প্রাণ যায়, তবু ওড়না না যায়

Dopatta 1শারমিন শামস্: এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে ফেরার পথে গলার ওড়না ইজিবাইকে জড়িয়ে মরেছে এক মেয়ে। মরেছে, ক্ষতি নাই, ওর ‘ইজ্জত আব্রু’ – এগুলি সব রক্ষা পেয়েছে। একইদিনে হিজাবের পক্ষে সাফাই গাইতে গিয়ে সাইকেলযোগে তিন হিজাবিনী ঘুরেছেন রাস্তায়। হিজাব তাদের দমিয়ে রাখতে পারেনি, এই তাদের বক্তব্য।

কিন্তু হিজাব কেমনে আগায়ে দেয়, এই বস্তু আজ পর্যন্ত বুঝে উঠতে পারলাম না। হিজাব পরে পুলিশ হওয়া যায়? আর্মি হওয়া যায়? সাঁতারু হওয়া যায়? হিজাব পরে অভিনয় করা যায়? নাচা যায়? জিমন্যাস্ট হওয়া যায়? কারাতে-জুডো করা যায়? আর কত বলবো? এই লিস্টি লম্বা হতেই থাকবে। তো এই যে এত সব ‘না হওয়া যায়’ বস্তুর তালিকা- হিজাব ধারনে যা যা বাধাগ্রস্থ হয়, এর তালিকা তো দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর। তাইলে হিজাব কেমনে নারীরে সামনে আগায়? আমি কিছুই বুঝলাম না!!
এই উদ্যোগের মহান উদ্যোক্তার আরও একটি বক্তব্য ছিল, তিনি কোনো এক টিভি চ্যানেলে কাজ করতে চেয়েছিলেন হিজাব পরে, পারেননি বলেই তার ক্ষোভ। তিনি বার বারই বলছিলেন, সৌদি আরবে তিনি থেকেছেন, এই পোশাক পরেছেন, বাংলাদেশ তার ভাষায় যেহেতু একটি ‘মুসলিম’ দেশ, তাই এখানেও এরকম পোশাক চালু হওয়া বাঞ্ছণীয়। দারুণ সব যুক্তি!

আমার পরিচিতা এক রমণী যিনি নব্য হিজাবিনী, তিনি আমারে বয়কট করেছেন। কারণ আমি হিজাব করি না। তার মনে হইসে, আমি খারাপ। ধর্ম-কর্ম করি না। তিনি তার ছোটকালের যাবতীয় পুরুষ বন্ধুকেও বয়কট করেছেন। কারণ ইসলামে পুরুষ বন্ধু থাকা মানা। তবে তিনি তার বন্ধু তালিকায় এমন অনেককেই রেখেছেন যাদের অনেকেই নিজের বিকিনি পরা ছবিও পোষ্ট করেন।

এরকম কেন তবে? ব্যাপারটা জলের মত পরিস্কার। ঐ বিকিনি পরা মেয়েটিকে ঐ হিজাবিনীর নানা কাজে প্রয়োজন। তার সাথে যোগাযোগ থাকাটা তার দরকার। তো, স্বার্থ যখন দরজা দিয়া ঢোকে, ধর্মের নামে ভড়ং তখন জানালা দিয়া পালায়।
যাই হউক, হিজাব নিয়ে কথা চলে আসছে সাইকেলওয়ালীদের কথা মনে পড়ায়। আমি লিখতে বসছিলাম সেই মেয়েটার কথা যে এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে বাড়ি যাচ্ছিলো, আর যার ওড়না ইজি বাইকে আটকে গিয়ে তার শ্বাসরোধ হয়ে মারা গেছে।

