
কুলদা রায়: একাত্তর সালে পাকবাহিনীর প্রধান টার্গেট ছিল হিন্দু সম্প্রদায়। তারা শুরু থেকে হিন্দুদেরকে হত্যা করেছে। হিন্দু নারীদেরকে ধর্ষণ করেছে। তাদের বাড়ি সহায়-সম্পদ সব লুটপাট করেছে। আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে। গুলির মুখে জীবিতদের দেশত্যাগে বাধ্য করেছে।
দেশত্যাগ করে হিন্দুরা পথে পথে মরেছে, শরণার্থী শিবিরে মরেছে–মরেছে রোদে, বৃষ্টিতে, শীতে, বন্যায়, রোগে, শোকে, খিদেয়, অনাহারে, সাপের কামড়ে, অপমানে, অবহেলায়। একাত্তরে হিন্দু সম্প্রদায়ই ছিল প্রধান ভিক্টিম।
এই হিন্দুদেরকে যারা আশ্রয় দিয়েছে সেই সব মুসলমানদেরকেও পাকবাহিনী হত্যা করেছে। মুসলমান নারীদের ধর্ষণ করেছে। তাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দিয়েছে। লুটপাটের শিকার হতে হয়েছে। পাকবাহিনী ঘোষণা দিয়েছে, বাঙালী মুসলমানরা পূর্ণ মুসলমান নয়। তারা হিন্দু প্রতিবেশিদের সঙ্গে থেকে আধা হিন্দু হয়ে গেছে। হিন্দুদের ষড়যন্ত্রে পা দিয়ে পাকিস্তানকে ভেঙ্গেছে।
বাংলাদেশ স্বাধীন হলে আবার জীবিত হিন্দুরা শরণার্থী শিবির থেকে দেশে ফিরেছে একেবারে নিঃস্ব হয়ে। তাদের ঘর ছিল না। ফসল ছিল না। টাকা ছিল না। খাবার ছিল না। শূন্য হাতেই তাদের আবার নতুন করে সব কিছু শুরু করতে হয়েছিল। তারা মনে করেছে, নতুন রাষ্ট্রটি হবে মানবিক রাষ্ট্র। দানবের কোনো স্থান থাকবে না। মানুষই হবে রাষ্ট্রের নাগরিকদের প্রধান পরিচয়।
মাত্র দুবছরের মধ্যেই দুর্ভিক্ষ মারাত্মক ছোবল হানলে তারাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তারাই বেশি না খেয়ে মারা যায়। তারাই বেশি অপুষ্টির শিকার হয়। তারাই বেশি ঋণগ্রস্ত হয়। তারাই বেশি ভিখিরি হয়। তারা নিঃস্ব থেকে নিঃস্বতর হয়ে পড়ে। রাষ্ট্র তাদেরকে রক্ষা করেনি। পঁচাত্তরের পরে পাকিস্থানপন্থার দিকে রাষ্ট্রের উলটো-যাত্রা শুরু হলে আবার এই হিন্দুরাই পাকিস্তানী ধারায় নিপীড়ণ-নির্যাতনের লক্ষ্যে পরিণত হয়।
যুদ্ধে-দুর্ভিক্ষে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েও কিন্তু হিন্দু সম্প্রদায় রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ফুঁসে ওঠেনি। কলে পড়া ইঁদুরের মত তারা নিজেদেরকে ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দিয়েছে। দিনের পর দিন রাষ্ট্রের প্ররোচনায়-প্রণোদনায়-উপেক্ষায় সংখ্যাগরিষ্ঠের সাম্প্রদায়িক শক্তির হিংসার নিত্যনতুন শিকারে নিজেদেরকে পরিণত করেছে।
তাদের কোনো স্থান নেই রাষ্ট্র ক্ষমতায়, রাজনীতিতে, সমাজনীতিতে, অর্থনীতিতে, সংবিধানে, আইনে, নিরাপত্তায়, শিল্প, সাহিত্যে, সংস্কৃতিতে। সবদিক থেকে একটি উন্মূল জীব হিসেবে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়।
এরা শুধু তাকিয়ে থেকেছে এই সেইসব মানুষের দিকে– যারা বাংলাদেশ ভূখণ্ডে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিসেবে ক্ষমতার ভেতরে-বাইরে আছে, যাদের মধ্যে ন্যূনতম শুভ বোধ আছে, যারা একদা তাদের রক্তের আত্মীয় ছিল, সুখে ছিল, দুঃখে ছিল, ভালোবাসায় ছিল, বেদনায় ছিল, তারা আবার জেগে উঠবেন। এই সাম্প্রদায়িক হিংসা নিপীড়নকে রুখে দাঁড়াবেন। হিন্দু বা মুসলমান হিসেবে নয়, খ্রিস্টান-বৌদ্ধ বা পাহাড়ি হিসেবে নয়, মানুষ হিসেবে মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় রাষ্ট্রকে বাধ্য করবেন। সেইদিনটি কতো দূরে আর?
আসলেই সময়ের কাছে বার বার একই প্রশ্ন করতে হচ্ছে আমাদের। কবে আমরা মানুষ হিসাবে বাঁচবো?
Survival of the fittest – it is one of the corner stone of the theory of evolution. Since they could survive amid all these hardships – they are definitely fit. Just fit to survive but not to enjoy a better life. For that they need the will, direction and leadership to fight against all the odds.