখেছি নিজের সব কিছু অন্যদের কী করে উজাড় করে দিতে হয়। আমি ওর মতো পারি না, আল্পনার মতো পারি না, চেষ্টা করি।
আরেক বন্ধু ডাক্তার শামীম, অস্ট্রেলিয়া থাকে, তার কাছ থেকে শিখি দুর্দিনে মনের জানালাটা খোলা রাখতে হয় আলো-বাতাসের জন্য। বিপদের কথাগুলো শেয়ার করে বন্ধুকে পথ খুঁজে বের করে দিতে হয় কেমন করে, ওর কাছ থেকে শিখি। আমি তো সবার কাছে কৃতজ্ঞ।
আমার এই জীবনে যাদেরকে পেয়েছি, আমি অপূর্ণ থাকতে পারি না।
মেয়েকে বলি, খাবার নষ্ট করবে না কখনও, দেখো না পৃথিবীর কত বাচ্চা খাবার পায় না। সেই সকল মানুষের ভিডিও দেখাই মেয়েকে।
কাজ না থাকলে লাইট অফ করে রাখো, অযথা বিল উঠে, যদিও বিল আমাদের দিতে হয় না। আমি মেয়েকে চাইলেই সব কিনে দেই না, অভাব রাখি। অভাব অনুভবের জন্য।
আমাকে অনেক দামী ড্রেস পড়লে মানায় না, আমি জানি। আমি বেশীর ভাগ সময়েই তাঁতের শাড়ী পছন্দ করি যে কোন অনুষ্ঠানে। জামদানী খুব প্রিয়, গিফট পেয়েছি দুই-তিনটা। আর কিনতে চাই না, সব রঙের জামদানী কিনতে ইচ্ছে করে যদিও।
আমার জামার রং উঠলেই ফেলে দেই না, অপেক্ষা করি ছেঁড়ার জন্য। আমাদের ঘরে অসাধারণ কোন আসবাবপত্রও নেই।
আমার কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়। আমার জীবনের খারাপ দিকগুলো সব বিজয়ের সাথে শেয়ার করে সংসারে ঢুকেছি। ঝগড়া হয়েছে, অনেক খারাপ সময় কেটেছে আমাদের দুজনের। আমার কাঠগড়া আমাকে সব সময় পরিষ্কার রাখতে সহযোগিতা করে।
আমি অসাধারণ হতে পারবো না কোনোদিন।যে মানুষগুলো আমাকে ভালোবাসা, দায়িত্ববোধ, স্নেহ,বন্ধুত্ব, সব শিখিয়েছে তারা সবাই খুব সাধারণ। এমনকি যাদের ঘরে আমার জন্ম, তারাও সাধারণ। তাই আজীবন আমার এই সাধারণ কাঠগড়াটি নিয়েই সাধারণ জীবন কাটাতে হবে।
কাঠগড়াটি থাক তবে আমৃত্যু……থাক আপনার উত্তর প্রজন্মের জন্যে। লিখুন দিদি দুহাত ভরে লিখুন……………