Dopatta 2এরকম কত কত বার যে আমার ওড়না আটকেছে, তার শেষ নেই। আমার বোনের, আমার বন্ধুর, সহকর্মীর ওড়না কত-কতবার তাদের প্রায় মৃত্যুর কাছে নিয়া গেছে, তার হিসাব নাই। তবু ওড়না আমরা ছাড়ি নাই। জান দেব, তবু ওড়না নাহি দিব। ওড়না তো ওড়না; জামার গলা একটু বড় হলেই, একটু কাঁধের দিকে সরে ব্রা’র ফিতা দেখা গেলেই আমার কত মেয়ে বন্ধুই হা হা করে ছুটে আসে, আর ঠিক করে দেয় আমার জামা, আর আড়ে আড়ে তাকায় আশেপাশে, যে তার এই নির্লজ্জ বন্ধুটার কীর্তি কেউ দেখে ফেললো কি না, যে তার জামার নিচে ব্রা টা ঠিকমত লুকায়ে রাখতে পারে না!
তো মনে পড়ে, আওয়ামী লীগ অফিসে শার্ট পরে অ্যাসাইনমেন্টে গিয়েছিলাম বলে, অফিসে আমার সঙ্গে রাগ করে তিনদিন কথা বলেন নাই একই বিটের সহকর্মী বড়ভাই। আমি শার্ট পরেছিলাম, যেন ওড়না পরতে না হয়। আমি শার্ট পরেছিলাম কাজের সুবিধার জন্য। আমি শার্ট পরছিলাম, যেন আমি মুড়ির টিনের মত বাসে ঝুলে ঝুলে বঙ্গবন্ধু এভিনিউ থেকে তেজগাঁও ফিরতে পারি অনায়াসে, যেরকম ঝাড়া হাত-পা নিয়ে ফেরে আমার পুরুষ সহকর্মীরা।

তো, আমি আরামে থাকলে পুরুষতন্ত্রের হাত পা চুলকাবে, এটাও স্বাভাবিক। তাই বলে কি আমি আমার আরাম বাদ দিয়ে গলায় রশি বাঁধবো?
তো আমি ঘুরে দাঁড়িয়েছি, আমি প্রতিবাদ করছি, কিংবা পাত্তা দিই নাই। যা আমার ভালো মনে হয়েছে, বা হয়, তাই করি। কিন্তু সব মেয়ে তো তা পারে না। জন্মের পর থেকে একটা ওড়না অশরীরি ছায়া হয়ে আমাদের গলায় এঁটে বসে। সেই ওড়না নিয়েই চলি ফিরি। এই ওড়না ফেলার উপায় নাই। মরিলেও না। অটোতে ওড়না ঢুকিলেও না। রিক্সার চাকায় পেঁচাইলেও না। ওড়না হলো আমার সতীত্বের প্রমাণ। ওড়না হলো সেই বস্তু যা সারা গায়ে লেপ্টাইয়া জড়াইয়া পেঁচাইয়া না রাখিলে আমি বেশ্যা। ওড়নাই আমার সার্টফিকেট।

আর ওড়না যদি সরে যায়, তবে পৃথিবী যত অশ্রাব্য-কুশ্রাব্য শুনতে শুনতে ফিরতে হবে বাড়ি। এই অশ্রাব্য যারা কয়, তাদের মুখে ওড়না আঁটিবার কেহ নাই, তাদের মুখ সেলাই করিবার কোন বিধান নাই, তাহাদের লালা আটকাইবার কোন ব্লটিং পেপার নাই।

যা আছে তা হলো মেয়ের বুক ঢাকিবার ওড়না। সেই ওড়না সহযোগে একবার বসেছিলাম রিক্সায়। নতুন নতুন সালোয়ার-কামিজ পরি তখন, ভালোমত ঢেকেঢুকে পরেছি সেই মহামতি ওড়নাখানা। বয়সও নিতান্তই কম। ১২ কি ১৩। হঠাৎ ভিড়ে দাঁড়ানো আমার রিক্সার পাশ দিয়ে যেতে যেতে মধ্যবয়সী এক লোক হাত ঢুকিয়ে দিলো ওড়নার নিচ দিয়ে। তারপর একরাশ থকথকে ঘৃণার অন্ধকারে আমাকে ফেলে রেখে চলে গেল অনায়াসে।

তো, ওড়না হলো সেই বস্তু, যে আরো ভালো করে মনে করায় যে এই ওড়নার নিচেই আছে নারীর স্তন, নারীর দেহ। যা শুধু ভোগের আর লালসার। যা ঘৃণ্য, অথচ লোভনীয়। তাই তাকে কয়েক স্তর কাপড়ের নিচে রাখলেও লালসার আগুন নেভে না বাঙালি পুরুষের।

মাননীয় ওড়না, আজ জানতে চাই, এইবার পুরুষের চোখ, মুখ আর হাত দুখানা পেঁচিয়ে রাখতে কবে থেকে ব্যবহৃত হবেন আপনি?

শেয়ার করুন: